ছোট গল্পঃ আমার সুখী সাইকেল, নাইফা আফরিন অহনা

আমার সুখী সাইকেল 

নাইফা আফরিন অহনা

——————————

বেশ কিছুদিন ধরেই  সাইকেল শিখার শখ। কিন্তু সাইকেল নেই।  অনেক কষ্টে রিকোয়েস্ট করে একটা সাইকেল কিনলাম।  আব্বুর মতে এটা হলো ফালতু খরচ।  আমি মোটেও সাইকেল শিখব না, এমনি পিনিকে কিনতিসি। অনেক চোখের পানি, নাকের পানি গড়ানোর পর একটা সাইকেল কিনে দিল আমাকে আব্বু।  যাকগে, সাইকেল টা পেয়ে আমার মনে হলো এই বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মানুষ নির্বাচন করা হলে, মানুষ টা আমি ই হবো। আর কেনই বা হবো না? অনেক দিনের শখ, অনেক দিনের ইচ্ছা পূরণ হলো।

খুব আয়োজন করেই আমি সাইকেল টাকে ঘরে আনালাম।  রাস্তায় বহু মানুষ বহু কথা বলল।  কেউ বলল অনেক সুন্দর  সাইকেল, কেউ বলল দেখতে পুরান পুরান লাগে, কেউ বলল দাম এর তুলনায় সাইকেল টা একদম ভালো হয় নি।  কিন্তু আব্বু সবার উত্তরে একটা কথা বলল।  এটা ই আমাদের জন্য ছিল, তাই এটা ই কেনা হলো এতো গুলোর মধ্যে।  তার উপর আমার মেয়ে খুশি।

আসলেই আমি হলাম দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মেয়ে।  কিন্তু সুখ টা স্থায়ী হলো না। সমস্যা পড়ে গেলাম, “নতুন সাইকেল কই রাখব?”
যেখানে সেখানে রাখলে তো চুরি হওয়ার সম্ভবনা বেশি।   অযত্নে রাখা যাবে না। এটা তে হেল্প করল বাড়িআলা আংকেল আস্ত একটা গ্যারেজ এর বিশাল চকচকে, ঝকঝকে জায়গা আমার সাইকেল এর জন্য বরাদ্দ হলো।  এই তো বেস চিন্তা খতম।  আমার সাইকেল সেভ তো আমি ও খুশি।  সাইকেল চালাতে পারি না তো কি হলো?  শিখে নিব।  আজ দিব্যি আরামের ঘুম দেব।  কাল থেকে কোমড় বেঁধে সাইকেল চালানো শিখব।  ইচ্ছা পূরণের ডায়েরিতে ঘুমানোর আগে লিখে দিলাম,
” সাইকেল কেনার ইচ্ছা পূর্ণ হলো।”

পরদিন সকালে এক দৌড়ে সাইকেল এর কাছে ছুটলাম।  বিশাল পরিষ্কার, চকচকে জায়গায় আমার সাইকেল টা রাজার মতো মাথা উঁচু  করে দাঁড়িয়ে আছে। যে কেউ দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখলে বলবে, “আহা কত সুখী সাইকেল।”

আজ আমার প্রথম দিন সুখী সাইকেল এ বসে সুখবিলাস করার।  এজন্য আমি ও খুশি।  যাক প্রথম দিন সুখী সাইকেল কে নিয়ে অনেক চালানোর চেষ্টা করলাম আমি। একা একা চেষ্টা করলাম।  সাইকেল টা কয়েক জায়গায় পড়ে গেল।  কাঁদায় পড়ল, পানিতে পড়ল, বালিতে পড়ল,শক্ত রাস্তায় পড়ল তবুও সুখী সাইকেল সুখী ই ছিল।  আজকে ও সুখী সাইকেল চালানো শিখা হলো না।  রাজকীয় পরিষ্কার রাজ প্রাসাদের মতো গ্যারেজ এ আমার সুখী ময়লা সাইকেল টা দাঁড়িয়ে আছে।  ময়লা হওয়া স্বত্তেও তাকে সুখী লাগছে।

এভাবে একা একা অনেকদিন ধরে চেষ্টা করলাম সুখী সাইকেল চালানোর।  চেষ্টায় চেষ্টায় একটু শিখতে পারলাম।  কিন্তু সাইকেল টা হয়ে গেল বেহাল।  একটা চাকা কেমন দিনকে দিন নুইয়ে আসছে।  অনেক দিন থেকেই লক্ষ করছিলাম ব্যাপার টা কিন্তু আমি সেভাবে ধ্যান দেই নি।  ফল সরূপ একদিন পুরা চাকাটাই নুইয়ে গেল।  আর সামনের চাকা পুরা সাইকেল এর ভার বহন করতে করতে নিজেও কেমন বুড়ো হয়ে গেল।  অনেকদিন পর রাজকীয় গ্যারেজটাতে আমার সুখী সাইকেল কে কাছ থেকে দেখলাম তো মনে হলো, “আমার সাইকেল আর সুখী নেই। পরিচর্যা, যত্ন,ভালোবাসার অভাবে কেমন জিন্দা লাশ হয়ে গেল সুখী সাইকেল আমার।”

দেখেই বুকের বাঁ পাশ পিনপিন করে ব্যথা করল।  চোখ উপচে আমার পানি বের হচ্ছিল।  কান্না করতে করতে এক দৌড়ে বাবা – মা এর কাছে গেলাম। আমাকে কাঁদতে দেখে পিছে পিছে আমাদের বাড়ি আলা আংকেল ও চলে আসল।  সব ঘটনা শুনে বাড়িআলা আংকেল সহ বাসার সবাই মিটিং বসাল।  মিটিং মা ছিল সবচেয়ে বিরক্ত ।  তার সিদ্ধান্ত একটাই সাইকেল বেচে দিতে বা ফেলে দিতে। চলে না এটাকে নিয়ে কথা বলে কি হবে? কিন্তু বাবা আর বাড়িআলা আংকেল মিলে সিদ্ধান্ত নিল, তারা দুজন মিলে সাইকেল কে ঠিক করার চেষ্টা করবে।  তাদের কথা শুনেই আমি আশার আলো দেখতে পেলাম।  সাথে সাথে আমি বললাম,
“আমিও আপনাদের সাথে কাজ করব। ”

তারা দুজন ও রাজি হলো। বেশ তো এখন শুরু হলো অসুখী সাইকেল কে সুখী করার চেষ্টা।  বাবা আংকেল মিলে এর সব পার্ট খুটিয়ে খুটিয়ে দেখল।  তারপর কাজ শুরু হলো। এই ঠিক করার কাজে কিছুদিন এমনও ছিল আমার আর ভাল লাগত না ঠিক করতে।  কিন্তু তবুও মন প্রাণ লাগানোর চেষ্টা করতাম।  কিছু দিন সাইকেল এর চাকা গুলো নিজেরাও পরস্পরের সাথে অভিমান করে বসে আছে যে কোনো মতেই তারা সুখী হতে চায় না।  একজন ঠিক হতে চাইলে আরেকজন হয় না। কিন্তু বাবা ও তো হাল ছাড়ার মানুষ নয়। সাথে আবার বাড়িআলা আংকেল ও আছেন দুজন মিলে চেষ্টা জুড়েই দিচ্ছে ।  প্রায় কয়েকদিন পর আমার অসুখী সাইকেল এর জান ফিরে এল। তবে তার একটা চাকা পুরা নুইয়ে ছিল, আরেকটা চাকা আধা নুইয়ে ছিল। পাম/বাতাস দিতে হবে। দায়িত্ব নিলাম আমি।  কিন্তু আমি প্রথম চেষ্টায় পাম দিতে পারলাম না। এর পর আবার চেষ্টা করলাম,না পারায় হাল ছাড়তে চাইলে মা বাবা এসে আমাকে সহ বসে বসে চাকায় পাম দিয়ে দিল।  কিছু সময়ের মধ্যে দেখা গেল,আমার সেই প্রথম দিনের সুখী সাইকেল তার নিজের রূপে ফিরে এলো। এখন আবার সে মাথা উঁচু করে তার রাজ প্রসাদে দাঁড়িয়ে আছে।

এবার বাবা আমাকে সাইকেল চালানো শিখাবে। আমরা যেই সুখী সাইকেল নিয়ে বের হলাম, রাস্তায় সবাই অবাক হয়ে গেল।  কারণ সুখী সাইকেল চকচক করছে প্রথমদিনের থেকেও বেশি চকচক। চাকা ঘুরলে মনে হচ্ছে চাকা দুটি হাসি ঠাট্টায় মেতে আছে।  আহা কি সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে।

এরপর আর কি? একদিন বাবা, একদিন মা, একদিন কাজিন, একদিন বন্ধু রা সবাই মিলে আমাকে সাইকেল চালানো শিখাল।  কোনদিন আমি পড়ে গেলে বাবা মা দুজন মিলে আমাকে সামলালো, সুখী সাইকেল কে ও সামলালো।  শেষ মেশ আমি সাইকেল চালানো শিখেই গেলাম। তবে এখন আমি,বাবা,মা টাইম টু টাইম পরিচর্যা করি।  চাকার বাতাস শেষ হওয়ার আগেই বাতাস ভরে দিই। আমার সুখী সাইকেল এখন আর এক মূহুর্ত ও দুঃখী হয় না। উল্টো দিনকে দিন সে সুখী ই হচ্ছে ।  দিনকে দিন তার খুশীর ঝলক চারপাশের সবকিছু খুশি তে রাঙিয়ে দেয়। এতে সবচেয়ে বেশি অবদান হলো আমার সাইকেল এর চাকা গুলোর।  কারণ তারা অভিমান করে বসে না থেকে পরস্পরকে বোঝার চেষ্টা করে।  দুজন মিলে সাইকেল আর আমার ভর বহন করে।  পুরাপুরি নুইয়ে যাওয়ার আগে আমাদের খবর দেয়। আমরা তাদের আবার জীবন্ত করে দি। দরকার একটু যত্ন, পরিচর্যা, আদর আর অনেক গুলি ভালোবাসার।

(সমাপ্তি)

[বিঃদ্রঃ সাইকেল এর চাকা গুলোকে আপনি কয়েকভাবেই দেখতে পারেন। স্বামী -স্ত্রী, সন্তান -বাবা মা, শ্বশুর -শ্বাশুড়ি -বউ/জামাই, আপনি-আপনার বন্ধুগণ ইত্যাদি।  সব সম্পর্কে  নতুন নতুন যেমন থাকে সবসময় তেমন থাকবে না।  কিন্তু আপনি সেটা কে নতুন থেকে নতুনে পরিণত করতে পারবেন সঠিক পরিচর্যা, ভালোবাসা, যত্ন আর আপন মানুষ এর সাপোর্ট এর মাধ্যমে। আবার শুধু একজনের উপর সম্পর্কের সব ভার দিলেও ভাঙন ধরবেই। দুজনকে রেললাইনের মতো সমান্তরালে ভার ভাগাভাগি করে নিতে হবে। তবেই সম্পর্কটা অসুখী সাইকেল টার মতো লাশ হবে না। আর প্রথম দুঃখে ভাঙনের চিন্তা করলে চলবে না, বাবা আর চাচা র মতো পরিচর্যার চিন্তা করতে হবে। ❤]

 

Related Posts

9 Comments

মন্তব্য করুন