যাত্রাপালার উৎপত্তি ও বিবর্তন

চারিদিকে শুনশান নীরবতা, একটা মঞ্চকে ঘিরে কয়েক শত মানুষ বসে আছে,গ্রামের বাচ্চা থেকে বুড়ো, উউচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত কেউ বাদ যাবে না,উচ্চবিত্তরা চেয়ারে আর নিম্নবিত্তরা মাটিতে বিছিয়ে দেয়া চট কিংবা ক্ষড় এর উপর ।  ছেলেদের হাতে হুক্কা  অথবা বিড়ি আর মেয়েদের হাতে পানের বাটা কিন্তু কারো মুখে কোন শব্দ নেই, মঞ্চের উপর, খালি গলায় দারাজ কন্ঠে  অভিনেতা আর অভিনেত্রীর একের পর এক সংলাপ বিনিময় হচ্ছে। এরই মাঝে খলচরিত্রের আগমন ঘটলো, তরবারি নিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে চারিদিকে তুমুল উত্তেজনা কার জয় হবে।

এমন সময় বিবেক রুপে এক চরিত্রের আগমন সে গান গেয়ে মানুষের কাছে ভাল মন্দের ব্যাখা করে গেলেন। এভাবে দেখতে দেখতে একসময় শিশুরা পিতা মাতার কোলেই ঘুমিয়ে পড়বে আর পালা শেষে নায়ক নায়িকার বিরহের কষ্টে মেয়ে বৌ রা চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরবে, এই ছিল চিরায়ত গ্রাম বাংলার যাত্রাপালার দৃশ্য। যদিও এখন তা চিন্তা করলে এক প্রকার রুপকথার গল্প বলেই মনে হবে।কিন্তু,যাত্রা এক সময় এই বাংলাদেশের শিল্প চর্চার অন্যতম মধ্যম ছিল, আপনি যদি শহরের কোলাহল ছেড়ে বাংলার প্রত্যন্ত  কোন গ্রামে যান তবে সেই খাঁটি যাত্রাপালা দেখার সৌভাগ্য আপনার হলেও হতে পারে।

কিন্তু, এই যাত্রাপালা গুলো একসময় এদেশের গ্রামে গঞ্জে সারা বছর লেগেই থাকতো -নবান্নের ধান কাটা , পূজো পার্বন, ঈদ কিংবা গ্রামের কোন প্রতিপত্তিশালী লোকের পুত্র বা কন্যার বিবাহ, প্রতিটি উৎসবে  যাত্রাপালা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ  অঙ্গ। যে যত্রা রাতের পর রাত জেগে বাংলার সাধারণ মানুষ কৃষক, তাঁতী, কামার ,কুমার, জেলে দেখেছে আর মেতেছে পালা গানের সুরে আজ তা কালের বিবর্তনে একটি মৃতপ্রায় শিল্প মাধ্যম ছাড়া কিছু নয় আবার অনেকের কাছে অশ্লীলতার কারখানা।

যদিও যাত্রাপালার উৎপত্তি নিয়ে  গবেষকদের  মতভেদ হলেও, বাঙালির অভিনয়ে প্রবেশ নাটকের  মাধ্যমে হওয়ার আগে যাত্রার মাধ্যমে শুরু হয়,এ ব্যাপারে কারও   কোন দ্বিমত নেই। তবে সর্বজনবিদীত ভাবে মনে করা হয়  হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন দেব-দেবীর উৎসব যেমন – দোলযাত্রা, শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমীতে কৃষ্ণযাত্রা, জগন্নাথ দেবের জন্য  রথযাত্রা ইত্যাদি অনুস্ঠানে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা গান-বাজনার মিছিল নিয়ে যওয়া  শুরু করার পরই ধারণা করা হয়েছে ।

এই যে, বিভিন্ন উৎসবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গান বাজনা করতে করতে যাওয়া- এ ‘যাওয়া’ কথাটা থেকেই ‘যাত্রা’ কথাটির উৎপত্তি বলে বেশীরভাগ গবেষক ধারণা করে থাকেন । তবে, একসময় যাত্রা বা পালা গান মধ্যে কোনগুলি লীলানাট্য আর কোনগুলি শুধুমাত্র যাত্রা বা পালা গান  এ নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ ছিল, এক দল লোক বলতেন লীলানাট্য আর পালাগান একই জিনিস শুধু পার্থক্য লীলানাট্য কেবল ইশ্বর কেন্দ্রিক বন্দনা এর ভিন্ন কিছু নয়   আর আরেক দল লোক বিপক্ষে বলতেন লীলানাট্য আর যাত্রাপালার গান দুটি আলাদা বিষয় এটাকে এক ভাবার কিছু নেই। যদিও এখানে বলে রাখা ভালো, বিভিন্ন প্রাচীন পুথি আর  শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তনের মধ্যে যাত্রার নিদর্শন পাওয়া যায়।

এছাড়াও যাত্রাপালা যে বাংলা শিল্পের প্রাচীণতম একটি মাধ্যম তার প্রমাণ পাওয়া যায় শ্রী চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের আগেও রাঢ়, বঙ্গ, সমতট, গৌড়, পুণ্ড্র, চন্দ্রদ্বীপ সমগ্র ভূখণ্ডে পালাগান ও কাহিনিকাব্যের অভিনয় তথা যাত্রা প্রচলিত ছিল। এছাড়াও আমার যদি শ্রী চৈতন্যদেবের জীবনী লক্ষ্য করি সেখানে  বলা হয়ে থাকে যে রুক্মিণী হরণ নামে একটি কৃষ্ণযাত্রায় চৈতন্যদেব নিজে অভিনয় করতেন,সেখানে তিনি নিজেই নাকি রুক্মিণী সেজে অভিনয় করতেন ।

এই যাত্রাপালা যে শুধু সে সময় গ্রামীণ জীবনে বিনোদনের একটা মাধ্যম হিসেবে শুধু ব্যবহার করা হয়েছে তা কিন্তু নয়, আমরা যদি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দলনের সময়কার যাত্রাপালা লক্ষ্য করি তাহলে দেখব, সে সময় এটাকে দেশের সাধারণ জনগণের কাছে দেশপ্রেম জাগ্রত করণের জন্য, ব্রিটিশ বিরোধী জনসংযোগ এবং প্রতিবাদের একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। মুকুন্দ দাশ নামক এক ব্যক্তি  ‘স্বদেশী যাত্রা’র সূচনা করেন, পরবর্তীতে আরো অনেক বিপ্লবী অনুপ্রানিত হয়ে স্বদেশী যাত্রা শুরু করেন।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর যখন  অনেক  যাত্রাদল পূর্ববঙ্গ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়, তখন পাকিস্তান সরকার যাত্রাপালা ধর্মবিরোধী কাজ এমন কথা বলে  ফতোয়াও জারি শুরু করে । তারা কখনো বাংলার লোক সংস্কৃতিকে সুনজরে দেখেনি। এরপর স্বধীনতা পরবর্তী সময়ে যাত্রা পালা তার আগের রুপে ফিরতে পারে নি যত দিন গিয়েছে তা আরো নিম্নগামী হয়েছে। যদিও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলে অনেক যাত্রাদল নতুনভাবে গড়ে ওঠে এবং ভালো এবং জনপ্রিয় কিছু যাত্রা তারা উপহার দেয় কিন্তু সত্তর দশকের শেষভাগ যাত্রাশিল্পে অবক্ষয় শুরু হয়।

এখন আমরা যদি যাত্রা শিল্পের সেকালের কথা ধরি অতীতে যে যাত্রাপালাকে পেশা হিসেবে খুব একটা সন্মানের চোখে দেখা হতো তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন প্রাচীন প্রবাদের মধ্যে একটি হলো “যাত্রা করে ফাত্রা লোকে”,একটা সময় ছিল, তখন সত্যিই ধরে নেওয়া হত যারা  যাত্রা করে তারা মুলত  ‘ফাতরা’ লোক। এই ব্যপারে একটি লোকগল্প প্রচলিত আছে –
একদল যাত্রা অভিনেতা যাত্রা শেষে পায়ে হেঁটে বাড়ি  ফিরছেন৷ গভীর রাত চারিদিকে তুমুল বৃষ্টি,  কাদায় পা পড়ে আওয়াজ হচ্ছে৷ এত রাত্রে পায়ের আওয়াজ শুনে এক গেরস্থ জিজ্ঞাসা করল, ‘কে যায়, পথ দিয়ে ?’ উত্তর এল, ‘আজ্ঞে, যাত্রাদলের লোক ’, পাশে ফিরে শুতে শুতে প্রশ্নকর্তা বলল, ‘ওঃ ! আমি ভাবলাম মানুষ বুঝি৷’

আমার এতগুলো কথা বলার কারণ,অতীতে  যাত্রা পেশা হিসেবে অতি সন্মানের ভাবা না হলেও যাত্রার জনপ্রিয়তা ছিল,৮ থেকে ৮০ সবাই একসাথে উপভোগ করতো,  কিন্তু এখন সেটাও নেই।এখন যাত্রার জনপ্রিয়তা বলতে বোঝায় যাত্রার নামে অশ্লীল নাচের উৎসব। একালে যাত্রা শুধু মাত্র জুয়া খেলা আরা অশ্লীল নৃত্য পরিবেশনা করে টাকা কামানো ধান্দা করছে বড় এক কুচক্রী মহল । তারা বোঝেনা শিল্প কি তারা জানে না শিল্প মান বলে একাটা বিষয় আছে । যদিও আশার কথা যাত্রা শিল্পকে বাঁচাতে নতুন শতকে তৈরি হয় যাত্রা নীতিমালা, ২০১২ সালে যাত্রা নীতিমালা গেজেটভুক্ত হয়। কিন্তু এদেশের প্রতন্ত গ্রাম গুলোতে কিভাবে এই আইনের প্রয়োগ হবে তাই বড় ভাবার বিষয়।

যাত্রাপালার কিভাবে এলো তা নিয়ে এত মতবাদ থাকলেও একটা বিষয়ে সব বিশ্লেষক একমত যে, যাত্রাপালা বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বাংলা শিল্প-সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই যাত্রার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। এই হয়তোবা একসময় শুধু বইয়ের পাতাতেই থেকে যাবে স্মৃতি হয়ে।

Related Posts

8 Comments

মন্তব্য করুন