কিছু গুরুত্বপর্ণ কথা – পিরিয়ড

আপনার কন্যা সন্তানকে কীভাবে তার প্রথম পিরিয়ডের জন্য প্রস্তুত করবেন?
বিপ্লব টিপ্লব কইরা সব চেঞ্জ করে দিবো না ভাইবা আসেন ঘরে কিছু কাজ করি। আপনার কন্যা সন্তান থাকলেও এই লেখাটা পড়ুন, না থাকলেও পড়ুন, বিবাহিত হলেও পড়ুন, অবিবাহিত হলেও পড়ুন। ছেলে হইলেও পড়ুন, মেয়ে হইলেও পড়ুন, জানুন। অনেক কাজে দিবে।
পিরিয়ড মেয়েদের জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। পিরিয়ডের মাধ্যমে একজন কন্যা শিশু ধীরে ধীরে নারী হয়ে উঠে। মানব সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার মতো মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্বে সে পিরিয়ডের মাধ্যমেই প্রবেশ করে। বিষয়টা নিঃসন্দেহে একজন নারীর জন্য আনন্দের। কিন্তু যে বয়সে পিরিয়ড শুরু হয় সেই বয়সে একজন মেয়েশিশু এতকিছু বোঝার মতো পরিণত না থাকার কারণে এই অভিজ্ঞতাটি একই সাথে তার জন্য আতঙ্ক, ভয়েরও হতে পারে। আপনার কন্যা সন্তানের এই আতঙ্ক ও ভয় দূর করার জন্য তাকে আগে থেকে তার প্রথম পিরিয়ডের জন্য প্রস্তুত করা জরুরী। পিরিয়ড সংক্রান্ত সকল ধারণা তাকে আগে থেকেই দিয়ে রাখা জরুরী। আর এই কাজটি পরিবার থেকেই করা উচিত। চলুন আজকে আমরা জেনে নিবো কন্যা সন্তানকে কীভাবে তার প্রথম পিরিয়ডের জন্য প্রস্তুত করবেন!
তার আগে জেনে নিবো কীভাবে বুঝবেন আপনার কন্যা সন্তান ঠিক কবে থেকে এই জার্নিটার মধ্য দিয়ে যাবে!
সাধারণত পিরিয়ডের অ্যাভারেজ বয়স ধরা হয় ১২ বছর (আমেরিকান স্ট্যান্ডার্ড)। কিন্তু এই বয়সেই সবার প্রথম পিরিয়ড হবে বিষয়টা এমন না। সাধারণত ১২ বছর বয়সে বেশিরভাগ মেয়েশিশুদের পিরিয়ড হয়ে যায়। কিন্তু অনেকের এর আগেও হয়, অনেকের পরেও হয়। ৮ বছর বয়সেও অনেকের হতে পারে, আবার অনেকের ১৫ বছর বয়সেও হতে পারে। তবে পিরিয়ড হওয়ার ৬-১২ মাস আগে মেয়েদের কিছু শারীরিক পরিবর্তন দেখা দেয়, যে পরিবর্তনগুলো দেখে পিরিয়ডের সম্ভাব্য সময় সহজেই অনুমান করা যায়।
• শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পশম দেখা দেয়া এই সময়ে অনেক কমন একটা লক্ষণ। বিশেষ করে বগলে ও গোপন অঙ্গগুলোয় ধীরে ধীরে পশম উঠা শুরু করবে ও বাড়তে থাকবে।
• স্তন কিছুটা দৃশ্যমান হতে শুরু করবে।
• প্রথম পিরিয়ডের ৬-১২ মাস আগে থেকে মেয়েশিশুদের যৌনাঙ্গ দিয়ে অল্প অল্প তরল নির্গমন হবে।
এই তিনটি লক্ষণ প্রথম পিরিয়ডের ৬-১২ মাস আগে প্রায় সব মেয়েশিশুদের মাঝে দেখা যায়। মানে এই তিনটা লক্ষণ দেখা দিলে আপনি ধীরে আপনার কন্যা সন্তানকে পিরিয়ডের জন্য প্রস্তুত করতে পারবেন।
কীভাবে প্রস্তুত করবেন?
এই লক্ষণগুলো দেখা দেওয়ার পর থেকে ধাপে ধাপে আপনার কন্যা সন্তানকে তার জীবনের প্রথম পিরিয়ডের জন্য প্রস্তুত করতে হবে।
১। শুরুতে নিজের চিন্তাকে সমৃদ্ধ করুন
আমাদের দেশে শত শত বছর ধরে আমরা এই বিষয়টাকে ট্যাবু বানিয়ে রেখে দিয়েছি। কিন্তু এটি একটা স্বাভাবিক শরীর বৃত্তিয় প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিটা নারীকেই যেতে পারে। সেজন্য শুরুতেই এটাকে স্বাভাবিকভাবে নেয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। আপনার নিজের এই সময়টাকে কল্পনা করতে পারেন। আপনি পরিবারের পক্ষ থেকে কেমন সমর্থন পেয়েছেন এই সময়ে? সেই সমর্থনটা আপনাকে কতটা নির্ভার ও সাহায্য করতে পেরেছে? সেটিই আপনার সন্তানের জন্য উপযুক্ত কী না? নাকি আপনি আরো ভালোভাবে আপনার সন্তানকে এই সময়ে সমর্থন দিতে চান! এই ভাবনাগুলোর জায়গায় আগে নিজেকে পরিষ্কার করুন।
২। পিরিয়ডের সাধারণ বিষয়গুলো তার সাথে আলোচনা করুন
শুরুতেই তাকে তার বয়ঃসন্ধিকাল সম্পর্কে অবগত করুন। এরপর পিরিয়ড নিয়ে একটা ধারণা দিন। পিরিয়ড কী? কেন হয়? এই সময়ে সে কেমন অনুভূতির মধ্য দিয়ে যায়? তার শরীরে কী কী পরিবর্তন আসতে পারে? বিশেষ করে ব্লিডিংয়ের কথা আগে থেকে জানিয়ে রাখুন। যাতে হুট করে ব্লিডিং শুরু হলে সে যেন আতঙ্কিত ও শঙ্কিত হয়ে না পড়ে। এইটা যে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কোন বিষয় না, খুবই স্বাভাবিক ও সহজ একটা বিষয় তা তাকে আগে থেকেই জানিয়ে রাখুন। সাধারণত বাংলাদেশে সব পরিবারেই এই বিষয়গুলো পরিবারের কোন নারীরাই দেখে থাকেন। তাই বলে পুরুষদের এইসব বিষয় নিয়ে জানতে হবে না এমন কোন কথা নেই। বাবাদের/ভাইয়েদের সচেতন হওয়াও এই সময়ে অনেক জরুরী। সচেতন হোন, একটু পড়ালেখা করে এই বিষয়ে বিস্তারিত জেনে রাখুন। এরপর প্রয়োজন হলে আপনার সন্তানের সাথে কথা বলুন। মনে রাখবেন পরিবারের সবাই এই বিষয় নিয়ে তার সাথে যতটা আলোচনা করবেন সে ততটা সহজ হবে, ভরসা পাবে।
৩। নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন
আপনার প্রথম পিরিয়ডের সময়টা কেমন ছিলো? আপনার অভিজ্ঞতা কেমন ছিলো? এইসব আপনার সন্তানের সাথে শেয়ার করুন। তাহলে সে আরো কিছুটা সহজ হবে। নিজের প্রথম পিরিয়ডের মজার কোন ঘটনা থাকলে তাও মজায় মজায় শেয়ার করুন। বিষয়টাকে একদম সিরিয়াস মুডে না নিয়ে মজার অভিজ্ঞতা শেয়ার করলে এটা অনেক সহজ হয়ে যাবে।
৪। দায়িত্বশীল ব্যাক্তি ঠিক করে রাখা
পিরিয়ড যে কোন সময় হতে পারে। শুধু বাসায় থাকাকালীনই হবে বিষয়টা এমন না। বাসার বাইরে, স্কুলে, কোন স্কুল ট্রিপে, যে কোথাও, যে কোন সময় প্রথম পিরিয়ড হতে পারে। সেক্ষেত্রে কন্যা সন্তানকে জানিয়ে রাখুন এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার সাথে সাথে সে প্রথমে কার কাছে যাবে! স্কুলে হলে স্কুলের কোন ম্যামকে আগে থেকে জানিয়ে রাখুন ও আপনার সন্তানকেও জানিয়ে রাখুন স্কুলের ম্যামের কথা। সোজা কথা তাকে কিছু মানুষের সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা দিয়ে রাখা, সে যেন কোনভাবেই আতঙ্কিত না হয়ে তাদের কাছে গিয়ে বিষয়টা অবহিত করে।
৫। পিরিয়ড কিট তৈরি করতে পারেন
স্কুলের ব্যাগে কিংবা আলাদা কোন ছোট ব্যাগে পিরিয়ডের সময়ের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে একটা কিট তৈরি করতে পারেন। বাইরে কোথাও গেলে কয়টি প্যাড লাগতে পারে সে হিসেব করে প্যাড রেখে দিন। অতিরিক্ত প্যাড, আন্ডারওয্যার ইত্যাদি রাখতে পারেন। বেশি পেইনের জন্য পেইন কিলারও রাখা যেতে পারে। পিরিয়ডের সময়গুলোতে কিটে তার পছন্দের কিছু খাবারও রাখতে পারেন অল্প করে। আলাদা করে কিট তৈরি করতে সমস্যা হলে, স্কুল ব্যাগেও রাখতে পারেন এইসব।
৬। পারসোনাল হাইজেন সম্পর্কে সচেতন করুন
পিরিয়ডের সময় হাইজেন সম্পর্কে সচেতন থাকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সচেতনার কারণে জরায়ুতে ক্যান্সারসহ অনেক ভয়াবহ সমস্যা হতে পারে। সেজন্য এই সময়ে হাইজেন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ৫-৬ ঘন্টা পর প্যাড চেঞ্জ করা, পিরিয়ডের সময় প্রতিদিন ভালোভাবে গোসল করা ইত্যাদি অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচাবে। স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে একদম ভালোভাবে কথা বলতে হবে এই সময়ে। পশ্চিমের আধুনিক সমাজেও ২১ বছর পর্যন্ত মেয়েরা পিরিয়ডের সময় দোকানে গিয়ে স্যানেটারি প্যাড চাইতে দ্বিধাবোধ করে। প্যাড চেঞ্জ করার জন্য কারো সাহায্য নিতে দ্বিধাবোধ করে। সুতরা আলোচনার মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি করাটা অনেক বেশি জরুরী।
৭। আতঙ্কিত হওয়ার মতো তথ্য শেয়ার করবেন না
পিরিয়ডের সাথে মুড সুইং, বিষণ্ণতা, হতাশা, মানসিক বিষাদ, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া এমন কিছু জড়িয়ে আছে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, প্রথম পিরিয়ডে এইসব বোঝার মতো পরিণত আপনার সন্তান হয়না। তখন তার কাছে ব্লিডিং আর তলপেটে ব্যাথাই দৃশ্যমান। তাকে শুধু এই দুটো সম্পর্কে জানিয়ে রাখুন। যেগুলো তার বয়সের সাথে সম্পর্কিত না সেগুলো জানালে তার আতঙ্কই বাড়বে। তবে হ্যাঁ একটু পরিণত হওয়ার সাথে সাথে আপনি তাকে এই বিষয়গুলোও জানাতে পারেন।
৮। পিরিয়ড উদযাপন করুন
নোয়াখালীতে একটা ট্রেডিশন আছে, অন্য এলাকাতে আছে কী না জানা নাই! সেখানে কোন মেয়ের প্রথম পিরিয়ড হলে বাড়িয়ে খিঁচুড়ি বা পায়েশ রান্না করে। মেয়ের আত্মিয়-স্বজনরা মেয়ের জন্য জামা কাপড় দেয়।
পিরিয়ড আপনার সন্তানের জন্যও একটা মাইলফলক। পিরিয়ড প্রমাণ করে আপনার কন্যা সন্তানটি বড় হচ্ছে, ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে। এই বিষটা উদযাপন করুন। প্রথম পিরিয়ড হলে ঘরোয়াভাবে ছোট করে কিছু আয়োজন করুন। পারিবারিক আবহে স্পেশাল খাবার দাবারের আয়োজন হতে পারে, তাকে নতুন জামা দিতে পারেন, পরিবারের সবাই মিলে বাইরে কোথাও খেতে যেতে পারেন, কিংবা কাছে কোথাও থেকে ঘুরেও আসতে পারেন। মানে, ঘরোয়াভাবে আপনার সন্তানের জন্মদিন যেভাবে পালন করতেন সেভাবে এই দিনটিকে উসযাপন করতে পারেন। এত তার কাছে পিরিয়ড আতঙ্কের না হয়ে সহজ, স্বাভাবিক ও ভালোলাগার বিষয়ে পরিণত হবে।

Related Posts