যুগে যুগে কম্পিউটার

বিশ্ব জুড়ে কম্পিউটারের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। এই যুগ কম্পিউটার ছাড়া প্রায় অচল। প্রতিদিনের কাজে প্রতেকেই কমবেশি কম্পিউটার ব্যবহার করে থাকি। কম্পিউটারের অতীত থেকে বর্তমান অনেকেরই অনেক কিছু অজানা।

বর্তমানে প্রত্যেকেই যে কম্পিউটার ব্যবহার করছি তা কিন্তু প্রথম থেকেই এমনটা হয়ে আসেনি। এর পিছে রয়েছে অনেক বছরের সাধনা।

বর্তমানে আমরা যে কম্পিউটার ব্যবহার করি তার কোনো অস্তিত্বই ছিল না। শুরুতে কম্পিউটার বলতে অনেকগুলো যন্ত্রের সমাহার বোঝাতো যা একটি রুমের পুরোটা জুড়েই সাজানো থাকতো। এরপর হাজার মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম, গবেষণা ও অবদানের ফসল হিসেবে আমরা পাই আজকের দিনের কম্পিউটার।

১৯৪০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত কম্পিউটারের যাত্রা বা অগ্রগতির যে ইতিহাস রয়েছে, তার ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা এটিকে পাঁচটি প্রজন্মে ভাগ করেছেন। চলুন তবে জেনে নিন কম্পিউটার যাত্রার এই প্রজন্মগুলো সম্পর্কে:

প্রথম প্রজন্ম: ভ্যাকুয়াম টিউব (১৯৪০-১৯৫৬)

প্রথম প্রজন্ম: বর্তমান কম্পিউটার বলতে যে যন্ত্রটি বোঝায় তা কিন্তু আজকের অবস্থায় ছিল না। তখন কম্পিউটার অর্থ ছিল বেশ কয়েকটি ছোট-বড় যন্ত্রের মত। এবং সেই কম্পিউটার রাখতে একটি বড় রুমের প্রয়োজন হত। সার্কিট হিসেবে ব্যবহার করার জন্য বড় বড় ভ্যাকুয়াম টিউবের (Vacuum Tube) প্রয়োজন পড়তো। মেমোরির জন্য ব্যবহৃত হতো বেশ কিছু ম্যাগনেটিক ড্রাম।

এই কম্পিউটার রক্ষণাবেক্ষণ করাও অত্যন্ত খরচের ছিল। কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ শক্তির প্রয়োজন হত যন্ত্রগুলো চালানোর জন্য। তাছাড়াও অনেক বেশি পরিমাণে তাপ উৎপন্ন হওয়ার জন্যে প্রায়ই বিকল হয়ে যেত এই কম্পিউটার।

একদমই যান্ত্রিক ভাষার (Machine Language) উপর নির্ভরশীল ছিল তখনকার কম্পিউটার। প্রোগ্রামিং ভাষা এতটাই প্রাথমিক স্তরের ছিল যে একের বেশি কমান্ড বা নির্দেশনা প্রদান করা সম্ভবই ছিল না। এর জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটির বেশি সমস্যার সমাধান করা যেতো না।

কম্পিউটার অপারেটরকে দিন, সপ্তাহ, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাসও পার হয়ে যেতো কোনো নতুন সমস্যার ইনপুট দিতে। পাঞ্চ কার্ড ও কাগজভিত্তিক হতো সেসব ইনপুট। প্রিন্ট করা কাগজে বেরিয়ে আসত সমস্যার সমাধান।
UNIVAC (উনিভ্যাক) ও ENIAC(এনিয়াক) ছিল প্রথম প্রজন্মের দুটি কম্পিউটার। মার্কিন দপ্তর তাদের গণনা কাজের জন্য ১৯৫১ সালে UNIVAC কম্পিউটারের ব্যবহার শুরু হয়। এটি ছিল বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিক্রিত প্রথম কম্পিউটার।

দ্বিতীয় প্রজন্ম: ট্রানজিস্টর (১৯৫৬-১৯৬৩)

দ্বিতীয় প্রজন্ম:
কম্পিউটারের দ্বিতীয় প্রজন্মের পুরোটা জুড়েই রয়েছে ট্রানজিস্টরের সমাহার। প্রথম প্রজন্মের শেষের দিকে এসে ১৯৪৭ সালে বেল ল্যাবে (Bell Labs) ট্রানজিস্টার আবিষ্কৃত হয়। যা ৫০’এর দশকের শেষে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে থাকে। সেই সময় ভ্যাকুয়াম টিউবের পরিবর্তে বানিজ্যিক কাজে ট্রানজিস্টরের ব্যবহার শুরু হয়।

ট্রানজিস্টরের ব্যবহার কম্পিউটারের জগতে এক পরিবর্তনের সূচনা গড়ে তোলে। কম্পিউটারের আকার, আয়তন, গতি, মূল্য সবদিক থেকেই সুবিধাজনক এক পরিবর্তন আসে। এরপরও অনেক পরিমাণে তাপ উৎপন্ন হবার সমস্যাটি রয়ে গেছিল।

তারপর বাইনারি যান্ত্রিক ভাষার পরিবর্তে সাংকেতিক ভাষার প্রচলন শুরু হল। Assembly (অ্যাসেম্বলি) নামের এই কম্পিউটার ভাষা আসার ফলে প্রোগ্রামাররা নির্দেশনা প্রদানের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সুবিধা পেতে শুরু করলেন। কম্পিউটারকে নির্দেশনা প্রদানের জন্য COBOL (কবল) এবং FORTRAN (ফরট্রান) নামের প্রাথমিক পর্যায়ের প্রোগ্রামিং ভাষা তৈরি হয়েছিল। কম্পিউটারের স্মৃতি বা মেমোরির ক্ষেত্রে ম্যাগনেটিক ড্রামের বদলে ম্যাগনেটিক কোরের ব্যবহার ভূমিকা ঘটালো একটি স্টোরেজের মাধ্যমে।

তৃতীয় প্রজন্ম: সার্কিট (১৯৬৪-১৯৭১)

তৃতীয় প্রজন্ম:
তৃতীয় প্রজন্মে ট্রানজিস্টরের আকার এবং আয়তন ছোট থেকে ছোট হতে শুরু করে। কতগুলো ছোট ছোট ট্রানজিস্টরের সমষ্টি হিসেবে তৈরি করলো সিলিকন চিপ। যা সেমিকনডাক্টর (Semiconductor) নামে পরিচিত হয়। এই ‘সমষ্টিগত সার্কিটের ব্যবহার’ গতি ও কার্যদক্ষতার ক্ষেত্রে কম্পিউটারের ধারণা একেবারেই বদলে দেয়।

পাঞ্চ কার্ড এবং কাগজে ছাপানো ব্যবস্থার পরিবর্তে কম্পিউটারের জগতে এলো কি-বোর্ড, মনিটর এবং কম্পিউটার চালানোর জন্য একটি অপারেটিং সিস্টেম (Operating System)। যার জন্য একসঙ্গে একটির বদলে কয়েকটি অ্যাপ্লিকেশন চালানোর ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে অপারেটিং সিস্টেমটি একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা হিসেবে মেমোরিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। আগের তুলনায় কম্পিউটারের আকার, আয়তন অনেকটা ব্যক্তিবান্ধব হয়ে ওঠে।

চতুর্থ প্রজন্ম: মাইক্রোপ্রসেসর (১৯৭১ – বর্তমান)

চতুর্থ প্রজন্ম:
কম্পিউটারের চতুর্থ প্রজন্মের ইতিহাস মানে কিছুটা আধুনিক কম্পিউটারের ইতিহাস। প্রথম প্রজন্মে যে বড় বড় যন্ত্রগুলোর জন্য একটা ঘরের দরকার হত তার পরিবর্তে দেখা মিলল একটা ছোট মাইক্রোপ্রসেসরের (Microprocessor)। যা হাতের তালুতেই রাখা সম্ভব । কম্পিউটারের সবচেয়ে বড় সাফল্য আসে মাইক্রোপ্রসেসর আবিষ্কারের মাধ্যমে।

হাজার হাজার সমষ্টিগত সার্কিট একটি ছোট সিলিকন চিপের মাধ্যমে তৈরি হল এই মাইক্রোপ্রসেসরটি। ১৯৭১ সালে ‘ইন্টেল ৪০০৪ চিপ’ নামক বাজারে এলো মাইক্রোপ্রসেসর। যা শুধুমাত্র একটি চিপের মাধ্যমে সিপিইউ, মেমোরি এবং যাবতীয় সব ইনপুট আর আউটপুট নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

যার জন্যে কম্পিউটার হয়ে যায় একটি টেলিভিশনের মতো। এরপর কম্পিউটারের মূল্য চলে আসে হাতের নাগালে, ব্যবহারের সুবিধা বেড়ে যায় সেই সাথে কাজের ক্ষমতা বেড়ে হয় হাজার হাজার গুণ। এটা থেকেই তৈরি কম্পিউটারই এখনকার ব্যক্তিগত কম্পিউটার (Personal Computer)।

১৯৮১ সালে আইবিএম (IBM) নামক কোম্পানি ব্যক্তিগত পর্যায়ে ব্যবহার করার জন্য প্রথম কম্পিউটার বাজারে ছাড়ল। এর দু’বছর পরেই ম্যাকিন্টশ (Macintosh) নিয়ে বাজারে আসলো অ্যাপল কোম্পানি। শুধু ডেক্সটপ কম্পিউটার নয়, মাইক্রোপ্রসেসরের ব্যবহার শুরু হল দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করা প্রায় প্রতিটি যন্ত্রে। মাইক্রোপ্রসেসর আসার পর পাল্টে গেলে সারা ইলেকট্রনিক্স দুনিয়া।

তারপর ছোট আয়তনের কম্পিউটার তৈরি নিয়ে গবেষণা শুরু হল। অফিসে ব্যবহৃত কম্পিউটারগুলোকে একসাথে করার জন্য তৈরি হল একটি নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা। এরপর এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই তৈরি হল ইন্টারনেট। সেটি আজ আমাদের জীবনের এক বিশেষ অংশ।

পঞ্চম প্রজন্ম: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (বর্তমান ও ভবিষ্যৎ)

পঞ্চম প্রজন্ম:
কম্পিউটারের পঞ্চম প্রজন্ম বা বর্তমান সময়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) নিয়ে অনেক রকম গবেষণা শুরু হয়েছে। আমাদের প্রতিদিন জীবনে ব্যবহৃত কম্পিউটার এবং মোবাইলে কীভাবে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে শুরু করা হয় অনেক গবেষণা। যার ফলে আমরা ‘ভয়েস রিকগনিশন’ এবং কণ্ঠস্বরের সাহায্যে কমান্ডিং। মাইক্রোসফট, গুগল ও অ্যাপলের মতো কোম্পানি তাদের পিসি সেই সাথে স্মার্টফোনে সার্থকতার সঙ্গে এই সুবিধা প্রদান করেন। প্যারালাল প্রসেসিং (Parallel Processing) মুহূর্তের মধ্যে অনেক কাজ একসাথে করতে সাহায্য করে থাকে।

  1. এর বাদেও ‘রোবোটিক কম্পিউটিং’ নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। মানুষের স্বাভাবিক ভাষা ও কথোপকথন পুরোপুরি শনাক্ত করে কম্পিউটারের একটি নিজস্ব শিক্ষণ ব্যবস্থা এবং একটি নিজস্ব মেরামত ক্ষমতা নিয়ে আসবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কম্পিউটার।

Related Posts