একজন মাদরাসা ছাত্রের মানসিক যুদ্ধ ও আর্তচিৎকার

একজন সতিকারের মাদ্রাসার ছাত্র একজন বীর যোদ্ধার মতই। তার আদর্শ ও নৈতিকতার জন্য নিজের মনের সাথে তুমুল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয়। সে যখন ছোট্ট একটি শিশু তখনই তাকে ত্যাগ করতে হয় মা—বাবার স্নেহ ভালবাসার সান্বিদ্ধ। একজন স্কুল পড়ুয়া শিশুকে যখন স্কুলে নিয়ে যেতেও পিতা মাতা তার সাথে থাকে।

ঠিক সেই বয়সের একজন মাদ্রাসার ছাত্রকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস পিতা—মাতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শিক্ষকদের শাসনের গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ালেখা শিখতে হয়।

পিতা মাতা থেকে দূরে থেকে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। একে তো তাকে মনের সাথে যুদ্ধ করে, মানসিক যন্ত্রণার অগ্নিদাহে পুড়ে পুড়ে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার যুদ্ধে বিজয়ী হতে হয়, দ্বিতীয়ত তাকে সার্বিক শাসনের বলয়ে থেকে নীতি নৈতিকতা এবং দ্বীনি শিক্ষা অর্জনে মনোনিবেশ করতে হয়।

তারপর তার দ্বিনী এলেম এবং বয়স যত পরিপক্ক হতে থাকে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে তার মানসিক যুদ্ধের ক্ষেত্র। মাদ্রাসায় তাকে শিখানো হয় মিথ্যা বলা পাপের কাজ, কারও সাথে প্রতারণা করা নিষেধ, টেলিভিশনে অশ্লীল সিনেমা দেখা হারাম। সুদ ঘোষ ইত্যাদি কবিরা গুণাহ, এগুলো কখনোই করা যাবে না।

কিন্তু সে দেখে— যেই পিতা—মাতা তাকে দ্বীনী শিক্ষা গ্রহণের জন্য এত মহব্বত করে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছে, সেই আপন পিতা মাতাই হর হামেশা মানুষের সাথে মিথ্যা কথা বলে বেড়াচ্ছে, মানুষকে বিভিন্নভাবে ধোকা দিচ্ছে, বাসায় আড্ডা দিয়ে সবাই মিলে একসাথে অশ্লীল সিনেমা দেখছে, সেই অশ্লীল দৃশ্যগুলো নিয়ে আবার আলোচনাও করছে, সুদ—ঘোষ ইত্যাদি কবিরা গুনাহে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে আছে। কি সাংঘাতিক কান্ড! এ দৃশ্য দেখে সে প্রতিনিয়ত মর্মাহত হচ্ছে কিন্তু লজ্জায় কিছু বলতেও পারছে না।

যেই সালাত না পড়লে মুসলিম বলেই গণ্য হয় না। সেই সালাত তার পিতা মাতা অহর্নিশ পরিত্যাগ করছে। যেন তার চোখের সামনে, তারই সাথে উপহাস করে পিতা—মাতা, পরিবারের লোকজন, আত্মীয়—স্বাজন জাহান্নামে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে।

<

কিন্তু ছোট্ট দেহ আর লাজুক মানষিকতার কারণে সে মুখ ফোটে বলার সাহস পায় না। কিন্তু বিবেক তাকে ভিতর থেকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, মানসিক যন্ত্রণায় ব্যথিত হৃদয় চিৎকার করে পৃথিবীর সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চায়।

অনৈতিকতা, বেহায়াপনা এবং আল্লাহদ্রোহীতার কাজ দেখে মনটা বিদ্রোহী হয়ে উঠে। কিন্তু সে কি করবে! যেই পিতা—মাতা, এবং পারিবারে বিরুদ্ধে সে যুদ্ধ করবে, সেই পিতা—মাতাই তাকে ভালোবাসে, মাদ্রাসার টাকা পরিশোধ করে, নতুন জামা আর সময়মত খাবারের ব্যবস্থা করে।

কিন্তু যে শিক্ষা গ্রহণের জন্য তার পিছনে ব্যায় করতে সেই পরকালের প্রতি তাদের কোন ভ্রম্নক্ষেপই নেই। মানসিক যন্ত্রণা বুকে চেপে, অভিমানকে মাটিচাপা দিয়ে বাধ্যগত সন্তানের মতো মাঝে মাঝে সালাতের কথা বললে তারা গুরুত্ব সহকারে কথাটিকে নিতে চায় না। আজ নয় কাল, শুরু করা উচিত ইত্যাদি ধরনের কথা বলে পাশ কাটিয়ে কথা মোড় ঘুড়িয়ে ফেলে।

এ অবস্থায় একজন মাদ্রাসার ছাত্রের মনে কি যে ভীষণ ঝড় বয়ে চলে তা কল্পনাও করা মুশকিল! সে এক আজব যোদ্ধা, না সইতে পারে, না বুঝাতে পারে, না বাধ্য করতে পারে, আর না অবাধ্য এবং বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারে।

নিজের মনের সাথেই সে যুদ্ধ করে, রক্তক্ষরণ হয়, তীব্র যন্ত্রণার কশাঘাতে মর্মাহত হয়, চারদিকের অনৈতিকতা আর অশ্লিলতায় মন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে, কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারেনা। সর্বদা উদাস নয়নে চিন্তায় ডুবে থাকে, নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে।

মানুষ মনেকরে এই তো ছেলে এখন ভালো হয়ে গেছে, কারও সাথে কথাও বলতে চায় না। কথাগুলো শুনে মনটা আরও দগ্ধ হয়, যন্ত্রণার কষাঘাতে হৃদয়টা আরও আরও বেশি ছাড়খাড় হয়। কিন্তু সে নিরব থাকে।

Related Posts

5 Comments

মন্তব্য করুন