প্রথমে দেখা তারপর ভালোবাসা তারপর বিয়ে

অন্য প্রেমের গল্প

পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষের জীবনে কোনো না কোনো গল্প থাকে। আজকে আমি আমার ভালোবাসার গল্প বলব।

আমি তিতির, বয়স বত্রিশ, এখনো অবিবাহিতা।এ নিয়ে বহু লোকের মাথা ব্যথা যে আমার বয়স বেড়ে যাচ্ছে কিন্তু আমি বিয়ে করেছি না কেন? আমি কিন্তু কাউকে ভয় পাইনা। মুখের উপর জবাব দিই- “আমি শিক্ষিতা, সাবলম্বী, প্রাপ্তবয়স্কা, তাই আমার ভালোমন্দ বিচার করা বা নিজের সিদ্ধান্ত নিজে দেওয়ার ক্ষমতা আছে‌ আমার। আমাকে নিয়ে না ভাবলেও চলে।”

কিন্তু যখন ফাঁকা পার্কে গিয়ে একা বসে দেখি, ছোট ছোট প্রেমিক প্রেমিকারা নিজেদের হাত শক্ত করে চেপে এগিয়ে যাচ্ছে, কিম্বা যখন ভিড় বাসে দেখি কলেজ পড়ুয়া প্রেমিক তার প্রেমিকাকে দু’টো হাত দিয়ে বাইরের ভিড় থেকে নিজের কাছে আগলে রেখেছে, তখন আমার মনে হয় ইশ যদি আমারো এইভাবে একজন ভালোবাসার মানুষ থাকতো!
কিন্তু মনে হলে কি হবে আমি যে ভীষণ অভিমানী।

আজকাল আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে যখন দেখি, মনে হয় আর কয়েকবছর পর বার্ধক্য আসবে আমার, আস্তে আস্তে হারিয়ে যাবে যৌবন, কি জানি কেন বড় ভয় হয় আমার। এখন তো উনিশ কুড়ি বছরের ছেলেরাও আমাকে দিদি না বলে আন্টি বলেই ডাকতে শুরু করেছে। আর হবে নাই বা কেন, বছর দশেক আগের কলেজের সবচেয়ে স্মার্ট প্রাণবন্ত মেয়েটা যে আজ বড় বেরঙিন বেমানান সবার কাছে। জিন্স, টপ, কুর্তি ছেড়ে এখন‌ সালোয়ার পাজামা ধরেছি, চোখে কাজলের পরিবর্তে এখন থাকে মোটা ফ্রেমের চশমা, আর খোলা ঢেউ খেলানো চুলের বদলে এখন আমার চুল থাকে হাল্কা বিনুনিতে বাঁধা। আমার এতো পরিবর্তন মেনে নিতে পারে না অনেকেই, কিন্তু আমার আর নিজেকে সুন্দর করে সাজাতে ইচ্ছেই করে না।

এখনো রোজ রাতে একটা মুখ মনে পড়ে আমার, পাঁচবছর আগে শেষ দেখেছিলাম ওকে। চেঁচিয়ে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করে মাঝেমাঝে। তারপর নিজেকে বোঝাই ও এখন অন্যকারো স্বামী, হয়তো বাবাও হয়েছে। কিন্তু আমি ভুলতে পারিনি আমার জীবনের প্রথম আর শেষ ভালোবাসা দীপ্তকে। মনে পড়ে কলেজের সবার জানা ছিল আমার আর দীপ্তর বন্ধুত্বের কথা‌‌। আমি যে দীপ্তকে পছন্দ করি সেটা অনেকেই জানলেও দীপ্তর মনের কথা কেউ জানতেই পারেনি। দীপ্তকে আমি একেবারে নিজের ভাবতাম। কোনো মেয়েকে দীপ্তর সাথে কথা বলতে দেখলে খুব রাগ হতো আমার। আমি জানতাম দীপ্ত মেধাবী হলেও দীপ্তর বাড়ি গ্ৰামে, ওদের পরিবার আমাদের মতো স্বচ্ছল নয় তাও মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলাম ওকে। মনে মনে ভেবে নিয়েছিলাম দীপ্তও বুঝি আমাকে ভালোবাসে।

একবার সব বন্ধুরা মিলে গেছিলাম দীপ্তর বাড়ি। খুব ভালো লেগেছিল ছোট্ট গ্ৰামটাকে। আমি বলেছিলাম- “মনে হচ্ছে এখানেই থেকে যাই।”
আমার এক বান্ধবী মুচকি হেসে বলেছিল- “এখানেই তো থাকতে হবে তোকে।”
ওখানেই আমি প্রথম দেখি ছায়াকে। একটা শ্যামলা মেয়ে,পরনে আটপৌরে শাড়ি,আমাদের পোষাক দেখে হাঁ করে তাকিয়েছিল আমাদের দিকে। তারপর দীপ্তর মাকে জিজ্ঞেস করেছিল- “এরা বুঝি ওর শহরের বন্ধু?”
তারপর দীপ্তকে বলেছিল- “তোমার মেয়ে বন্ধুও আছে?” সেদিন আমি ছায়ার মুখে রাগ দেখেছিলাম। কিন্তু সেদিন এতোটা গুরুত্ব দিইনি।

আমার বয়স তখন পঁচিশ, দীপ্ত তখন চাকরি পেলো। আস্তে আস্তে কমতে থাকলো আমাদের দেখাসাক্ষাৎ। দু’বছর পর শুনলাম দীপ্তর বিয়ের খবর। অবাক হয়েছিলাম খুব, ভেঙে পড়েছিলাম মানসিকভাবে। আর এটাও বুঝেছিলাম প্রেমিক ভাবা মানুষটা আমার প্রেম বোঝেনি কখনো। বিয়েতে নিমন্ত্রণ করেছিল বটে, আমি যাইনি। অন্য বন্ধুদের মুখে শুনেছিলাম ওই ছায়াকেই বিয়ে করেছে দীপ্ত। মনে মনে অনেক ভেবেছিলাম ওই শ্যামলা গ্ৰামের মেয়েটার মধ্যে কি ছিল যা আমার মধ্যে ছিল না? অনেক ভেবেও উত্তর পাইনি, কিন্তু আর পারিনি কাউকে ভালোবাসতে। বাড়ি থেকে বিয়ের চেষ্টা করলেও আমি মত দিইনি, আসলে আর কারো সাথে সংসার করার কথা মনেই আসেনি।

সেবার ছোট ভাইঝিটার জ্বর হল। বৌদির কথামতো চাইল্ড স্পেশালিস্ট ডাক্তারের কাছে আমিই নিয়ে গিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু ওখানে অপেক্ষারত আরেকজন মানুষকে থেকে চমকে উঠে বিস্ময়ের সাথে বললাম- “দীপ্ত তুই এখানে?”
দীপ্ত বললো- “এইতো ছেলেকে দেখাতে এলাম।”
এবার লক্ষ্য করলাম ওর ছোট্ট ছেলেটার দিকে। আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম- “কি নাম তোমার সোনা?”
কোনো উত্তর এলো না। দীপ্ত বিষন্ন মুখে বললো- “ও বলতে বা শুনতে পারে না।”
মনটা খারাপ হয়ে গেল আমার। ছায়ার কথা জিজ্ঞেস করলে জানলাম সন্তানের জন্মের সময়ই বাঁচানো যায়নি ছায়াকে। বললাম- “এখন কি এই শহরেই থাকিস?”
দীপ্ত আমার হাতে নিজের ঠিকানাটা দিয়ে বললো- “আমাকে এখন যেতে হবে বাবুকে নিয়ে। একদিন সময় করে চলে আসিস। আমি কিন্তু অপেক্ষায় থাকবো।”

বাবুর জন্য কিছু উপহার নিয়ে একদিন চলে গেলাম দীপ্তর বাড়ি, আগে থেকেই ফোনে জানিয়েছিলাম অবশ্য। আসলে প্রিয় মানুষটার জীবনের এতো কষ্ট যন্ত্রণা আমাকে অস্থির করে তুলেছিল। দীপ্তর প্রিয় চকোলেটটাও নিতে ভুললাম না। আমি গিয়েই অনেক গল্প করলাম দীপ্তর সাথে। জানলাম একবছর ধরে একাই আছে ছেলেকে নিয়ে। খুব চিন্তায় থাকে ও ছেলেটাকে একা রেখে অফিস গেলে। হঠাৎ দেখলাম একটা ছোট্ট হাত আমার আঙুল ধরেছে। বাবুকে দেখেই কোলে নিলাম। বাবু কিন্তু একটুও কাঁদলো না, চুপটি করে বসে আদর খেতে লাগলো। দীপ্ত বললো- “তুইতো ম্যাজিক জানিস তিতির। বাবু তো কারো কোলে যেতেই চায়না।”

ছুটির দিন দুপুরে দেখলাম দীপ্ত আমার জন্য রান্না করেছে ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন কারি‌।হেসে বললো- “তোর প্রিয় খাবার দ্যাখ, এখন বানাতে শিখে গেছি।”
বাবু খেতে চাইছিল না। আমিই বললাম- “ছাড় এসব তোর কাজ নয়, আমিই খাইয়ে দিচ্ছি।”
দীপ্ত বললো- “এখনো বিয়ে করিসনি কেন তিতির? আর নিজের কি হাল করেছিস এটা?”
আমি দুঃখের হাসি হাসলাম।

এইভাবে মাস তিনেক কেটে গেল। অনেকবার গেছি ওদের ফ্ল্যাটে। আমি গেলেই বাবুর চোখেমুখে খুশি ঢেউ খেলে যায়। একদিন দীপ্তকে বললাম- “দীপ্ত আমাকে বাবুর মা হবার অধিকারটা দিবি রে? বড় মায়া পড়ে গেছে ছেলেটার উপর।”
দীপ্ত কাঁপা গলায় বললো- “তুই কেন এইভাবে নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে চাইছিস তিতির?”
আমি বললাম- “দীপ্ত আমি বাবুর মা হতে চাই।”
দীপ্ত সম্মতি জানাতেই বাড়িতে বললাম। বাড়িতে কেউ রাজি হল না প্রথমে। রেজিষ্ট্রি ম্যারেজ করলাম আমার। আমি মা হলাম বটে, স্ত্রীও হলাম আইনি মতে, কিন্তু সিঁদূরটা পেলাম না। আমার সিঁথি ফাঁকাই থেকে গেল। এখন আমার সময় কেটে যায় বাবুকে নিয়ে, এখন আমার দুনিয়া বাবু।

কয়েকমাস পরের ঘটনা। সেদিন আমার অফিসের ছুটি ছিল, দীপ্ত নিয়মমাফিক অফিস গেছিল, বাবু খেলছিল। দীপ্তর ঘর গোছাতে গিয়ে চোখে পড়লো দীপ্তর মোটা ডাইরিটা। এই ডাইরিটা কতোবার চেষ্টা করেছিলাম কলেজে পড়ার, কিন্তু দীপ্ত কিছুতেই দেয়নি। আজ সুযোগ পেয়ে যেন বাচ্ছা হয়ে গেলাম, পড়তে শুরু করলাম। এ আমি কি পড়ছি! আমার চোখে জলের ধারা‌‌।

দীপ্ত ফিরতেই ঘরে ডাকলাম। চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলাম- “ভালোবাসিস আমায়?”
হাউমাউ করে কাঁদছে দীপ্ত, আশ্রয় নিলাম আমি ওর বুকে‌‌। আর ওর থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে ইচ্ছে করছে না আমার। সেবার হোষ্টেল থেকে ফিরে দীপ্ত শুনেছিল অনাথ ছায়াকে গ্যাংরেপ করে ফেলে রেখে গেছে কয়েকজন দুষ্কৃতী। সেই থেকে ছায়া থেকে গেছে দীপ্তর বাড়িতে। নির্দোষ ছায়াকে গ্ৰাম থেকে তাড়িয়ে দিতে চাইলে চাকরি পেলে দীপ্ত নিজে ছায়াকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছায়াকে বাঁচিয়েছে আর দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। তাই ওই ঘটনার পর আমাকে ভালোবাসলেও কখনো মুখ ফুটে বলতে পারেনি সে। আজ আমি অপেক্ষা করেছিলাম বলে আমার ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পেয়েছি। সে শুধু সৎ নয়, অনেক বড় মনের মানুষ। আজ আমার সিঁথি রঙিন। মন্দিরে এসে শপথ করেছি দু’জন একসাথে থেকে বাবুকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে মানুষের মতো মানুষ করে তোলার।

Related Posts

11 Comments

মন্তব্য করুন