ভ্রম
(১) ডাইনিং টেবিলের সামনে দেওয়াল জুড়ে বিশাল বড় এক আয়না।শোভন বসে আছে আয়নার ঠিক বিপরীতে।মুরগির লেগপিছ চিবুতে চিবুতে সে তাকিয়ে আছে আয়নার দিকে।তার গজদাঁতটা হঠাৎ কয়েকদিন ধরে একটু বড় দেখাচ্ছে।অবশ্য অশেপাশের কারোরই চোখে পড়েনি এখনো।কিন্তু শোভন বেশ বুঝতে পারছে তার গজদাঁতটা আগের চেয়ে একটু বড় হয়েছে।
দাঁতের প্রতি ছোটবেলা থেকেই শোভন খুব যত্নশীল।খাওয়ার পরে সাথে সাথেই সে দাঁত ব্রাশ করে নেয়।বাইরে থাকার কারণে যদি কখনো দাতঁ ব্রাশ করা মিস হয়ে যায় তাই সবসময় তার কাছে একটা মাউথওয়াস থাকে।কিছু খাওয়া মাত্রই মাউথওয়াস দিয়ে ভালোমত গার্গেল করে নেয়।দেশ বিদেশের নামীদামী ব্র্যান্ডের টুথপেষ্ট,টুথব্রাশ ছাড়া অন্য কিছু সে দাঁতে ছোঁয়ায় না।পরিচিত কেউ বিদেশে গেলে তার সেই একই আবদার থাকে,তার জন্য যেন মাউথওয়াস আর টুথপেষ্ট অবশ্যই আনা হয়।একমাত্র সন্তান হওয়ায়,শোভনের মা বাবা কখনোই ছেলের এমন আজব অভ্যাসে বাধা দেয় নি।আশেপাশের আর দশটা ছেলের তুলনায় কোন দিক থেকে কম নয় শোভন।দেখাশুনা,শিক্ষাদীক্ষা সব দিক থেকে একেবারে একশোতে একশো।একটা প্রাইভেট ফার্মে বেশ ভালো পজিশনে আছে সে।মাস ঘুরলে পাঁচ সংখ্যার বেতন হাতে আসে তার।এতো বয়স অবধি এখন পর্যন্ত কোনদিন একটা সিগারেটও সে ঠোঁটে ছোঁয়ায়নি।শুধু একটাই সমস্যা তার,দাঁত নিয়ে অতরিক্ত সচেতনতা।
দাঁত নিয়ে তার এসব কাজকর্ম সম্পর্কে পরিচিত মহলে কানাঘুষো কিছু কম হয় না।শোভন সেসব কথা শুনেও না শুনার ভান করে থাকে।অনেকে আবার তার কাছে দাঁত বিষয়ক বিভিন্ন পরামর্শ চায়।শোভন বেশ উপভোগ করে বিষয়টা। কেমন একটা সেলিব্রেটি ভাব আসে নিজের মধ্যে।সবাই অবশ্য তার গজদাঁতের বেশ প্রশংসা করে।মুখের বামপাশের গজদাঁতটার কারণে সে হাসলে খুব সুন্দর দেখায়।গজদাঁতের প্রতি তার অন্যরকম একটা ভালোবাসা আছে।অনেকদিনের ইচ্ছা তার,এমন কোন মেয়েকে বিয়ে করবে যার মুখের ডানদিকে গজদাঁত আছে।সবাই তাদের বলবে “গজদাঁত দম্পতি”।কিন্তু মুখের ডানপাশে গজদাঁতওয়ালা মেয়ে খুঁজে পাওয়া ভারী মুশকিলের কাজ।শহরের এমন কোন ঘটক নেই যাকে শোভনের মা বাবা ছেলের বিয়ের জন্য পাত্রীর খোঁজার দায়িত্ব দেয়নি।কত সুন্দরী মেয়েকে যে শুধুমাত্র এই গজদাঁতের অভাবে শোভন প্রত্যাখান করেছে তার হিসেব করতে বসলে কয়েক দিস্তা কাগজ ফুরিয়ে যাবে।যদিও কোন মেয়ের গজদাঁত থাকে তো সেটা থাকে মুখের বামদিকে।তাই তাদের নাম বাতিলের খাতায় উঠে যায়।এই করতে করতে শোভনের বয়স এ বছর মধ্য তিরিশে পৌছে গেলো।মা,বাবার সাথে এ নিয়ে অনেকদিন থেকে একরকম মানসিক দ্বন্দ চলছে তার।
ইদানীং তার মনে হচ্ছে, তার গজদাঁতটা একটু একটু করে বড় হচ্ছে।গাছ যেমন মাটি থেকে পুষ্টিকর উপাদান শুষে নিয়ে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে ব্যাপারটা যেন ঠিক সেরকম।তবে কি এতসব ভালো ভালো টুথপেষ্ট,মাউথওয়াস বেশি বেশি ব্যবহারের কারণেই এমনটা হচ্ছে? এসব ব্যবহারের কারণে মাড়ি খুব উর্বর হয়ে গেছে তাই গজদাঁতটা ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে।কিন্তু এতোদিন তো এমন কিছু হয়নি তবে এখন হঠাৎ এমন কেন হচ্ছে?এতসব অবান্তর ভাবনা শোভনের মস্তিস্ককে কুড়ে কুড়ে খেতে লাগলো।যেই শোভন আগে টুথব্রাশ ভর্তি করে টুথপেষ্ট লাগাতো সে এখন খুব হিসেব করে টুথপেষ্ট নেয়।সর্বসাকুল্যে আধ ঢোক পরিমাণ মাউথওয়াস দিয়েই এখন গার্গেল সেরে নেয় সে।
(২)
রাত ৮.৩০ মিনিট। শোভন এক ঘন্টা যাবত ডাঃ সাব্বিরের চেম্বারের বাইরে বসে আছে।চিন্তায় তার কপালের শিরাগুলো দপদপ করছে।ডিসেম্বর মাসের কনকনে ঠাণ্ডাতেও সে কুলকুল করে ঘেমে যাচ্ছে।কাল রাতে সে একটা ভয়ানক স্বপ্ন দেখেছে।তার গজদাঁত আরো বড় হয়ে গিয়েছে।এতো বড় হয়েছে যে বাঁকা হয়ে মুখের বাইরে বের হয়ে এসেছে।তাকে দেখাচ্ছে হিংস্র কোন প্রাণীর মতো।
-দেখুন শোভন সাহেব, আপনার দাঁতে কোন সমস্যা নেই।আপনার সমস্যাটা মানসিক।আই থিঙ্ক ইউ শুড কনসাল্ট উইথ আ সাইক্রিয়াটিস্ট ইমিডিয়েটলি।
-হাউ ডেয়ার ইউ!কি বলতে চাচ্ছেন আপনি?আমি পাগল?
-আপনি ভুল ভাবছেন।আপনাকে পাগল বলে আমার কি লাভ?এইরকম অনেকেরই হয়ে থাকে।আপনি যেহেতু দাঁতের ব্যাপারে খুব সেনসিটিভ তাই এমনটা হওয়া অস্বাভাবিক নয়।আমার এতো বছরের ডাক্তারি অভিজ্ঞতা অন্তত তাই বলছে।
শোভন আর এক মুহূর্ত দেরি না করে ডেন্টিস্টের চেম্বার থেকে বের হয়ে এলো।এই মুহূর্তে মেজাজ ঠিক করতে এক মগ ব্ল্যাক কফির ভীষণ প্রয়োজন তার।দাঁতের প্রতি সচেতনতার কারণে ছোট থেকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে তাকে।কিন্তু তাই বলে পাগল! এই পর্যন্ত কেউ তাকে পাগল বা মানসিক রোগী বলেনি কখনো।এত টাকা খরচ করে নামকরা ডেন্টিস্টের কাছে আসাটাই বৃথা গেলো।ডেন্টিস্টের কথাটা ঠিক হজম করতে পারছেনা সে।
(৩)
অনেকদিন পরে শোভন আজ ভীষণ খুশি।এই প্রথম মা,বাবা তার মন মতো একটা মেয়ে খুঁজে দিতে পারলো।ইরা মেয়েটার হাসিটা দারুণ। মেয়েটা যখন হাসছিলো,শোভনের চোখ তখন বারবার তার মুখের ডানদিকের গজদাঁতের উপর আটকে যাচ্ছিলো।তাছাড়া মেয়েটা যথেষ্ঠ সুন্দরী ও শিক্ষিত।এক কথায় বলতে গেলে তার জন্য একেবারে পারফেক্ট।এতোদিনে শেষ পর্যন্ত কোন মেয়ে তার মনে জায়গা করে নিতে পারলো।তার আইবুড়ো উপাধিও এবার ঘুচলো।
(৪)
ডাইনিং টেবিলের সামনে দেওয়াল জুড়ে বিশাল এক আয়না লাগানো।শোভন মনোযোগ দিয়ে মুরগির লেগপিছ চিবুচ্ছে।সামনের আয়নাতে হিংস্র এক প্রাণীকে দেখা যাচ্ছে।স্বপ্নে শোভন যেরকম দেখেছিলো ঠিক তেমন।এবার শোভনের নিজের চেহারা দেখে নিজেরই ভীষণ ভয় লাগলো।সে হাত দিয়ে তার গজদাঁতটা ছুয়ে দেখলো।হ্যাঁ,আসলেই তো তার গজদাঁতটা বেশ খানিকটা বড় হয়ে মুখের বাইরে বের হয়ে এসেছে।আয়নাতে না হয় চোখের ভ্রমের কারণে ভুল দেখলো কিন্তু হাত দিয়ে তো আর মিথ্যে কিছু অনুভব করা সম্ভব নয়।শোভন ভেবে কূল পাচ্ছে না কিভাবে সে এই সমস্যার সমাধান করবে।চিন্তায় তার চোখে সর্ষেফুল দেখার মতো অবস্থা।এক সপ্তাহ পরে তার বিয়ে।তার আগেই যা হোক কিছু একটা সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।দেশসেরা ডেন্টিস্টের কাছে গিয়েও তো কোন লাভ হলোনা উল্টো পাগল উপাধি নিয়ে ফিরে আসতে হলো।আশ্চর্য ব্যাপার,আশেপাশের কেউ এই গজদাঁত বড় হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কিছু বলছে না। এমনকি তার মা বাবা ও না।কারো কি নজরে পড়ছে না?পাছে লোকে তাকে পাগল উপাধি দেয় তাই কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছে না সে।
(৫)
শুধু হাতুড়ি দিয়েই কাজ চলবে নাকি হ্যাক্সো ব্লেডেরও দরকার পড়বে? নাকি শুধু গজালেই কাজ হবে?
আপনমনে নিজেকে প্রশ্ন করে যাচ্ছিলো শোভন।বাদামি রংয়ের কাঠের টুলবক্সটা থেকে এক এক করে সব যন্ত্রপাতি বের করে সামনে সাজিয়ে বসেছে সে।তার গজদাঁতটা যেহেতু সরু হয়ে সামনের দিকে বড় হয়েছে তাই বাড়তি অংশটুকু ভেঙ্গে ফেললেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।কিন্তু কোন যন্ত্রটা দিয়ে বাড়তি অংশ ভাঙ্গবে তা নির্ধারন করতে পারছে না সে।অনেক ভেবেচিন্তে হাতুড়িটা নিয়ে নিজের বেডরুমের আলমারির সাথে লাগানো আয়নার সামনে চলে আসলো শোভন।মা বাবা দেখে ফেললে হাজারটা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে তাকে।
(৬)
বেডরুমের সাদা ফ্লোরে তাজা রক্ত গড়াচ্ছে।গজদাঁতটা ফ্লোরের একপাশে ছিটকে পড়েছে।হাতুড়ি দিয়ে মনে হয় আরেকটু আস্তে আঘাত করলেই হতো।শোভন মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে আছে।তার মুখের ভিতরে তীব্র যন্ত্রণা,চোখে কুয়াশা।চোখের পাতা ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে।জ্ঞান হারাবার আগে তার মস্তিস্কে এক টুকরো ছবি ভেসে উঠলো।ইরা তাকে প্রত্যাখান করেছে। দাঁত নেই এমন কোন ছেলেকে সে বিয়ে করতে রাজি নয়।কিন্তু তার যে ইরাকেই চাই।কিছুতেই এমন হতে দেওয়া যাবেনা!যেমন করেই হোক গজদাঁতের বাড়তি অংশটা কেটে আবার জায়গামতো লাগিয়ে নিতে হবে।শোভন গজদাঁতটা হাত বাড়িয়ে তুলে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।হাত কিছুতেই সামনে আগাচ্ছে না। শোভনের মুখের ভিতরে তীব্র যন্ত্রণা। চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।
(সমাপ্ত)