জীবন প্রদীপ ফিরে পেলাম (জীবনের গল্প)

আমি একজন প্রবাসী। তিন বছর যাবৎ ইতালি এসেছি।দেশের বাড়িতে বাবা মা, স্ত্রী এবং এক পুত্র থাকে। তাদের মুখে হাসি রাখার জন্য, দিন রাত মাথার ঘাম পায়ে ফেলছি। বাবা-মার একমাত্র সন্তান আমি। তারা অনেক কষ্ট করে আমাকে মানুষ করেছে।

মাঠে বিশ শতক জমি ছিল তা বিক্রি করে আমি বিদেশ এসেছি। বাবা এক বছর যাবৎ অসুস্থ, কোন কাজ করতে পারেনা। তাই সংসারের দায়-দায়িত্ব আমার উপর। প্রতিমাসে যে টাকা পাঠায় তা দিয়ে সংসার খুব ভালভাবে চলে যায়। বাবার ঔষধ কেনা থেকে শুরু করে ছেলের লেখাপড়া সবকিছু ভাল ভাবেই চলছিল। আল্লাহর রহমতে এতদিন যাবৎ কোন সমস্যা হয়নি।

কিন্তু আজ আমার জীবনে নেমে এসেছে তিমির রাত। যে রাতে পথ চলতে এ পথিক দিশেহারা হয়ে পড়েছে। জীবনটা হঠাৎ করেই থেমে গেছে। বৈদ্যুতিক পাখা যে ভাবে থমে যায় বিদ্যুৎ চলে গেলে। আজ আমি বড় অসহায়- কেননা একমাস যাবৎ কোন কাজ করতে পারিনা। কাজ করতে যাওয়াত দূরের কথা বাসা থেকে বের হয়ে হওয়া নিষেদ।কাজ করতে না পারায় কোন রকমে একবেলা রুটি খেয়ে বেঁচে আছি।

আমার কথা নাই বাদ দিলাম। টাকা পাঠানের অপেক্ষায় যারা বসে আছে তাদের কথা ভেবেই আমি অস্থির হয়ে যাচ্ছি।যদি টাকা না দেই বাবার ঔষধ কিনবে কি দিয়ে, কি দিয়েই বা বাজার করবে। এগুলো ভাবতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছি।

আর এই সবকিছু হচ্ছে এক অদৃশ্য ভাইরাসের জন্য। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছে করোনা ভাইরাস। একমাস পর মুখে মাক্স এবং হাতে গ্লাপস পড়ে, কিছু সময়ের জন্য চেনা শহরটি দেখতে বের হলাম। হায়! এ কি? চেনা শহরটি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।মনে হচ্ছে কোন এক অচেনা শহরে দাঁড়িয়ে আছি।নেই কোথায় কোন মানুষ, না আছে কোন গাড়ি।

যে দিকে তাকাই শুধু হাহাকার। যেখানে একমাস আগেও, এ পথ দিয়ে হাঁটতে গেলে শতশত মানুষের ধাক্কা খেতে হত।আর মার্কেট গুলোতে বাসা বেঁদেছে শতশত মাকর্সা। দেখে মনে হচ্ছে এটা মাকর্সার মার্কেট। সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বাপ্ন দেখছি, কিন্তু না আমিত জেগেই আছি।আর দাঁড়িয়ে আছি কঠিন বাস্তবের মধ্যে।

<

আমরা একরুমে পাঁচজন থাকি, গতমাসে একজন দেশে ফিরে গেছে।এখন চারজন আছি।ওদের না বলেই আমি বাহিরে এসেছি। বাসায় ফিরে দেখি ওরা কেউ বাসায় নেই। পাশের বাসার মেহেদীর কাছ থেকে জানতে পারলাম, গতমাসে যে বন্ধু দেশে ফিরেছে তার নাকি করোনা ভাইরাস ধরা পড়েছে, এই জন্য বাকি বন্ধুদের পুলিশ এসে নিয়ে গেছে, প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারান্টাইনে রাখার জন্য।আমি রুমে ছিলাম না বিদায় আমাকে নিতে পারেনি। আমার কথা ও শুনেছিল আগামীকাল আবার আসতে চেয়েছে।

এখন রুমে একা বসে আছি, হঠাৎ স্ত্রীর ফোন আসল,রিসিভ করে বললাম কেমন আছ। বলল, জি ভাল আছি। জানতে চাইল আমি কেমন আছি, বললাম ভাল আছি। জিজ্ঞাসা করলাম বাজার সদায়, বাবার ঔষধ কিভাবে কি করছ, টাকাত মনে হয় শেষ, আর এ মাসেত টাকা পাঠাতে পারলাম না।

বলল; তুমি চিন্তা করনা আর ঘর থেকে বের হবেনা, সাবধানে থাকবে শুনেছি ইতালির অবস্থা ভাল না। আমি কানের দুল আর হাড়টা বিক্রি করে বেস কিছু টাকা পেয়েছি তা দিয়ে আমাদের দু তিন মাস চলে যাবে। তুমি আমাদের জন্য এত বেশি চিন্তা করনা, এতবেশি চিন্তা করলে অসুস্থ হয়ে পড়বে।বললাম বিয়ের গয়না বিক্রি করে দিলে।

আমাকে বলল সবকিছু ঠিক হয়ে যাক তারপর এমন গয়না কত কিনা যাবে, ভাল থেকো।কথা গুলো শোনার পর নয়ন দিয়ে বারি ঝড়তে লাগলো। আর নিজেকে বড় অপরাধী মনে হতে লাগল। অসহায় অবস্থায় স্ত্রীকে পাশে পেয়ে নিজেকে বড় ভাগ্যবান মনে হল।

দেখতে দেখতে আজকের দিন চলে গেল। কিন্তু একা একা রুমের মধ্যে কোন ভাবেই রাতটা কাটছিলোনা, অবশেষে রাতটা কেটে গেল। সকাল হলো, ঘড়ির কাটায় এখন দশটা বাজে। বাহির থেকে ভেসে এলো পুলিশের গাড়ির হর্ণ। হর্ণ শুনতেই বুকের ভিতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠল। পুলিশ এসে আমাকেও নিয়ে গেল। এক পুলিশ ভাইয়ের কাছে জিজ্ঞাসা করলাম, গতকাল এখান থেকে যাদের নিয়ে গেছেন, আমাকে কি তাদের কাছে রাখবেন।

বলল জি সেখানেই রাখব তবে আলাদা রুমে।আমাকে নিয়ে একটা রুমে রাখলো কাটতে লাগল বন্ধি জীবন। যদিও খাওয়া দাওয়ার কোন সমস্যা নেই। কিন্তু মানুষ কি আর বন্ধি থাকতে চাই। সেত ছুটতে চাই, ঘুড়তে চাই দেশ থেকে দেশান্তরে। সে সব ভাবলেত আর চলবে না, নিজেকে ভাল রাখতেই এই বন্ধি জীবন।তাই ভেবে,অনেক কষ্ট হলেও আমি নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি।

আজ এক সপ্তাহ শেষ হল আর আমার বন্ধুদের আটদিন। কারণ তাদের একদিন আগে আনা হয়েছে। আমাদের নাকি এভাবে চৌদ্দ দিন থাকতে হবে। তারপর পরীক্ষা করা হবে আমাদের শরীরে ভাইরাস আছে কিনা। একটা ভাল বিষয় হলো রুমে টিভি দেখার ব্যবস্থা ছিল, তাই কিছুটা সময় টিভি দেখে পার হয়ে যেত।

টিভির মাধ্যমে জানতে পারলাম করোনা ভাইরাসের লক্ষণ গুলো। এতদিনত ভালই ছিলাম কিন্তু গত দুই দিন যাবৎ গলার ভিতরটা কেমন যেন ব্যথা করছে,হালকা জ্বর ও আছে শরীরে, তারসাথে ঠান্ডা কাশি। সবকিছু কেমন যেন করোনা ভাইরাসের লক্ষণের সাথে মিলে যাচ্ছে।তাই বুকের মধ্যে একরাশ ভয় এসে জমা হলো।

ইতিমধ্যে নাকি এই ভাইরাসে বিশ্বে এক লক্ষ লোকের প্রাণ গেছে। সে জন্য ভয়টা আরো বেশি লাগছে।বিশ্বে ইতালির অবস্থা আরো বেশি খারাপ।সব মিলে ভয়ে ভয়ে দিন কাটছে। দেখতে দেখতে বন্ধুদের চৌদ্দ দিন কেটে গেল, আজ তাদের ভাইরাস পরীক্ষা করা হবে।আর আমাকে করা হবে কাল।

যথারীতি বন্ধুদের ভাইরাস পরীক্ষা করার জন্য নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে গেল। রেজাল্ট আসবে কাল,বন্ধুরা যার যার রুমে রেজাল্ট জানার অপেক্ষায় বসে আছে,তার সাথে আমিও আমার রুমে শোনার অপেক্ষায় বসে আছি। আজকের দিনটা অপেক্ষা করতে করতে কেটে গেলো,পরের দিনের সূর্য উদয় হলো,চারিদিকে ফর্সা হতে লাগলো, তার সাথে রেজাল্ট জনার আগ্রহটা বেড়ে উঠতে লাগলো।

অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে এক পুলিশ ভাইয়ের মাধ্যমে জানতে পারলাম বন্ধুদের ভাইরাস ধরা পড়েছে। শুনে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। বুকের ভিতরটা ভয়ে জড়জড়ির হয়ে গেল। বুকের মধ্য ভয় লুকানোর মতো আর এত টুকু জায়গা খালি পড়ে নেই। এরই মধ্যে আমার নমুনা সংগ্রহের করার লোক হাজির হয়ে গেল, নমুনা নিয়ে চলে গেল। রুমের মধ্যে একা একা ভয়ে আতঙ্কে সময় কাটতে লাগলো, শান্তনা দেয়ার মতো একটা লোক ও পাশে নেই।

আজকের দিনটাও ভয়ে আতঙ্কে কেটে গেল।পরের দিন আসলো, জানা গেল আমার শরীরেও ভাইরাস ধরা পড়োছে।আমাকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। শরীরটা দিন দিন খারাপ হতে লাগলো। মনে হচ্ছে এই বুঝি জীবন প্রদীপ নিভে গেল।অপর দিকে দেশে থাকা মানুষ গুলোর কথা আজ বারবার মনে পড়ছে। আর ভাবছি আমি যদি চলে যায় ওরা কিভাবে বাঁচবে, আমি ছাড়াত ওদের কেউ নেই। তার সাথে আমার জীবনের মায়া।

বারবার মনে হচ্ছে এই বুঝি চলে গেলাম। অবস্থা দিনদিন আরো খারাপ হতে লাগলো।অবস্থা খারাপ দেখে আমাকে আইস্যলুসনে রাখা হলো ।জীবন ও মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে লাগলাম। অবশেষে আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে পঞ্চম দিনের মাথায়, আমি পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলাম।

জীবন প্রদীপ যেন ফিরে পেলাম। জীবনের সকল অন্ধকার আলোয় ভরে উঠতে লাগলো। এক মাসের মধ্যে সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। আমি এখন অনেক সুখী। তবে দুঃখ একটায় বন্ধুরা কেউ সুস্থ হয়ে উঠেনি সকলে হাসপাতালে মৃত্যু বরণ করেছে। (সমাপ্ত)

Related Posts

26 Comments

মন্তব্য করুন