আমরা আবার একসাথে

নিহার প্রেম ট্রেমে বিশ্বাস ছিল না। সেই যে বছর চারেক আগে এক ছোকরা মধুর বোয়াম খুলে পালিয়ে যায়, সে ঘা তাড়িয়ে বেড়াত। সেই ছোকরাও তাকে তাড়িয়ে বেড়াত।

আমি ভালবাসাকে দর্শনজ্ঞান করতাম। এ দর্শন আমাকে ভাবাত। কল্পনার খোলা আকাশজুড়ে কেমন ভারি ভারি নিঃশ্বাস মেঘ হয়ে যেতো। আমি প্রেমে পড়তাম। বারবার। ভালবাসতে চাইতাম। বারবার। এক অঞ্জলি ভালবাসা নিয়ে প্রেম নগরীর হাইওয়ের এক পাশে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকতাম।

নিহার সাথে যোগাযোগ হয় ডিবেট করতে গিয়ে। তার দৃষ্টির গভীরতা, সাহসী বাচনভঙ্গি, তেজী জেসচার, শার্প শরীর… সব মিলিয়ে স্ট্যান্ডার্ড এক প্যাকেজ আমাকে তার প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। দুএকদিন ডিবেট করে বন্ধ করে দিই। এরপর তার ফলোয়ার হয়ে যাই। তথাকথিত ভার্চুয়াল ফলোয়ার না। রিয়েল লাইফ ফলোয়ার।

১১ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসে খুব মারামারি লাগে।

প্রথম বর্ষে কতটুকুই বা বোধ হয়েছে! শুনতাম, মারামারি হয়, খুনাখুনিও হয় এখানে। শুনে শিহরিত হতাম। চোখের সামনে দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। বেলা দুটো হবে তখন। মউয়ের দোয়ানে খাচ্ছিলাম। চিল্লাচিল্লি, কাটাকাটি দেখে বেড়িয়ে এক দৌড়ে মসজিদ, পরে শাটলের ফ্যামিলি বগিতে উঠে যাই। উঠে দেখি নিহা জানালার ফুটো দিয়ে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করছে। সাহসী সেই স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজকে আবিষ্কার করলাম অন্য রূপে। বগিতে আরো ৭/৮ জন ছিল। আমি তার সামনে গিয়ে বসলাম।

আমার দিকে তাকাতেই স্বাভাবিকভাবে বলল, “এই তুমি ডিবেট ছাড়সো কেন?”
আমি আমতা আমতা করতে করতে বললাম, “ইয়ে মানে, বাসা… কথা… ”
“আচ্ছা! হইসে হইসে! পানি খাও।”
ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে এগিয়ে দিলো। কিছুটা গিলে কাশতে কাশতে পানি নাকে মুখে উঠে গেল। নিহা হেসে ফেলল। আমি থামলে ও আবার জিজ্ঞাসা করল, ” ছাড়লে কেন? ভালই ত ছিলে।”
“আসলে, মানে… তুমি আমার… ”
“এভাবে ঘামছো কেন? আর অস্থির হতে হবে না। বলার চেষ্টা করো। জানি তুমি পারবা।”
আমি হেসে দিলাম। আস্তে আস্তে সহজ হতে লাগলাম ভেতর থেকে।

এরপর থেকে আমাদের যোগাযোগ সহজ হয়। আমি হালকা পাতলা ইংগিত দিই। সেও বেশ মজা করে।

এপ্রিলের ১৮ তারিখ। নিহা খুব সিরিয়াস মুখ করে বলল, “তুমি কী চাও তা আমি খুব ধরতে পারছি। কিন্তু এক ছোকরা আমাকে ডিচ করেছে। এরপর এসব নিয়ে আর মাথা ঘামাই না।”
“আচ্ছা।” আমি এদিক ওদিক তাকাচ্ছি।
“আচ্ছা মানে? তোমার সাথে লডর পডর করলে, তুমিও ভাগবা। কয়েকদিন ভাল লাগে এসব। আমি খুব জানি।”
“আচ্ছা।”
“বারবার আচ্ছা আচ্ছা করছ কেন? এখন থেকেই বিরক্ত লাগছে?”
আমি চুপ হয়ে যাই।
নিহা কপাল কুঁচকে আমার দিকে খুব বিরক্ত নিয়ে তাকাল। বলল, “তুমি এখান থেকে যাও ত। খুব বিরক্ত লাগছে তোমাকে।”
“আচ্ছা।”
দুজনেই হেসে দিই।

ওর আমার যতটা না ভাব ভালবাসা ছিল, তারচে ছিল অ-ভাব অ-ভালবাসা। কি এক বিকর্ষী আমাদের বিকর্ষণ করে রাখত। তবু একসাথে হলে উষ্ণতা টের পেতাম।

বাস্তবতা আমাদের মাঝের কাচের দেয়াল হতে থাকে। ওর বিয়ার কথাবার্তা, আমার স্যাটেল্ড হওয়া না হওয়া নিয়ে ধোঁয়াশার মাঝেও আমরা আগামী দিনের আলপনা আঁকতাম।

সেদিন দুজন ফরেস্ট্রির রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম। ও শক্ত করে আমার হাত ধরে রাখে। আমরা যখনই আগামীর স্বপ্ন বুনি, ও হাত এভাবে শক্ত করে ধরে রাখে। আজো ধরেছে। আমি বললাম, “বাসা নিলে জামালখানের দিকে নিবো। আমাদের কর্মস্থল আশা করি ওখান থেকে কাছে হবে। আর প্রায় বিকেলে আমি তুমি হাঁটবো, ডিসিহিলে বাদাম খাবো।”
ব্যাগ থেকে নীল রঙের খাম বাড়িয়ে দিয়ে নিহা বলল, “তা নাহয় অন্য কারো সাথে হবে তোমার। তথাকথিত ফাউল আশিকদের মত আবার দেবদাসগিরী করিও না। বিয়েতে অবশ্যই আসবা।”
এইটুক বলে আমার হাত ছেড়ে দিলো।

আমার গলা জড়িয়ে আসার আগেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “অভিনন্দন নিহা।”
নিহা মিষ্টি একটি হাসি মুখে এনে আবার হাঁটা শুরু করলো।

আমরা আবার একসাথে হাঁটতে থাকি। গাছপালা, মেঘ আকাশ, দালানকোঠা সবগুলো একসাথে দেখতে থাকি। নিহা আবার আমার হাত ধরে। খুব শক্ত করে। এর আগে এরচে শক্ত করে ধরেছিল? মনে পড়ছে না।

Related Posts