দারসুল হাদীসঃ পার্ট-২

হাদীসের বাংলা অনুবাদঃ
’ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসুলুল্লাহ (সা:) এক ব্যক্তিকে নসীহত করতে গিয়ে বলেছেন: তুমি পাঁচটি অবস্থাকে অপর পাঁচটি অবস্থার আগে প্রাধান্য দিবে।
(এক) বার্ধক্য এসে যাওয়ার আগে তোমার যৌবনকালকে।
(দুই) অসুস্থতা এসে যাওয়ার আগে তোমার সুস্থতাকে।
(তিন) দারিদ্রতা এসে যাওয়ার আগে তোমার সচ্ছলতাকে।
(চার) ব্যস্ততা এসে যাওয়ার আগে তোমার অবসরকে এবং
(পাঁচ) মৃত্যু এসে যাওয়ার আগে তোমার জীবনকে।’
(মেশকাত শরীফ)
রাবী / বর্ণনাকারীর পরিচয়ঃ
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) হলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচাত ভাই। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা:) এর চাচা আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র। আর তার মাতা লুবাবাহ বিনতুল হারিস ছিলেন রাসুল (সা:) এর স্ত্রী মাইমুনাহ (রা:) এর বোন। অতএব বাবা এবং মা উভয় দিক থেকেই তিনি ছিলেন রাসুল (সা:) এর আত্নীয়। এ কারণেই ইবনে আব্বাস (রা:) ছিলেন সকল সাহাবীর মাধে অতিশয় সম্মান, মর্যাদা ও গৌরবের অধিকারী। অগাধ জ্ঞান ও পান্ডিত্যের অধিকারী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস। তার জ্ঞান-গরিমা ও পান্ডিত্য বিবেচনা করেই তাকে ‘হাবরুল উম্মাতি ওয়া বাহরুহা বা এই উম্মতের বিশিষ্ট পন্ডিত ও অতি উত্তম ব্যক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। শিশু অবস্থায় রাসুল (সা:) তার জন্য দোয়া করে বলেছিলেন: ‘হে আল্লাহ! তাকে তুমি দীনের সঠিক বুঝ দাও এবং দীনের যথার্থ ব্যাখ্যা শক্তি দান কর’। রাসুলের দোয়ার বদৌলতে পরবর্তীতে তিনি ‘রাঈসুল মুফাসসিরীন’ বা মুফাসসির সর্দার নামে খ্যাতি লাভ করেন। তিনি দুইবার জিবরীল (আ:) কে দেখতে পান। তার জ্ঞান ও বিচক্ষনতার কারণে রয়:কনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও দ্বিতীয় খলীফা উমর ইবনুল খাত্তাব (রা:) তাকে ডেকে নিয়ে তার সাথে পরামর্শ করতেন। তার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ১৬৬০ টি।
হাদীসটির আলোচ্য বিষয় ও এর গুরুত্বঃ
হাদীসটিতে সফলতা লাভের জন্য যেসব বিষয়ে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে সে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সফল হওয়ার জন্য প্রত্যেকের বর্তমান অবস্থা এবং চলমান পরিস্থিতিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। বার্ধক্য, অসুস্থতা,দারিদ্রতা,ব্যস্ততা এবং মৃত্যু এগুলোকে মানুষ সব সময় নিজের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অজুহাত হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কেউ জানেনা তার বর্তমান অবস্থার চেয়ে ভবিষ্যত আরো সুখকর হবে কিনা। তাই হাদীসটি অত্যন্ত বাস্তবসম্মত এবং হাদীসের শিক্ষা অনুযায়ী আমরা যখন যে পরিস্থিতি এবং যে অবস্থায়ই বিরাজ করি না কেন সেটাকেই সর্বাপেক্ষা উত্তম ভেবে তা থেকে সর্বোচ্চ ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করব। কেননা আমরা কেউ জানিনা কে কতদিন বাচব, সামনে আমাদের জন্য সুস্থতা অপেক্ষা করছে নাকি অসুস্থতা, আমাদের জন্য সুদিন অপেক্ষা করছে নাকি দুর্দিন, সামনে আমাদের অবসর সময় আসতেছে নাকি ব্যস্ততা, সামনে আমরা আরো সচ্চল হবো নাকি অসচ্চলতা অপেক্ষা করছে। যে কোন সময় আমরা অনাকাঙ্খিত অবস্থার সম্মুখিন হতে পারি। তাই হাদীসটির গুরত্ব আমাদের জীবনে অনেক বেশী এবং এ হাদীস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতেই হবে। কারণ বর্তমানের চেয়ে ভবিষ্যত আমাদের ভাল হবে এ আশা আমরা করতেই পারি কিন্ত তার নিশ্চয়তা তো আমাদের কাছে নেই।
হাদীসটির ব্যাখ্যাঃ
বাংলায় একটি প্রবাদ আছে- বাঙালী দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝে না।
মানুষের সাধারণ প্রবৃত্তিই হলো এরকম যে, সে অধিকাংশ সময় নিয়ামত থাকা অবস্থায় সে নিয়ামতের কদর বুঝতে পারে না। আর নিয়ামত যখন চলে যায় তখন সে সেই নিয়ামতের কদর বা মূল্য বুঝতে সক্ষম হয় কিন্তু তখন আর তার ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই প্রকৃত বুদ্ধিমান সেই যে সময় থাকতে সময়ের মর্যাদা বুঝতে পারে এবং তার ফায়দা হাসিল করতে সক্ষম হয়। হাদীসে যে পাঁচটি বিষয়ের আলোচনা করা হয়েছে তা হলঃ
১. বার্ধক্য এসে যাওয়ার আগে যৌবনকালঃ
এখন সময় তার, যৌবন যার। যৌবনকাল আমাদের প্রত্যেকের জন্য মহান আল্লাহর এক অপার নিয়ামত। মানুষের আয়ুষ্কালের মধ্যে যৌবনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন। এ যৌবন একবার চলে গিয়ে বার্ধক্য চলে আসলে তা আর ফিরে আসে না। জীবনের অধিকাংশ কাজেই যৌবনে করা সম্ভব কিন্তু সেগুলো আর বার্ধক্যে করা সম্ভব হয় না। যুবকদের ইবাদত আল্লাহর নিকট খুবই পছন্দনীয়। তাই আমরা যাতে আমাদের যৌবনকালকে আল্লাহর আনুগত্যের পথে পরিচালিত করতে পারি তার চেষ্টা করতে হবে।
২. অসুস্থতা এসে যাওয়ার আগে সুস্থতাঃ
সুস্থতা আল্লাহর আর এক মহান নিয়ামত। সুস্থ থাকা অবস্থায় মানুষ যতটা আল্লাহর ইবাদত করতে পারে এবং অন্যান্য কার্যক্রম করতে পারে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর আর তা করা সম্ভব হয় না। ইচ্ছে থাকলেও তখন আর উপায় থাকে না। আর অসুস্থতা যেহেতু বলে কয়ে আসে না তাই সুস্থ থাকা অবস্থায় আমাদের কাজগুলো যাতে পড়ে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখা এবং যতটা সম্ভব বেশী করে আল্লাহর ইবাদত করা উচিত। আমাদের অধিকাংশই পড়ে করব বলে অনেক কাজ রেখে দেই, কিন্তু পরে আর করার সুযোগ পাব কিনা সেটা চিন্তা করি না।
এ ব্যাপারে রাসুল (সা:) এর আরো একটি সুন্দর হাদীস উল্লেখ করা যায়, ‘তিনি বলেছেন, দুটি নিয়ামত এমন আছে যেগুলোতে অনেক মানুষই ধোকায় পতিত হয়। তার একটি হলো সুস্থতা, আর অপরটি হলো অবসর।’
এ হাদীসটিতে মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতার চিত্রই ফুটে উঠেছে। মানুষ সচরাচর এ দুটো সময়কে হেলায় কাটিয়ে দেয়। সে মনে করে আর একটু সুস্থ হলে বা আর একটু অবসর হলেই ভালোভাবে এই কাজটি করব। এইভাবে সে তার কাজ জমিয়ে ফেলে। কিন্তু পরবর্তীতে সে আর একটু সুস্থ না হয়ে যদি আর একটু বেশী অসুস্থ হয়ে যায় বা আর একটু অবসর না হয়ে যদি সে আরো একটু ব্যস্ত হয়ে পড়ে তাহলে তার সে কাজটি আর করাই হয়ে ওঠে না। তাই হাদীসের শিক্ষা অনুযায়ী আমাদের এ দুটো বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
৩. দারিদ্রতা এসে যাওয়ার আগে সচ্ছলতাঃ
অর্থনীতির ভাষায় বলা যায়- অভাব পৌন:পুনিক। মানুষের অভাব বা চাহিদার কোন শেষ নেই। প্রত্যেক মানুষই একে অপরের তুলনায় হয় সচ্ছল নাহয় অসচ্ছল। তাই আমরা যদি ঐ ব্যক্তির দিকে তাকাই যে আমাদের চেয়ে সচ্ছল তাহলে আমরা কোনদিনই সুখী হতে পারব না। বরং আমাদের নৈতিক পদস্খলনের সম্ভাবনা দেখা দিবে। আর আমরা যদি ঐ ব্যক্তির দিকে তাকাই যে আমাদের চেয়ে অসচ্ছল তাহলে আমাদের নৈতিকতাও ঠিক থাকবে এবং আমরা মানসিক প্রশান্তিও লাভ করতে পারব। সবচেয়ে বড় কথা হলো আমাদের বর্তমান অবস্থাকে গুরুত্ব দিকে কাজে লাগাতে হবে দারিদ্রতা চলে আসার আগে।
অন্য একটি হাদীসে এসেছে, ‘আদী ইবনে হাতিম (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা:) কে বলতে শুনেছি: তোমরা আগুন থেকে বাঁচ একটা খেজুরের আটির খোসা দিয়ে হলেও।’ (বোখারী, হাদীস নং-১৩৫১)
অর্থাৎ বর্তমানে আমার যা আছে তা থেকেই কিছু অন্তত: আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে জাহান্নামের আগুন থেকে বাাঁচার চেষ্টা করতে হবে। তাই আরেকটু সচ্ছলতা আসুক তার পর এটা করব, ওটা করব এরকম ভাবা মোটেই সমীচীন নয়।
৪. ব্যস্ততা এসে যাওয়ার আগে অবসর সময়েরঃ
কথায় আছে, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। অবসর সময় পেয়েও আমরা যদি সেটাকে কাজে না লাগাই তাহলে শয়তান সেটাকে কাজে লাগায়। সে আমাদের মাথার মধ্যে অন্যায় কাজের চিন্তা এনে হাজির করে এবং আমরা সে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তাই অবসর সময়ে অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্বপূর্ন এবং অধিক লাভজনক কাজে নিজের অবসর সময় কাটাবার পরিকল্পনা করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
৫. মৃত্যু এসে যাওয়ার আগে জীবনেরঃ
জন্মিলে মরিতে হইবে। এটা সবাই বিশ্বাস করে। পৃথিবীতে একটি মানব শিশুর জন্ম হইতেও পারে আবার নাও হইতে পারে। মাতৃগর্ভ হইতে শিশুটি জীবন নিয়ে ভুমিষ্ট হইতে পারে আবার নাও হইতে পারে। কিন্তু একবার যে জন্মেছে সে মৃত্যুবরণ করবেই তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কখন সেই মৃত্যু এসে দুয়ারে হানা দিবে সেটা কেউ বলতে পারে না।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন, “প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করিতে হইবে। আর আমি ভাল ও মন্দ অবস্থায় ফেলে তোমাদেরকে পরীক্ষা করছি। অবশেষে তোমরা আমারই কাছে ফিরে আসবে।” (সুরা- আল-আম্বিয়া)
আমরা যেহেতু কেউ জানিনা কখন কার মৃত্যু হবে সেহেতু প্রতিটা মূহুর্ত আমাদেরকে কাজে লাগাতে হবে। আমাদেরকে বেশী বেশী ইবাদত করতে হবে। এখানে একজন বিখ্যাত মানুষের উক্তি উল্লেখ করা যায়-
’তুমি যখন দুনিয়ার কোন কাজ করবে তখন কাজটি এমনভাবে করবে যেন তুমি চিরদিন বেঁচে থাকবে, আর যখন আখেরাতের কোন কাজ করবে তখন কাজটি এমন ভাবে করবে যেন কাজের শেষেই তোমার মৃত্যু হবে।’অর্থাৎ দুনিয়া এবং আখিরাত, দুটি কাজকেই তোমাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সবচেয়ে সুন্দরভাবে করতে হবে।
হাদীসটির শিক্ষাঃ
* প্রতিটি মানুষের জীবনের সর্বোত্তম সময় হলো যৌবনকাল। সুতরাং এই যৌবনকে ভাল কাজে লাগিয়ে পরকালীন সাফল্য লাভ করতে হবে। যৌবনকালের ইবাদতকে আল্লাহ পাকও সবচেয়ে বেশী পছন্দ করেন।
*সুস্থতা এবং অবসর এ দুটি হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ দুটি নিয়ামত। সুতরাং এটা উপলব্ধি করে কাজে লাগিয়ে সফলকাম হতে হবে।
*মানুষের চাওয়া পাওয়ার যেহেতু শেষ নেই। তাই যার যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
*মৃত্যুর সময় যেহেতু কেউ জানেনা, তাই সর্বদাই মৃত্যুর জন্য তৈরী থাকতে হবে।
সুন্দর এই ভবে / এসেছিলে যবে / কেঁদেছিলে তুমি / হেসেছিল সবে।
এমন জীবন তুমি করিবে গঠন / মরণে হাসিবে তুমি, কাঁদিবে ভুবন।।
আল্লাহ আমাদের সকলকে উল্লেখিত হাদীসের আলোকে জীবন গঠন করে সফলতা লাভের তৌফিক দান করুন। আমীন।

<

Related Posts