বাস্তব পাতালপুরির গল্প

অনুসন্ধান ও রহস্য উদঘাটন করা মানুষের চিরাচরিত ধর্ম। জ্ঞানপিপাসু মানুষ তাই রহস্য উন্মোচনে ব্যস্ত। এমনই এক ঘটনা ঘটেছিলো আজ থেকে ৫৫ বছর আগে, নিজের বাসস্থান মেরামতকালে এক পাতালপুরির সন্ধান পেয়েছিলেন তিনি। বলছি তুরস্কের নেভশেহির প্রদেশের এক ভদ্রলোকের কথা। যিনি আবিষ্কার করেন ২ হাজার বছর পুরোনো মাটির নিচের এক শহর, যার নাম ডেরিংকুয়ো।

 

সেদিন তিনি তার নিজ ঘর মেরামত করছিলেন, দেয়ালের এক অংশ মেরামতের সময় মেঝে ভেঙ্গে পড়ে গিয়েছিলেন মাটির নিচের এক অন্ধকার শহরে। হাটি হাটি পা পা করে অগ্রসর হয়েছিলেন সম্মুখের সুড়ঙ্গ পথে। খুঁজে পেয়েছিলেন হারিয়ে যাওয়া এক শহরের সন্ধান।

 

শুনতে গল্প মনে হলেও এ ঘটনা সত্য। মাটির নিচের ওই রহস্য ঘেরা ডেরিংকুয়োর অবস্থান তুরস্কের মধ্য আনাতোলিয়ার কাপাদোশিয়ায়। ভুপৃষ্ঠ থেকে বহু গভীরে শহরটির অবস্থান। মাটির নিচে স্তরে স্তরে বিভক্ত এই শহরটি, যে স্তরগুলো জুড়ে ছিলো স্কুল, গীর্জা, রান্নাঘর, গোয়াল, কবরসহ একটি শহরের যাবতীয় উপাদানসমূহ। সব মিলিয়ে প্রায় ২০ হাজার মানুষের আবাসস্থল ‍ছিলো এই রহস্যঘেরা কুয়ো।

 

এরপর ১৯৬৯ সালে দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় এই শহরটি। তবে পুরো শহরের ৯০ ভাগই রাখা হয় পর্যটকদের ধরা ছোয়ার বাইরে। কিন্তু বাকি ১০ ভাগ পরিদর্শন করে পর্যটকরা হারিয়ে যান হাজার হাজার বছর পুরোনো এক নগরীতে। পাথরের দেয়াল স্পর্শ করলেই এক অনূভুতি যেনো মনে করিয়ে দেয় হাজার হাজার বছর আগের এই শহরে আশ্রয় নেয়া মানুষগুলোর কথা।

 

ডেরিংকুয়োর ইতিহাস অনুসন্ধানে এর সম্পর্কে অনেক বিভ্রান্তিকর তথ্য পাওয়া যায়। কারা যে এই শহরের প্রতিষ্ঠাতা আর তারা কেনোইবা মাটির তলে এই শহরের সৃষ্টি করেছে তা জানতে গেলে অনেক ধরনের গোজামিলের সন্ধান পাওয়া যায়।

 

কিন্তু অগ্নুৎপাতই যে এই শহর সৃষ্টির মূল কারণ তা পুরোপুরি বাস্তব। কারণ তুরস্কের আনাতোলিয়ার কাপাদোসিয়া অগ্নুৎপাতের জন্য বিখ্যাত। এর অবস্থান ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩,৩০০ ফুট উঁচু মালভূমিতে। কয়েক মিলিয়ন বছর আগে ওই মালভূমিতে অগ্ন্যুৎপাত হয়েছিলো। এতে করে ছাই ও লাভায় নিমজ্জিত ছিলো সমস্ত এলাকা। যা পরবর্তীতে নরম শিলায় রুপ নেয়। পরে ওই অঞ্চলের প্রাচীন অধিবাসীরা বুঝেছিলো যে, এই নরম শিলা খোদাই করে ঘর বাড়ি নির্মাণ করা সম্ভব। তাই তারা শিলা খনন করে তৈরি করেছিলো এক বিশাল শহর ডেরিংকুয়ো। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত অনেক পাতালপুরির সন্ধান পাওয়া গেছে। কিন্তু ভূপৃষ্ঠের নিচে ২৮০ ফুট বিস্তৃত এই শহর সবার ঊর্ধ্বে।

 

শহরটির নির্মাণ প্রকৌশলী কারা তা নিয়ে রয়েছে বেশ দ্বিধা দ্বন্দ্ব। কেউ কেউ মনে করেন খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ থেকে ১২০০ অব্দে আনাতোলিয়ায় ফ্রিজিয়ানদের আক্রমন থেকে রেহাই পেতে হিত্তিতিরা এই পাতালপুরি নির্মাণ করেছিলো। আবার কারোর ধারণা ফ্রিসিয়ানরাই নির্মাণ করেছিলো এই শহর। খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে ৮০০ অব্দের মধ্যে তৈরি করেছিলো তারা। পরবর্তীতে মিশরীয়, গ্রীক, আমেরিকান, সিরিয়ান লোকজনের আবির্ভাব হয় এই কাপাদোসিয়ায়। তবে গ্রীক সেনা ও ইতিহাসবিদ জেনোফোনের লেখায় সর্বপ্রথম এই শহরের সন্ধান মেলে। বহুকাল ডেরিংকুয়ো পরিদর্শন শেষে তিনি তার বই ‘অ্যানাবেসিস’ লেখেন।

 

সেখানে তিনি বলেন, “ঘরগুলো ছিলো মাটির নিচে। ঘরের প্রবেশের মুখগুলো কুয়ার মতো হলেও নিচে ছিল যথেষ্ট প্রশস্ত। সুড়ঙ্গ দিয়ে গবাদিপশুর যাতায়াতের জন্য ব্যবস্থা ছিলো। তবে মানুষ যাতায়াতের জন্য সিঁড়ি বরাদ্দ ছিলো। ঘরগুলোতে ছাগল, ভেড়া, বাছুরসহ বিভিন্ন ধরনের পাখি পোষা হতো এবং প্রতিটি ঘরেই এদের সবার খাবারের ব্যবস্থা ছিলো।“

 

পাথরের নরম শিলা খোদাই করে তৈরি করা হয়েছিলো এই শহরটি। বড় বড় সুড়ঙ্গ পথের এই শহরটি বিভিন্ন গুহাকে সংযুক্ত করেছে। গুহাগুলো ছাড়াও এই শহরে ছিলো উপাসনালয়, খাবারের দোকান, মদের ভান্ডার ও স্কুল। মৃতদেহ সংরক্ষণের জন্য সর্বশেষ স্তরে ছিলো গোরস্থান। মাটির ওপরে উঠে সৎকারের আগ পর্যন্ত মৃতদেহগুলো সেখানেই সংরক্ষিত থাকতো। তাছাড়া বিভিন্ন ঝোপঝাড়, দেয়াল ও বাড়ির উঠানের আড়ালে লুকানো ছিল প্রায় একশর মতো প্রবেশপথ।

 

 

পৃথিবীর অন্যসব পাতালপুরির মধ্যে এই ডেরিংকুয়োর রয়েছে কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য। তৎকালীন সময়ে এটিই একমাত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ ভূগর্ভস্থ শহর। এই শহরের একটি গোপন প্রবেশদ্বার ছিলো এবং তৃতীয় তলায় ছিল একটি পিপে আকৃতি খিলানযুক্ত প্রশস্ত কক্ষ। যেখানে ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হতো। প্রত্যেক বিভাগের জন্য আলাদা আলাদা অংশ ছিল এই শিক্ষাকেন্দ্রের।

 

ডেরিংকুয়োর বাসিন্দারা পানির জন্য ১৮০ ফুট চওড়া খাদকে প্রধান কূপ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলো। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে মাটির ওপরে ও নিচের সবাই ওই কূপের পানি সংগ্রহ করতে পারতো। অন্যদিকে শহরের তৃতীয় স্তরের তিন মাইল লম্বা একটি সুড়ঙ্গ পথ পার্শ্ববর্তী ভূগর্ভস্থ শহর ‘কায়ামাকলি’র সাতে সংযোগ স্থাপন করতো। পথটি বর্তমানে ভূমিধ্বসের ফলে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

Related Posts

8 Comments

মন্তব্য করুন