বিশ্ব বিখ্যাত বাংলাদেশের যে বিজ্ঞানীর নাম অনেকেরই অজানা

জামাল নজরুল ইসলাম তিনি বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও বিশ্বতত্ববিদ  । তিনি মহাবিশ্বের উদ্ভব ও পরিণতি বিষয়ে মৌলিক গবেষণার জন্য বিশেষভাবে খ্যাত ।  জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৩৯ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ  শহরে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি যখন  চট্রগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে   ভর্তি হওয়ার জন্য পরীক্ষা দেন ঐ সময়  ভর্তি পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্বের জন্য তাকে “ডাবল প্রমোশন” দিয়ে সরাসরি ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করে নেয়া হয়। নবম শ্রেণী পর্যন্ত এই স্কুলে পড়াশোনা করেন তিনি । এখানে পড়ার সময়ই গণিতের প্রতি তার অন্যরকম ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। অনেক অতিরিক্ত জ্যামিতি সমাধান করতে থাকেন। নবম শ্রেণীতে উঠার পর পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে  চলে যান। সেখানে গিয়ে ভর্তি হন লরেন্স কলেজে । এই কলেজ থেকেই তিনি সিনিয়র কেমব্রিজ ও হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ পাশ করেন। সে সময় সিনিয়র কেমব্রিজ বলতে বর্তমানের ও লেভেল এবং হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ বলতে বর্তমানের এ লেভেল বোঝাতো বোঝাতো। এ সময় নিজে নিজে অনেক অঙ্ক কষতেন। বিভিন্ন বই থেকে সমস্যা নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করতেন যা পরবর্তীতে তার অনেক কাজে আসে। উল্লেখ্য, হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজে তিনি একাই কেবল গণিত পড়েছিলেন। এটা বেশ উচ্চ পর্যায়ের গণিত হওয়ায় সবাই নিতে চাইতো না। এ সময়ই গণিতের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন। লরেন্স কলেজের পাঠ শেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের  সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে  পড়তে যান । সেখান থেকে তিনি বিএসসি অনার্স করেন। এই কলেজের একজন শিক্ষককে তিনি নিজের প্রিয় শিক্ষক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এই শিক্ষকের নাম “ফাদার গোরে”। গণিতের জটিল বিষয়গুলো খুব সহজে বুঝিয়ে দিতেন বলেই জে এন ইসলাম তার ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। গোরে তার কাছে গণিতের বিভিন্ন বিষয় জানতে চাইতেন, ইসলাম আগ্রহভরে তা শেয়ার করতেন। গোরের সাথে ইসলামের এই সম্পর্কের কারণ বলতে গিয়ে ইসলাম বলেন,

গণিতকে এমনিতেই অনেকে ভয় পেতাম। কিন্তু এটির প্রতিই ছিল আমার অসীম আগ্রহ। এ কারণেই বোধহয় তিনি আমাকে পছন্দ করতেন।

বিএসসি শেষে ১৯৫৭ সালে ইসলাম কেমবিরজে  পড়তে যান। কেমব্রিজের প্রায়োগিক গণিত ও তাত্বিক পদার্থ বিজ্ঞান থেকে আবারও স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর এখান থেকেই মাস্টার্স  ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই প্রায়োগিক গণিত ও তাত্বিক পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে পিএইচডি  ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮২ সালে এসসিটি (ডক্টর অফ সায়েন্স) ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ডে ডক্টরাল-উত্তর ফেলো হিসেবে কর্মরত ছিলেন।  তিনি কেমব্রিজের ইনস্টিটিউট অফ থিওরেটিক্যাল আস্ট্রোনমি-তে (বর্তমানে ইনস্টিটিউট ফ আসট্রোনমি কাজ করেন ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। ১৯৭১ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে  ভিজিটিং সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের প্রভাষক ছিলেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি কলেজ, ফার্ডিফ (বর্তমানে কার্দিফ বিশ্ববিদ্যালয় এর সায়েন্স রিসার্চ কাউন্সিলে ফেলো ছিলেন। ১৯৭৮ সালে তিনি লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং পরে রিডার পদে উন্নীত হন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটনে অবস্থিত ইন্সটিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিতে   ১৯৬৮, ১৯৭৩ ও ১৯৮৪ সালে ভিজিটিং সদস্য হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৪ সালে ইসলাম বাংলাদেশে ফিরে এসে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়য়ের   গণিত বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।ড. ইসলাম মৃত্যুর আগ চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়য়ের  রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিকাল এন্ড ফিজিকাল সায়েন্সের এর গবেষক এবং চট্রগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এর একজন সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন। ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে

দি আল্টিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স ( ১৯৮৩) -কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পর বিজ্ঞানী মহলে বিশেষ সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়। জাপানি, ফরাসি, পর্তুগিজ ও যুগোশ্লাভ ভাষায় অনূদিত হয়।

ক্লাসিক্যাল জেনারেল রিলেটিভিটি (১৯৮৪) –ডব্লিউ বি বনোর এর সাথে যৌথভাবে সম্পাদনা করেন।

রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি (১৯৮৫) – কেমব্রিজ থেকে প্রকাশিত।

অ্যান ইন্টোডাকশন টু ম্যাথামেটিক্যাল কসমোলজি  (১৯৯২)

কৃষ্ণ বিবর – বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত।

মাতৃভাষা ও বিজ্ঞান চর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ – রাহাত-সিরাজ প্রকাশনা

শিল্প সাহিত্য ও সমাজ – রাহাত-সিরাজ প্রকাশনা

স্কাই অ্যান্ড টেলিস্কোপ – কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস। স্প্যানিশ ভাষায় অনূদিত

দ্য ফার ফিউচার অফ দি ইউনিভার্স – এনডেভারে প্রকাশিত

তার সফল জীবনে তিনি বিভিন্ন সম্মাননায় সম্মানিত হন তন্মদ্ধে উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী ১৯৮৫ সালে তাঁকে স্বর্ণপদকে ভূষিত করে। ১৯৯৪ সালে তিনি ন্যাশনাল সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি মেডেল পান। ১৯৯৮ সালে ইতালির আব্দুস সালাম সেন্টার ফর থিওরিটিকাল ফিজেক্সে থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমি অফ সায়েন্স অনুষ্ঠানে তাঁকে মেডাল লেকচার পদক দেয়া হয়। তিনি ২০০০ সালে কাজী মাহবুবুল্লাহ এন্ড জেবুন্নেছা পদক পান। ২০০১ সালে তিনি একুশে পদক  লাভ করেন। পদার্থবিজ্ঞানে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ২০১১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়   এর রাজ্জাক-শামসুন আজীবন সম্মাননা পদক লাভ করেন।

ড. ইসলাম মৃত্যুর আগ পর্যন্ত  চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়য়ের  রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিকাল এন্ড ফিজিকাল সায়েন্সের এর গবেষক এবং চট্রগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এর একজন সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন। ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

 

 

 

 

Related Posts