রোমান্টিক গল্প। রোদের ছায়া। আজফার মুস্তাফিজ

গল্প: রোদের ছায়া
লেখক: আজফার মুস্তাফিজ

অনেকদিন পর মায়ার দেখা পেলাম। তাকে ঠিক আগের মতোই মনে হলো। একটা ছোট্ট মেয়ে তার আঙুল ধরে দাঁড়িয়ে। প্রচণ্ড রোদ। মাথার ওপর ছাতা ধরে রেখেছে সে। তবুও একদম ঘেমে নেয়ে উঠেছে। মুখে বিরক্তির ছাপ। “উফ”, কপালের ঘাম ঝেড়ে ফেলল সে। তার মেয়েটি উত্তপ্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে বারবার বলছে, ” আম্মু! কোলে নাও না।” সেও পরিশ্রান্ত। একটু ছায়াময় স্থান খুঁজে বেড়ায় মায়ার চঞ্চল চোখ দুটো। কিন্তু পায় না। মানুষের ভীড়ে বিশ্রামের অবকাশ নেই।
আমি যে এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছি, সেটা সে বুঝতে পেরেছে। তাতে তার বিরক্তি ভাব কিছুটা বর্ধিত হয়েছে। সে কি আমাকে চিনতে পেরেছে? চেনার কথা কি! নাহ, অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। সময়ের অগোছালো ঝড় ঝাপটাই কয়েকটা বছরের কিছু বেশি! হয়তো অনেক বেশি। অদল বদলও তো কম হয়নি। নিজের বাহ্যিক বদল তো অনেক বেশিই হয়েছে।
অনেক স্মৃতি মনে পড়ে যায়। কত স্মৃতির পাখি উড়ে যায় মাথার ওপর দিয়ে। কিচিরমিচির শব্দে যন্ত্রণা হয় আমার। কঠিন যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণার অনুভূতি বেশিক্ষণ বয়ে বেড়ালে নিশ্চিত জ্ঞান হারাবো না হয় প্রাণ!

তার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কয়েক মুহুর্ত। মস্তিষ্কের ধুলো ময় জঞ্জাল খানা থেকে পরিচয় মিলিয়ে দেখতে হয়তো কিছু সময় লাগবে তার।
অবশেষে সে চিনেছে আমাকে।
“তুমি?”
আমার হাঁসি চওড়া হলো, “হ্যাঁ, আমিই। চিনতে পারলে তাহলে! আমি তো ভেবেছিলাম আমাকেই পরিচয় দিতে হবে। ”
“না চেনার কী আছে!” বলল সে।
“অনেক কিছুই তো থাকার কথা। এই যেমন আমি অনেকটা বদলে গেছি।”
সে ভদ্রতা সূচক হাঁসি দেয়। সম্পূর্ণ মিথ্যা হাঁসি। “তোমার আশ্চর্য ধাঁচের কথা বলার স্বভাব আজীবন রয়ে গেল।”
“যে সব কথাকে আশ্চর্যজনক ভেবেছিলে তুমি, তা সবই নিছক ফাজলামি। আমাকে ফাজিল হিসেবেও আখ্যায়িত করা উচিত ছিল তোমার।”
তার মাথাটা নিচ হয়ে গেল। চোখে চোখে কীসের লুকোচুরি করছে সে?
“কেমন আছো তুমি?” চোখে চোখ রেখে বললাম আমি।
সে চোখ সরিয়ে নিয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “ভালোই, আলহামদুলিল্লাহ।”
তার মেয়ের দিকে তাকালাম আমি। দেখতে তার মতো না। শুধু চোখ দুটো তারই! একদম মিলে যায়।

মায়া বলল, “তুমি তো অনেক ভালো আছো নিশ্চয়। যে গাড়ী থেকে নামলে সেটা তো অনেক দামী মনে হয়। হাত ঘড়ি টা দেখি রোলেক্সের। গলায় মোটা সোনার চেইন পরাটা একটু বেশিই বড়োলোকি হয়ে গেছে। তোমার পোশাক, পায়ের জুতো জোড়াও দেখছি বিলাশ বহুল ব্রান্ডের। অনেক বড় হয়ে গেছ নিশ্চয়! তোমার সাথে দেখা হওয়ায় আজ আমি খুব খুশি।”
সে যে আমাকে এতো খুঁটিয়ে দেখেছে! তার মানে নিশ্চয় মায়া আমাকে আগেই চিনতে পেরেছিল। রাস্তার পাশে গাড়ির সামনের অংশের ওপর বসে থাকাটা চোখে পড়ার মতোই। সে কি দেখেও না দেখার ভান করে ছিল?

আমি তার দীর্ঘ বক্তব্যের উত্তর দেওয়ার কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তার কাছে ভালো থাকার সমীকরণ খুব অদ্ভুত। যদিও আমি তার সমীকরণ অনুযায়ী রেখা টানার প্রচেষ্টাতে রয়েছি।
তারপর আমি বললাম, “আচ্ছা এখানে, এতো রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
“একটু কাজ ছিল আর কি!”
“একাই এসেছ?”
“না, স্বামির সাথে। আসলে পাশেই তার অফিস।আজকে ছুটি নিয়েছিল। এখানেই আসার কথা তার। একটু বাইরে বেড়ানোর প্ল্যান রয়েছে। ফোন দিয়েছি, পাঁচ মিনিটেই চলে আসবে বলেছে। আর তুমি এখানে?”
“আমার কোনো ঠিক নেই। এমনিতেই গাড়িতে করে ঘুরাঘুরি করি। আজ এখানে তো কাল ওখানে।” আমি হাসার চেষ্টা করলাম। তবে কথাটা নিজের কাছেই খুব খাপছাড়া শোনাল। তাই হাঁসি ফোটাতে কষ্টই হলো।
“বাহ, বিখ্যাত লেখকেরা কী এমনই হয়?”
“লেখক আবার কীভাবে হলাম!”
“কেন আগে তো খুব গল্প টল্প লিখে পড়তে দিতে। বাদ দিলে নাকি।?”
“আসলে আগ্রহ পেলাম না আর।”
“ও আচ্ছা।”
আমি সাথে সাথেই বললাম, ” মিথ্যা বললাম। আগ্রহের ব্যাপার না। নিজের বলার মতো কোনো গল্পই নেই। কী লিখব! নিজে খুবই অপ্রতিভাবান। কল্পনা শক্তিও অকল্পনীয় দুর্বল। যে দুই একটা লেখার চেষ্টা করেছি, তা কখনোই ছাপার মতো নয়।”
“তাহলে আজকাল কী করা হচ্ছে?” বলল সে।
“আসলে সাহিত্যের মাঝেই আছি। তবে ভিন্ন ভাবে। বইয়ের ব্যবসার সাথে আছি। বর্তমানে ভালো বিজনেস।”
“বইয়ের দোকান থেকে এতো টাকা পেয়ে গেছ!” তার চোখে বিস্ময়।
“রকমারি.কম’ এর নাম শুনেছ নিশ্চয়। আমি বর্তমানে সেটার সেয়ার হোল্ডার। ভালোই ব্যাবসা জমিয়েছে তারা। মার্কেটে তাদের সেয়ার থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ঠিকই পেয়ে যাচ্ছি। আচ্ছা এতো রোদে না দাঁড়িয়ে গাড়িতে বসলে হয় না? এসি আছে, চলো।”
“আরে না। সমস্যা নেই। ও তো এখনই চলে আসবে।”
তার ছোট মেয়েটা নতুন ফোটা বুলিতে বলল, “চলো না আম্মু। খুব গরম। আর দাঁড়াতে পারছি না।”
মায়া কঠিন চোখে তার দিকে তাকাতেই সে চুপ করে গেল।
তার মোবাইলটা বেজে উঠল। ফোন রিসিভ করে সে চুপ ছিল। শেষে ‘হুম’ বলেই কেঁটে দিল।
“আসলে ওর অফিসে বড় একটা কাজ পড়ে গেছে। তাই নাকি আসতে পারবে না।” এই বলে সে রিকশার উদ্দেশ্যে হাত নাড়ালো।
আমি বললাম, “কোথায় যাবে? চলো আমি নামিয়ে দিচ্ছি।”
“বাসায় চলে যেতে বলল ও।” “ধন্যবাদ। তবে তোমার সাথে আমার সেখানে যাওয়া ঠিক হবে না। লোকে কী বলবে?” সে অনেকটা লজ্জিত হলো। হয়তো সরাসরি কথাটা বলতে চায়নি।
“ওহ আচ্ছা।” আমি হাত বাড়িয়ে জোরে ডাক দিতেই একটা রিকশা চলে এলো।
রিকশায় মেয়েকে উঠিয়ে দিয়ে সে বলল, “একদিন বাসায় চলে এসো। বিয়ে করেছ নিশ্চয়। ভাবিকেও নিয়ে আসবে কিন্তু। জমিয়ে আড্ডা হবে সবাই মিলে। আজ তাহলে আসি!”
আমি সম্মতি জানিয়ে ঘাড় নাড়লাম। বাকি উত্তরের জন্য আর অপেক্ষা করল না সে। রিকশায় উঠে বসল।
“চাচা সাবধানে চালাবেন।” আমি হুডটা উঠিয়ে দিয়ে বললাম। প্রচণ্ড রোদের মাঝে রিকশা চলতে শুরু করল। দূরের রাস্তা মরুভূমির মরীচিকার ন্যায় মনে হচ্ছে।
রিকশা চলে যাচ্ছিল। আমিও পেছন ফিরে হাঁটা শুরু করি। একবার মনে হলো সে পেছনে তাকিয়ে আছে। আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলাম। রিকশাটা আর নেই। হয়তো কোনো গলিতে ঢুকে গেছে। গাড়ির ভেতর বসেই মিউজিক প্লেয়ার চালিয়ে দিলাম। হঠাৎ মনে হলো ঠিকানা টা তো নেওয়া হলো না।
অনুপম রয়ের কণ্ঠে গান বেজে উঠেছে, “লক্ষ্মীটি একবার ঘাড় নেড়ে, সম্মতি দাও আমি যাই ছেড়ে।”
©আজফার মুস্তাফিজ

Related Posts

10 Comments

মন্তব্য করুন