কেশ সংস্কৃতি

বাংলা ভাষায় চুলের কয়েকটি প্রতিশব্দ আছে। যেমন কেশ, চিকুর, কুন্তল, অলক ইত্যাদি। তবে আটপৌরে আলাপ-আলোচনার ‘চুল শব্দের ব্যবহারই বেশি। কেশ, চিকুর, কুন্তল, অলক প্রভৃতি শব্দ আলাপ-আলোচনার ব্যবহার হয় না, গল্পে, উপন্যাসের আর কবিতায়ই এসব শব্দের ব্যবহার হয়ে থাকে। কাব্যিক ভঙ্গিতে যারা ডায়লগ ছুঁড়েন বা ভালবাসার পত্র লেখেন, তারা চুলের প্রতিশব্দগুলো ব্যবহার করেন। চুলের প্রতিশব্দগুলোর প্রায় সবই নারীর চুল সম্বোধনে, নারীর দখলে।

চুল আছে, পুরুষের মাথায়, চুল আছে নারীর মাথায়। যদি প্রশ্ন করা হয়, কার দেহে সবচেয়ে বেশি চুল, পুরুষের না নারীর? তাহলে যেকোনো মানুষ  উত্তরে বলবেন, পুরুষের দেহে চুল বেশি। চেহারার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে চুল। মাথায় চুলবিহীন পুরুষের চেহারা খুব একটা বেমানান হয় না, কিন্তু চুলবিহীন মাথার নারীর চেহারা বড্ড বেমানান। পুরুষ-দেহের মাথা থেকে পায়ের গোড়ালি, এমন কি এর নীচ পর্যন্তও চুল বিভিন্ন নামে পরিবৃত থাকা সত্ত্বেও পুরুষের চুল নিয়ে গল্পে, উপন্যাসে বা কাব্যে কোনো আলোচনা হয় না, যত আলোচনা সবই হয় নারীর চুল নিয়ে। অথচ পুরুষের চুল নিয়ে আলোচনা তো বেশি হওয়া উচিত ছিল। পুরুষের মাথায় চুল, ভ্রুতে চুল, মুখে চুল (দাড়ি গোঁফ), বুকে চুল অর্থাৎ সর্বাঙ্গে চুল। বুকের আর মুখের চুল তো পুরুষের এক চেটিয়া। তবুও পুরুষরা নিজেদের চুল নিয়ে কোন কাব্য করে না, কোন আলোচনা করে না, নারীর চুল নিয়ে পুরুষরাই কবিতা লেখে, যেখানে যে প্রতিশব্দ প্রয়োগ করা যায়, সেই প্রতিশব্দ দিয়ে নারীর চুলের বর্ণনা দেয়। নজরুল সাহিত্যে কেশ, রবীন্দ্র সাহিত্যে কেশ, মধুসূধনের সাহিত্যে কেশ অর্থাৎ নারীর কেশ আজ বারবার আলোচিত। প্রশ্ন হচ্ছে, পুরুষরা সারা অঙ্গের সর্বত্র এত চুলের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেন সর্বস্বত্ব ত্যাগ করে নারীকে এই স্বত্ব ভোগের একচ্ছত্র অধিকার দেয়া হলো? এর উত্তর হতে পারে, এই পুরুষরা নারীকে সুন্দর দেখতে চায়, তাই কসমেটিক্সের প্রায় সবই নারীদের জন্য তৈরি হয়। ল্যাটিন শব্দ কসমস থেকে কসমেটিক্সের উদ্ভব।

হ্যাঁ, নারী মুখমন্ডল যদি পুরুষের মত দাঁড়ি-গোঁফ  জন্ম নিত, তাহলে চেহারা-বিলাসের জন্য নারীর ড্রেসিং টেবিলের ব্যবহার আর কসমেটিক্সের বাহারী ব্যবহারেরও প্রয়োজন হতো না। তাদের মুখমন্ডল দাঁড়ি-গোফ থেকে মুক্ত থাকার কারণে নারীদের সকল মনোযোগ মাথার কেশদামের রকমারি বিন্যাস এবং বিলাসিতার ওপর নিবদ্ধ। চোখের উপরে যে ভ্রু, তাই রাখেন না অনেক নারী, ব্লেড দিয়ে সাফ করে দেন ভ্রু অথবা উপড়িয়েও ফেলেন। তাদের দাঁড়ি-গোঁফ থাকলে কি যে করতেন, তা আল্লাই ভালো জানেন। এ জন্য বোধহয় বিধাতা তাদের দাঁড়ি-গোঁফই দেননি।

বিশ্বে কয়েক কোটি পুরুষ আছে, যারা নারীর নারীর মাথার চুলের সেবায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়োজিত। তারা নারীর কেশদাম বিন্যাসের মাল-মসলা ও উপকরণাদি তৈরিতে, সংগ্রহে, জোগানে, সরবরাহে, বিপণনে সর্বদা ব্যস্ত রয়েছে। শিল্প-কারখানা এ জন্যে গড়ে তুলেছেন, বিভিন্ন উপকরণে তৈরি করেছেন, আবিষ্কারে ব্যস্ত রয়েছে।

পুরুষরা নিজেদের মাথার চুলে প্রায়ই যত্নবান নন। যে সব পুরুষ নিজেদের মাথায় চুলের ব্যাপারে কিছুটা যত্নবান, তারাও ড্রেসিং টেবিলের সামনে মাত্র এক বা দু’মিনিট দাঁড়িয়ে চিরুনী ব্যবহার করেন, কেউবা আয়নার সামনে দাঁড়াবার প্রয়োজনও বোধ করেন না। কেউ মাথার তেল দেন, কেউ দেন না। কিন্তু নারীরা নিজেদের চুলের ব্যাপারে মোটেই উদাসীন নন। দিনে কয়েকবার না হলে দু’একবার তো তারা আয়নার সামনে বসে অবশ্যই চেহারা দেখেন, চুলের যত্ন নেন, বিন্যাস করেন। মেয়েদের সুবাসযুক্ত তেল শত শত ব্রান্ডের। কেশ বিন্যাসে যারা সুবাসিত তেলের প্রয়োজন বোধ করেন, তারা পছন্দ মত কোন না কোন ব্রান্ডের তেল ব্যবহার করেন। তাদের আকৃষ্ট করার জন্য তেলের নামও রাখা হয় নারী ঘেঁষা। যেমন-লক্ষ্মী বিলাস, হিমকবরী, কুন্তল কুসুম ইত্যাদি।

প্রথমে পুরুষের মাথায় চুলের ব্যাপারে কিঞ্চিত আলোচনা করা যাক। যদিও পুরুষের আপাদমস্তক বিভিন্ন নামে চুলে ভর্তি, কোনো কোনো পুরুষের পিঠে পর্যন্ত চুল, বাদ শুধু হাত ও পায়ের তালু, কিন্তু পুরুষরা চুলের রকমারি আলোচনা থেকে বঞ্চিত। তবে পৃথিবীর সকল পুরুষ চুলকে যে উপেক্ষা করেন, এ কথা বলা যাবে না।

<

ইউরোপ, আমেরিকা, বৃটেন, জাপান এবং শিল্পোন্নত দেশের নারীরা তাদের মাথায় চুল নিয়ে প্রাচ্য দেশের ললনাদের মত চুল বিলাসিতা প্রায়ই করেন না। সে সব দেশের নারীদের মাথায় যত লম্বা চুল দেখা যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি দেখা যায় সব কাটিং চুল। তাই রকমারি খোঁপার ঝামেলা তাদের করতে  হয় না। জাপানেও লম্বা চুলের মহিলা খুবই কম দেখা যায়। সে সব দেশের নারীদের অধিকাংশের মাথায় খাটো চুল থাকার কারণে কেশ ফ্যাশনে তারা খুব বেশি আগ্রহী নন। একারণে তাদের মাথায় চুল তাদের সাহিত্যে কাব্যে খুব বেশি আলোচিত নয়। শুধু সোনালী বর্ষণের চুলের প্রতি কবি-সাহিত্যিকদের পছন্দের পাল্লা ভারী দেখা যায়। চুল নিয়ে যত বিলাসিতা, ফ্যাশনে আর সাজসজ্জা প্রায় সবই এই উপমহাদেশের নারীরাই করে থাকেন। বাংলাদেশী মেয়েদের কথাই এখানে আলোচনা করি, বাংলাদেশে মেয়েদের শতকরা প্রায় ৯৮ ভাগের মাথায় লম্বা চুল। এ জন্য চুল-ফ্যাশনের প্রতি তার বেশি আগ্রহী। চুল দিয়ে খোঁপা বাধার রেওয়াজ আজকাল আধুনিক পরিবারের মেয়েদের মধ্যে বেশ হ্রাস পাচ্ছে, তবুও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে দেখা যায় খোঁপাওয়ালী মেয়ে আর মহিলা বেশি। নানা জাতের খোঁপা, যেমন বিড়া খোঁপা, তারা খোঁপা, রিং খোঁপা, বেলী খোঁপা, চম্পাকলি খোঁপা, বিনুনী খোঁপা ইত্যাদি। মহিলারাও সেলুনে গিয়ে চুল কাটন। আত্মীয় বাড়ী, বান্ধবীর বাড়ি, সামাজিক যে কোন অনুষ্ঠানে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করলে অনেকেকে চট করে চলে যান পার্লারে। সেখানে গিয়ে ইউসেপ, বয়কাট, ব্যাক কম্বিং চুলের কাটিং করেন। পনি স্টাইল কেশ বিন্যাসও করে থাকেন। এ পর্যন্ত কেশ বিন্যাসের বত্রিশ ধরনের স্টাইল প্রচলিত। ভবিষ্যতে এ সংখ্যা কততে গিয়ে দাঁড়াবে, তা জানি না। যার যে স্টাইল প্রচলিত। ভবিষ্যতে এ সংখ্যা কততে গিয়ে দাঁড়াবে, তা জানি না। যার যে স্টাইল ভাল লাগে সেই স্টাইলে চুলের বিন্যাস করা হয়। খোঁপার স্টাইলই হরেক রকমের। আগে কিছু উল্লেখ করেছি, এবার বঙ্গীয় কায়দায় বলছি, অশ্বলেজী খোঁপা, মোরগ পুচ্ছ খোঁপা, ময়ূরীর পেখম তোলা খোঁপা, চুলের বিনুনী দিয়ে জোড়া খোঁপা, বেণী খোঁপা, মাথার তালুতে উটের পিঠের মত চুড়া খোঁপা, মাথার পিছনে টাইট খোঁপা, হেলিয়ে পড়া খোঁপা। দিনে যে সব মহিলার হাজার দু’হাজার টাকা আয়, তারা ঘর থেকে বের হয়ে পার্লারে প্রবেশ করেন। পার্লার থেকে খোঁপা করে নানা গন্তব্যের পথ ধরেন। নানা মনজিলে যান। তারা বিভিন্ন ধরনের খোঁপা করেন, যখন যেটা পছন্দ হয় সেটা করেন। ধরুন আজ নিলে চুড়া খোঁপা, কাল নেবেন অশ্বলেজী খোঁপা, অন্যদিন নেবেন চম্পাকলি খোঁপা।

আমি এতক্ষণ যে সব মহিলার মাথায় চুল ফ্যাশন নিয়ে আলোচনা করলাম, সে সব মহিলা আওয়ারা, বেপর্দা, ফ্যাশন আর দশের নজরে চেহারা প্রদর্শনকারী মহিলার কথা বললাম। মেয়েরা সাজবে, চেহারাকে সুন্দর করবে, নানা সুবাসে সুবাসিত হবে, নিজের চেহারা এবং দেহকে আকর্ষণীয়ভঅবে সাজিয়ে তুলবে, কিন্তু বাজারেক বিকিকিনির জন্য নয়, দশজনের নজর কাড়ার জন্য নয়, অশ্লীল মন্তব্য শোনার জন্য নয়, সব হতে হবে শুধু নজর কাড়ার জন্য নয়, অশ্লীল মন্তব্য  শোনার জন্য নয়, সব হতে হবে শুধু নিজের স্বামীর জন্য। ইসলাম নারীদের সব রকমের সাজসজ্জার অনুমতি দিয়েছে কিন্তু একটি বাধা দিয়ে রেখেছে স্বামীকে সামনে দাঁড় করিয়ে। এ সীমা কোন মুসলিম মহিলা লংঘন করতে পারবে না। সীমালংঘন করলে মহিলাটি নিজের রূপ ও দেহকে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে দশের হাপিত্যেস লোভের খোরাকে পরিণত হবে। শুধু দেহ বিকিনি করলেই যে বেশ্যা বা পতিতা হয়, তা নয়। রূপ- সৌন্দর্যকে অন্যের উপভোগে নিলেও পরোক্ষভাবে পতিতালয় শুমার হয়। নেংটা হয়ে যে নারী নৃত্য করে, তার দেহকে দর্শক সরাসরি ভোগ করতে পারে না। তবে তার দিগম্বর দেহখানা যৌন লালসার দ্বারা যে ভোগ করা হয়, তাতো অস্বীকার করা যাবে না। কাপড় পরেও যুবতী চেহারাকে নানা সাজে সাজিয়ে তোলে হাস্যে-লাস্যে চলাচলে, নানা ছন্দে নানা ভঙ্গি করে, পর পুরুষের সঙ্গে কথা বলে, তাদেরও কেউ সরাসরি ভোগ করতে পারে না (দুর্ঘটনা ব্যতিক্রম) কিন্তু এই মহিলা দেহ ছাড়া আরতো সবই দিল, স্বামীর জন্য রাখলো কি? এ ধরনের মহিলাও পতিতা। অভিনয় করতে গিয়ে পর পুরুষের কোলে বসে, বাহুডোরে আবদ্ধ হয়, বুকে জড়িয়ে ধরে, এমন মহিলারাও স্বামীর জন্য আর কি বাকি রাখলো? যা বাকি রাখলো বলে মনে করেন, তাও হয়তো বাসায় ফেরার আগে নায়ককে দিয়েও আসতে পারে। বলতে পারে, সবই যখন দিলাম, তখন এটাও তুমি নাও। শত শত ঘটনা এভাবেই ঘটেছে।

কেশ বিন্যাস নারীর অধিকার, কেশ ফ্যাশন সে অধিকারের অন্তর্ভূক্ত। যে কোন স্টাইলে সে সাজতে পারে, যে কোন স্টাইলে চুলে ফ্যাশন করতে পারে, যে কোন খোঁপা সে বাঁধতে পারে, কিন্তু সবই হবে স্বামীর ভোগের সীমানার মধ্যে। এ সীমানা যে লংঘন করবে, সম্ভ্রমের পবিত্রতা সে হারাবে, আর তা হারালে এ মহিলা আর পবিত্র থাকে না। তখন পতিতা আর তার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য থাকে না।

Related Posts