সহিনী | ভৌতিক গল্প | মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম

চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কৃষ্ণপক্ষ।  হাসপাতালের ধারে রোডলাইটের সোডিয়াম আলোয় দেখলাম মর্গের দরজা খুলে একটা লোক বেরিয়ে এল। আশ্চর্য! লোকটা কে? মানুষ না শব ?এতরাতে কি করছিল মর্গে?এখন প্রায় শেষরাত। মাঝরাত্রে রান্নাঘরে বাসন পড়ে যাওয়ার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। খুব পাতলা ঘুম আমার।  একবার আমার ঘুম ভেঙে গেলে দ্বিতীয়বার কিছুতেই ঘুম আসেনা ; তাই রাস্তা দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে হাঁটছিলাম। হঠাৎ অনেক দূরে একটা কুকুর বিকট শব্দে কেঁদে উঠলো। শেষরাতে রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া কম থাকে, এজন্য পরিবেশও নিঃস্তব্দ থাকে। কুকুরের বিদঘুটে শব্দটা আমার কানে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট বিস্ফোরণের মত আঘাত হানে। কুকুরের অবস্থান জানার জন্য একটু পেছন মুড়ে দেখার চেষ্টা করলাম। নাহ! আমার আশেপাশের দুই মাইলের মধ্যে কোন কুকুর নেই অথচ শব্দটার উপস্থিতি পেছনের মনে হচ্ছিলো এক হাতের মত কাছাকাছি স্থান থেকে আসছে। পেছন থেকে দৃষ্টি নামিয়ে মর্গের দিকে চোখ যেতেই চমকে উঠলাম। ভালো করে দেখলাম, লোকটাকে কোথাও দেখা গেল না। চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল। চোখের ভুল! হাসপাতালের লাশকাটা ঘরটা অবশ্য বেশ দূরে। হলদে জং ধরা সরকারি কোয়ার্টারের জানালার পাশ দিয়ে দেখা যাচ্ছে। সামনের জীর্ণ এবড়ো-থেবড়ো রাস্তাটা অজগরের সাপের মত এঁকেবেঁকে চলে গেছে বহুদূর দ।  রাতজাগার ফলে হয়তো আমি চোখে কিছুটা ঝাপসা দেখছি। বছর খানেক ধরে ইনসমনিয়া রোগে ভুগছি। রাতে ভালো ঘুমও হয় না। বই পড়ে,ইংলিশ মুভি দেখে, রহস্যজনক পত্রিকাদি করে কিংবা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে, সিগারেট টেনে রাত কাটে। ভাগ্যদেবীও আজকাল আমার সহায় হননা। যেদিকে তাঁকাই সেদিকেই ব্যর্থতা। অল্প কয়েকদিনে নির্জন এই শহরটাও আমার বেশ ভালো লেগে গেছে। অনুন্নত কিংবা এবড়ো-থেবড়ো হলেও ছিমছাম নির্জন পথঘাট। ঘুমন্ত দোকানপাট, ঘরবাড়ি। লাল রঙের নিঝুম রেলস্টেশন। শীতল সর্পিল রেললাইন। হলুদ-হলুদ সরকারি কোয়ার্টারস। প্রাচীন মন্দির। অ-দূষিত বাতাস। চারপাশের মানুষগুলো খুব অতিথিপরায়ণ। লোভ জিনিষটা বোধহয় এদের রক্তে মিশে নেই নতুবা পুরনো মন্দিরের দামি-দামি রত্নাদি অল্প কয়েকদিনেই বেমালুম গায়েব করে ফেলতো। চট্টগ্রামের রামুতে, যেখানে বৌদ্ধমন্দির থেকে কষ্টিপাথরের বৌদ্ধমূর্তি সবার চোখের সামনে থেকে তুলে নিয়ে যেতে পারে ;আর এখানে তো নির্জন আর নিঃস্তব্দ শহর। এখানে, প্রতিবাদ করার মতনও হয়তো কেউ নেই।

আমি নির্জনতাপ্রিয় একজন মুখচোরা স্বভাবের মানুষ। ফটোগ্রাফির নেশা মেটাতেই এই শহর নামধারী অজপাড়াগাঁয় আসা। পুরোনো স্থাপত্যকর্ম নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি করার চিন্তা-ভাবনা করেছি। আমার দেশের অবহেলিত প্রাকৃতিক রূপ-মহিমাকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি তাই; দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরা। পুরোনো এই মফঃস্বলই প্রজেক্টরের শেষ বিষয়বস্তু। এরপর, বাড়ি ফিরে যাব। কয়েকদিন এখানে থাকার জন্য একটা বাড়িভাড়া নিয়েছি। সামনে বড় সিমেন্ট বাঁধানো একটি চাতাল। চারপাশে ঘন গাছপালা। পঁচা কচুরিপানা ভরা পুকুর। শ্যাঁওলাধরা দেয়াল। চারদিকে লম্বা লম্বা নারিকেল গাছ। বাড়ির পেছনদিকটায় রেললাইন। নিরিবিলি এই
মফস্বল শহরে দিনগুলি বেশ কেটে যাচ্ছে। বিশাল বাড়িতে আমি শুধু একাই। এই অচেনা মফঃস্বলে এসে ছোট্ট একটা রূমের অনুসন্ধান করলে বিশাল এই বাড়ির সন্ধান মিলে। বাড়ির কেয়ার-টেকার জানায়, বাড়ির মালিক দীর্ঘদিন ধরে জার্মানির হামবার্গে আছেন। তাঁরা বাংলাদেশে কোনদিন আর ফিরবেনা। বাড়িটা তাই পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়ে গেছে । গ্রিক স্থাপত্যকলার মত মোটা মোটা কলামে তৈরী বাড়ি, বিশাল বিশাল জানালার কপাটগুলো রঙিন কাঠের তৈরী, দরজার পাল্লাদ্বয় অনেক লম্বা লম্বা। বস্তুত,  বাড়িটা বেশ আকর্ষণীয়। আকাশকে এ বাড়িতে ডেকে পাঠালে মন্দ হতোনা, বাড়ি নিয়ে ভৌতিক দু’চার কথা নিশ্চই শুনিয়ে দিত। আকাশ বেঁচারা সবকিছুতেই ভৌতিক ভৌতিক গন্ধ পায়। বাড়ির কেয়ার-টেকার আমার হাতে চাবির থোরা গুঁজে দিয়ে ছুটি কাটাতে নিজ গাঁয়ে ফিরে গেলেন।
“দোতলায় মোটেও উঠা চলবেনা, মাঝরাতে ঘর থেকে বেরোনো চলবেনা। ঘরে অবৈধকর্ম করা চলবেনা ইত্যাদি ইত্যাদি” –
বাড়ি যাবার আগে অবশ্য সাবধানবার্তাগুলো দিয়ে যেতে ভুললেননা ভদ্রলোক। ভদ্রলোক চলে যাওয়ার পর বিকেলবেলা আমার দেখ-ভাল ও ছোট-খাট কাজ-কর্মের জন্য একজন লোক খুঁজে আনলাম। মিশমিশে কালো থলথলে শরীর। শার্ট-প্যান্টে একেবারেই মানায় না। ছেলেটা তবুও নিজের কোমড়ের চেয়ে বড় একটা হাফ-প্যান্ট পড়ে আছে।  মাথাটা মুড়িয়ে রাখা। মাথার তালুও কালো। সেই কালো তালুর মাথায় খোঁচা খোঁচা চুল। কানে ছোট্ট একটা পিতলের রিং। ছেলেটা মানে নিহারঞ্জন, সন্ন্যাস ধর্ম নিয়েছে কিনা বোঝা গেল না। কথা কম বলে। তবে কথাবার্তায় অনেকবারই অসংলগ্নতা টের পেয়েছি। তবে নিহারঞ্জনের রান্নার হাত ভালো। আর বেশ বিশ্বস্ত। রাতে অবশ্য চোখ লাল থাকে তার। নেশাটেশা করে মনে হল। বাজার সদাই নিহারঞ্জই করে। মাছমাংস খায় না দেখি। নিহারঞ্জন মনে হয় গৃহসন্ন্যাসী। ছেলেটার চেহেরা কালো হলেও বেশ মায়া মায়া ভাব আছে। মাঝবয়সী নিহারঞ্জনের দুঃখজনক দিক হলো বেঁচারা বোবা, কথা বলতে পারেনা।  মুখাভিনয় করে তাকে কথা বোঝাতে হয়। তবুও, দিনগুলো বেশ যাচ্ছিলো।

বিকালবেলা। সূর্য পশ্চিম আকাশে অস্ত যাচ্ছে। রক্তাভাব লাল রঙে আকাশ ছেঁয়ে আছে। ক্যামেরাটা নিয়ে দূরের আকাশের কিছু ছবি তুললাম। হঠাৎ ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হল। দেখলাম কাছের একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে ‘রহমান শেঠ’ দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখেই সালাম দিল। লোকটার
বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। রেলওয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সে। থাকে পিছনের রেলওয়ে কলোনিতে ।রহমান শেঠ বিপত্নীক। একটি মেয়ে বাবার সংসারে থাকে । মধ্যবয়েসি মেয়ের নাম সহিনী। সহিনী মফঃস্বলের প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করছে। কয়েকদিন আগে মফঃস্বলে ভূতের ভয় নিয়ে সহিনীকে দায়ি করা হয়।সেদিন অবশ্য আমি হ্যালুসিনেশনের সংজ্ঞা দিয়ে পুরো ব্যাপারটা  এলাকাবাসীদের ভেঙে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। রহমান শেঠ সেটা মনে রেখেছেন। মাঝেমধ্যে দেখা হলে সালাম দেয়। রহমান শেঠ বলল,রিকশা নিবেন ? ডাইকা দিমু? না,না। আমি হেঁটেই যাব। বিসটি তো। অসুবিধে নেই। বলে হাঁটতে থাকি। বড় রাস্তায় খানিক হেঁটে বাঁয়ে মোড় নিলে কালিবাড়ির গলি। সে গলি পেরিয়ে হাসপাতালের মর্গের পিছন দিয়ে মিনিট দশকের পথ । কালিবাড়ির গলিটা বেশ সরু। গলিতে কিছুক্ষণ হাঁটার পর ঝিরঝির বৃষ্টিটা থেমে উজ্জ্বল আলো ফুটে উঠল। গলির বাঁ পাশে একটা কালো রঙের লোহার গেইটের সামনে দেখলাম আসগর আলী সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। ভদ্রলোক আমার মোটামুটি পরিচিত। সাংবাদিক। এখন অবশ্য রিটায়ার্ড করেছেন। ভদ্রলোক আমাকে দেখে কেন যেন গেইটের ভিতরে ঢুকে যেতে চাইলেন। তার আগেই
আমি সালাম দিয়ে বললাম,

‘কেমন আছেন?’
আসগর আলী সাহেব মুহূর্তেই চেহেরা পাল্টে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললেন,আরে ইয়াংম্যান যে- খবর কী? ভালো বললাম। বলে মৃদু হাসলাম।আসগর আলী লোহার গেইটটা খুলে বললেন,এসো এসো। বাসায় এসো। এক কাপ চা খেয়ে যাও। গেইটের
দু’ধারে ছোট্ট শ্রী-হীন জংলা বাগান। বাগান মানে কাঁটাগাছ, লতা গাঁদাফুল আর এঁটে কলার অযাচিত ঝোপ। আসগর সাহেবের পিছু পিছু তাঁর বাড়িতে ঢুকলাম। দূর শহর থেকে ছবি তুলতে এসেছি জেনে মফস্বলের ছেলে-বুড়ো সকলে খুব আদর-অাপ্যায়ন করছে। ব্যাপারটা আমি যে উপভোগ করছি তা কিন্তু নয়!

আসগর সাহেবও বিপত্নীক। মফস্বলের একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম, এখানকার প্রায় পুরুষই বিপত্নীক। আসগর সাহেব আমার চিন্তা করার, এই অল্প সময়টুকুতে দু-কাপ লেবু চা নিয়ে বসার রুমে আসলেন। তাঁর আচরণ যতই পাগলাটে হোক, চায়ের স্বাদ কিন্তু দারুন হয়েছে। ভাবলাম, যাওয়ার সময় রেসিপিটা জেনে নিতে হবে। বৃদ্ধ বললেন,হুমম হতে পারে। তেমনটা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। অতি সাধারণ মানুষের ভিতরেও সুপ্ত প্রতিভা থাকতে পারে। যেমন- আমার চা তৈরী করার রেসিপি, বলে হো হো করে হাঁসতে থাকলেন।শোন একটা ঘটনা বলি। তখন আমি সাটুরিয়া থানায় সাংবাদিকতা করতাম। সেই সময়টায় আমি তন্ত্র,শবসাধনা এসব নিয়ে খুব পড়াশোনা করছিলাম। বয়স কম ।টগবগে যুবক ছিলাম তাই জানে সাহস ছিল। রাতবিরেতে শ্মশানে-গোরস্থানে ঘুরে বেড়াতাম। ঘাপটি মেরে বসে থাকতাম। আমি আতকে উঠে বললাম, বলেন কী! হ্যাঁ। আমি একটা বিষয়ে আগ্রহ বোধ করলে তার শেষ দেখেই তবে ছাড়ি,বুঝলে। বুঝলাম। তা আপনি শ্মশানে- কবরস্থানে মাঝরাতে ঘাপটি মেরে বসে থাকতেন কেন? বলে ছোট্ট চুমুকে
চা-টুকু শেষ করে কাপটা সামনের বেতের টেবিলের ওপর রেখে দিলাম। বৃদ্ধ বললেন, হাতেনাতে শবসাধকদের ধরব বলে। ধরতে পেরেছেন কখনও? আমার নিঃশ্বাস প্রায়
বন্ধ হওয়ার যোগার। হুমম। একবার ধরেছি। হঠাৎ আমার গতকাল রাতের কথা মনে হল। বলে ফেললাম, আসগর সাহেব কাল রাত্রে অদ্ভূত এক দৃশ্য দেখলাম। কি বল তো শুনি? বৃদ্ধ ঝুঁকে পড়লেন। দেখলাম মর্গের দরজা খুলে একটা লোক বেরিয়ে এল।তখন অনেক রাত। এই ধরুন শেষ রাত। হুমম। তো? আসগর সাহেব স্থির চোখে আমার দিকে চেয়ে আছেন। চশমার কাঁচে কুয়াশা জমে আছে। বড় বড় দুটি কর্নিয়া দেখা যায়। তবে কাঁচ এত ঘোলা হওয়ায় তিনি দেখছেন কীভাবে তা ঠিক ভেবে পেলাম না। বললাম, না,মানে…। আসগর সাহেব আমাকে থামিয়ে দিয়ে নিজের কাহিনী বলা শুরু করলেন, এরপর আমি চট্টগ্রামের বোয়ালখালি জেলায় বদলি হয়েছিলাম। সদরের উপকন্ঠে কর্ণফুলী নদীর ধারে কবরখানা। এক মধ্যরাত্রে একটা ছাতিম গাছের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে আছি। দেখি গুটিশুটি পায়ে কে যেন এসে কবরের মাটি খুঁড়তে লাগল। গিয়ে জাপটে ধরলাম। কে সে? তমিজ্জুদিন সরকার। তমিজ্জুদিন সরকার! ঠিক আছে,ধরলেন। তারপর? আমার কৌতূহল চরমে উঠেছে। ধরার পর কতক্ষণ চলল ধস্তাধস্তি। তমিজ্জুদিন সরকার-এর বয়স তখন এই আঠারো কি উনিশ। টেনে- হিচঁড়ে ঘরে নিয়ে এলাম। কিছুতেই বলবে না কবরখানায় কেন গিয়েছিল। সে যা হোক। ওকে ধীরে ধীরে থেরাপি দিয়ে সুস্থ করে
তুললাম। এখন ও সুস্থ। তবে আবার কেন পালাল ঠিক বুঝতে পারছি না। পালিয়েছে মানে? প্রায়ই তো পালায়। পাজী,নচ্ছাড় ছেলে একটা। বলতে বলতে আসগর সাহেব
হাই তুললেন । বললেন,আমার এখন ঘুম পাচ্ছে । তুমি না হয় চুপটি করে বস। আমি ঘন্টাখানেক ঘুমিয়ে নিই। না। না। আমি ঘুমান। আমি এখন যাই। পরে সময় করে
একদিন আসব। বাইরের বৃষ্টিটাও কমেছে,মোবাইলের আলোতে ঠিক পথ চিনে চলে যেতে পারবো।

চারপাশে ঘন কালো অন্ধকার। রাস্তাটাও বোঝা যাচ্ছে না। কাঁদামাটির উপর দিয়ে হাঁটার সময় কাঁদাপানি জুতোয় উঠে জুতো চটচট শব্দ করছিলো। দূরের ল্যাম্পপোস্টটার ধারে একজন লোককে দেখা গেল, কিছু একটা পিঠে করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে । আমি লোকটাকে ধরার জন্য একটু দ্রুত পা চালালাম। অদ্ভুত ব্যাপার ! লোকটার দিকে যতই এগিয়ে যাচ্ছি, লোকটা মনে হচ্ছে তত দূরে চলে যাচ্ছে। কিছুতেই অন্ধকারের ছায়ামূর্তিটাকে পেছনে ফেলতে পারছিনা। মাঝপথে হঠাৎ নিহারঞ্জনকে বসে থাকতে দেখলাম। এরপর, লোকটাকে আবার দেখার চেষ্টা করলাম, কোথাও দেখলাম না। নিহারঞ্জনকে আজ বেশ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে থাকতে দেখলাম। কালিমন্দিরটাকে বাঁয়ে ফেলে মর্গটার সামনে দিয়ে বাড়িতে যেতে হবে। কালিমন্দিরের সামনে এসে, অনেক দিনের পুরাতন রঙ চটে যাওয়া একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়লো। বড় বড় করে লেখা,
“পুরাতন সামগ্রীর দোকান” নীচে ছোট্ট করে লেখা এখানে বিভিন্ন প্রকার পুরাতন সৌখিন সামগ্রী পাওয়া যায়।রাস্তার অপর পার থেকে সাইন বোর্ডটা পড়ল। এই পথ দিয়ে অনেক বার আসা যাওয়া হয়েছে কিন্তু মন্দিরের এখানে দোকান আছে বলে মনে করতে পারছিনা। কৌতুহলীর বশবর্তীতে রাস্তা পার হয়ে নিহারঞ্জনকে নিয়ে দোকানটাতে ঢুকলাম। নিহারঞ্জন ছটফট করছে, হাত ধরে বাসার দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ব্যাপারটা আমার কাছে দুঃখজনক লাগলো, হালকা একটা ঝাড়ি দিয়ে ওকে দমিয়ে দিলাম। ছেলেটা মন খারাপ করে রাস্তার অপর প্রান্তে গিয়ে চুপটি করে বসে রইলো। দোকানের মালিক দোকান বন্ধ করার তোড়জোড় করছে। আমি একা-একাই দোকানটায় ঢুকলাম। দোকানে ঢুকতেই পুরোনো জিনিসের সোদা গন্ধটা নাকে আঘাত করল। গন্ধটা নাকে সামলে নিয়ে দোকানের ভিতরে এসে দাড়ালাম। বেশ বড়-সড় দোকান । দোকানে বেশির ভাগ আসবাবপত্রই ভাঙা-চোড়া । নকশা করা চেয়ার, টেবিল ,পালংকে ভর্তি । বেশ বড় কয়েকটা আলমারী ও আছে। দোকানের কাউন্টারের পিছনের তাকে সারি সারি সাজানো আছে কাচের জিনিসপত্র। কয়েকটা মাটির তৈরী বিভিন্ন রকমের মূর্তিও আছে। মূর্তিগুলো অদ্ভুত সুন্দর । ছোট্ট একটা আলমারীর উপর একটা নারী নগ্নমূর্তি। প্রায় দেড় ফুট লম্বা অপুর্ব সুন্দর চেহারার নারী মূর্তি। পরনে নীল রংয়ের অন্তর্বাস আঁকা। কপালে লাল রংয়ের গোল টিপ আঁকা ।সামনে বাম দিকে ভরাট বুকের স্তন্যের উপর দিয়ে লম্বা ঘন চুলগুলো কোমর পর্যন্ত ছড়ানো। হালকা ত্রি-ভংগীমায় দাড়ানো, মুখে এক চিলতে মিষ্টি হাসি, মাদকময় দৃষ্টিতে কেমন যেন রহস্যময় আহ্বান। মূর্তিটার দিকে অপলক দৃষ্টতে তাঁকিয়ে রইলাম। মূর্তিটা থেকে যেন চোখ সড়াতে পারছিনা,

“স্যার, নেবেন নাকি মূর্তিটা ? একদম কম দামে দিয়ে দেব, দোকানের শেষ কাষ্টমার আপনি”

ছিপছিপে দেহের মাফলার দিয়ে মুখ ঢেকে রাখা সেলস ম্যানের কথায় ধ্যান যেন ভাঙলো। মানুষের সহজাতপ্রবৃত্তিবশত জিঙ্গাসা করলাম,

‘মূর্তিটা কোথাকার ?’

“আপনি যে বাড়িতে আছেন সে বাড়ির। বর্তমান কেয়ারটেকার পুরাতন ভাংগা জিনিস-পত্রের সাথে বেঁচে দিয়েছিলো।”

খুট খুট করে কাশতে থাকা সেলসম্যান মুর্তিটা আলমারীর উপর থেকে নামিয়ে আমার হাতে দিয়ে বলল আর যাই বলুন
মুর্তিটা যে বানিয়েছে, সে খুবই দক্ষ কারিগর এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই। হালকা মাথা নেড়ে সহমত প্রকাশ করলাম। আমার কাছে মনে হচ্ছিলো, পুরো সময়টা একটা ঘোরের মাঝে অবস্থান করছি। মূর্তিটা এক হাতে নিয়ে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করার জন্য একটু নিচের দিকে ঝুঁকে দাঁড়ালাম। মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে মাথা তুলে তাঁকানোর সময় দেখলাম, চারপাশটা একদম ফাঁকা। বিরানভূমি। আমার বুকটা ধক করে উঠলো। মূর্তিটা হাতে নিয়েই নিহারঞ্জনকে খোঁজার জন্য রাস্তার অন্যপ্রান্তে যাওয়ার জন্য উদ্ধত্য হলাম । রাস্তায় পা ফেলার আগেই পেছন মুড়ে তাঁকিয়ে দেখলাম নিহারঞ্জন চকচকে দৃষ্টিতে আমার হাতের মূর্তিটার দিকে তাঁকিয়ে আছে। ভাবলাম, নগ্ন নারী মূর্তি তাই হয়তো ওভাবে তাঁকিয়ে আছে। তড়িঘড়ি করে নিহারঞ্জনকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসলাম। পথিমধ্যে মর্গের দরজা দিয়ে আজও একজনকে বেরিয়ে যেতে দেখলাম। চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেঁড়ে ফেললাম হয়তোবা ঝাঁড়ুদার হবে। আজ বাড়ি ফিরে বাড়ির কেয়ার-টেকারকে দেখলাম মেঝের উপর পা-দুটো মেলে লেবু চা গিলছে। মেঝেতে একটা বাটিতে কিছু শুকনো মুড়ি। অন্যদিন দেখা হলে লোকটা কত কথাই না বলে কিন্তু আজ কিছুই বলছেনা। হাতের মূর্তিটা বিছানার উপর রেখে হাত-মুখ ধুয়ে নিলাম। হাতের মূর্তিটা পেপার দিয়ে মোড়ানো ছিলো তাই হয়তোবা কেয়ার-টেকারের চোখে পড়েনি।

নিহারঞ্জনকে দেখলাম রান্নাঘরে কি যেনো খুট-খাট করছে। গরুর মাংস ঝাঁল ঝাঁল করে রান্না করেছে আর গরম ভাত। পেটপুরে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ, মাঝরাতে উপরের তলা থেকে ধড়াম ধড়াম করে রণক্ষেত্রে যুদ্ধের দামামার মত শব্দ হচ্ছিলো। ব্যাপারটা প্রথমে ভেবেছিলাম,  বিড়াল হবে কিন্তু এত জোড়ে শব্দ করার কোন মানে হয়না। আধ-শোয়া হয়ে উঠে বসলাম। ঘুমের রেশটা তখনও কাটেনি। চারপাশ চাঁদের মৃদু আলোয় ভিন্ন অবয়ব সৃষ্টি করেছে। ঝিঁঝিপোঁকা অনবরত ডেকে চলেছে। বিছানা ছেড়ে রূমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। কিন্তু কোথাও কোনকিছুই দেখতে পেলাম না। একটু অবাক হলাম। শব্দটাও থেমে এখন বড় বড় হাড়ি-পাতিল পড়ার শব্দে রূপ নিয়েছে। বাড়ির উপরে তলায় উঠার নিয়ম-কানুন ছিলোনা। কেয়ার-টেকার বাড়ি ভাড়া নেওয়ার সময় বারবার সাবধান করে দিয়েছিলেন, দ্বিতীয়তলায় যেন ভুলেও পা না ফেলি। শব্দটা ধীরে ধীরে বাড়ছে, কেয়ার-টেকারের রূমে গিয়ে দেখলাম তিনি রূমে  নেই।

দক্ষিন পাশের জানালা দিয়ে প্রচন্ড বাতাসের শো শো শব্দ,অথচ বাইরে বাতাস নেই। জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম,না বাতাস বইছে এমন কোনো শরীর জুড়ানো অনুভুতি নেই।বরং গোমট গোমট ভাব পুরো ঘরজুড়ে। শুধু উপরের ঘরে শব্দটা শোনা যাচ্ছে। বারকয়েক নিহারঞ্জনের নাম ধরে ডাকলাম। কোন সাড়া-শব্দ নেই। বাধ্য হয়ে ব্যাগ থেকে টর্চলাইটটা বের করলাম; আর তখনই দেখলাম, আমার বিছানার উপর আসগর আলীর রক্তাক্ত লাশ। চোখগুলো আধখোলা হয়ে যেনো আমার দিকেই চেয়ে আছে। বাঁ হাতটা বাহুর নিচ থেকে ছিলে খাটের তলায় এসে গড়াগড়ি দিচ্ছে,পেটের দিক থেকে
কিছুটা মাংস নেই,ওখান থেকে নাড়িভুঁড়ির
আদলগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো,নাকটা
থেতলে গেছে,চুঁয়ে চুঁয়ে রক্ত পরছে কানের পাশ থেকে।মুহূর্তের মধ্যে আমার ঘরটা রক্তে সয়লাব হয়ে গেলো।আমি আতংকে অস্থির হয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালাম, ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিলো কিন্ত অনুভব করলাম মাথার সেই ভোঁতা যন্ত্রনাটা আর নেই।কিন্ত বুকের পাশে হৃদপিন্ডের কাছাকাছি প্রচন্ড ব্যাথা। আমি বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে দেখলাম আসগর সাহেবের লাশটা নড়ে উঠছে,আমি চিৎকার
দিতে চাইলাম, ইচ্ছে হলো গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার দেই। গলা দিয়ে হালকা বাতাস বের হয়ে এলেও কোন শব্দ হলোনা। আসগর সাহেবের লাশটা তখন উঠে বসে পেট থেকে
খসে পড়া ভুঁড়িগুলো আবার ভেতরে ঠেসে ধরে আমার দিকে তাকিয়ে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো,

“তমিজ্জুদিন বজ্জাতটা এখনও বেঁচে আছে। খুব যন্ত্রনা শরীরে,তুমি পালাও…”

আসগর সাহেব তার হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দেন,আঙুলগুলো মাংসহীন কংকাল।চোখগুলো বাইরে এসে দুলছে, কোটরে অজস্র পোকা কিলবিল করছে। আসগর আলীর বিভৎস দেহ দেখে আমার মাথা চারদিকে ঘুরতে থাকে। ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসি। বাড়ির সদর দরজায় দেখলাম, শ্বপদ দন্তবিশিষ্ট এক ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। অস্তিত্ত্ব টিকিয়ে রাখা এখন আমার মূল উদ্দেশ্য। দোতলায় উঠে বড়রূমের দরজা খুলে দৌড়ে রূমের ভিতরে ঢুকে গেলাম। জানালা দিয়ে দেখছি ছায়ামূর্তিটা আরো কাছে চলে আসছে। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় বাড়ির শেষ বাতিটাও ভেঙে গেল। সাদা ময়লামাখা পর্দাগুলো দপদপ করে উড়ছে। জানালার কপাটগুলো একের পর এক দেওয়ালের সাথে বারি খাচ্ছে। হঠাৎ করে কেউ একজন আমার কাধে হাত রাখলো ভয় পেয়ে আৎকে উঠে বললাম,
‘কে! কে আপনি?’

বেশ গম্ভীর স্বরে এক কন্ কনেস্বরে অল্পবয়স্ক মেয়ে বলল,
” ভয় পেওনা আমি সহিনী।  “

‘সহিনী! রহমান শেঠের মেয়ে ?’
মিনমিনে গলায় বললো, আমি সহিনী!  সেই সহিনী। মনে পড়ে, আজ থেকে পাঁচ বছর আগের কথা। সারারাত নৃশঃসভাবে দেহ ভক্ষণের পর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মেরে ফেলেছিলি। সেদিন তুই অভুক্ত ছিলি কিন্তু আজ আমি ভুখা। মূর্তিটার স্তন্যগুলো খুব পুষ্ট তাইনা!
আজ আমি আমার পিপাসা মেটাবো। মনে হচ্ছিল,আমার দাঁড়িয়ে থেকেই মৃত্যু ঘটবে! আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের গভীর আওয়াজে হঠাৎ মেয়েটা জন্তুর মত গড়গড় শব্দ করে আমার দিকে ঘুরে তাকাল । সে এক অদ্ভুত, ভয়ংকর চেহারা। বুকের উপর গোলাকার এক মাংসের স্তূপ। সেখানে চোখ, নাক, ঠোঁটের কোন অস্তিত্ব নেই, গলে গলে পড়ছে। বুকের উপরে মাংসের পিণ্ডটি অনেকটা তরল জাতীয়, কেঁপে কেঁপে উঠছে ! সহিনী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাঁকিয়ে আছে; চোখহীন অথচ ভয়ানক প্রখর সে দৃষ্টি, মুখে সূক্ষ্ম হাসির রেখা। নিহারঞ্জনকে একটু দূরে উঁবু হয়ে বসে থাকতে দেখলাম। বাইরের চাঁদের আবছা আলোতে স্পষ্ট দেখলাম, নিহারঞ্জন সিলিং থেকে ঝুলে পড়া একটা মেয়ের উন্মুক্ত শরীরের বুক এর মাঝখান থেকে ধরে একটানে সোজা নামিয়ে ফেলল নাভি পর্যন্ত। সাথে সাথে ফিনকি দিয়ে ছুটল রক্ত পড়া। কোত্থেকে এক গ্লাস পানি এনে ঢেলে দিল সেই রক্তের উপর। সাথে সাথে ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে গেল অনেক রক্ত। অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছিলো মেয়েটা অনেক মোটা ছিল- সারা শরীরে ভর্তি চর্বি। এবার কেমন যেন আমার গা গুলিয়ে উঠলো। নিহারঞ্জন তখনো আয়েশ করে হলদে চর্বি খেয়ে চলছে। রূম থেকে বের হওয়ার কোন দরজা খুঁজে পাচ্ছিলামনা। জীবনের শেষ নিঃশ্বাসের কথা ভেবে বারংবার দোয়া-দূরুদ পড়ে চলছি। সহিনী তার শ্বপদদন্ত নিয়ে আমার দিকে ভয়ংকর দৃষ্টিতে এগিয়ে আসছে। ছুটে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি ওই অভিশপ্ত রূম থেকে। নিজের ভবিষ্যত
টের পেয়ে গেছি আমি। উল্টো ঘুরে ছুটতে যেয়েই হোঁচট খেয়ে হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মেঝেতে পড়ে যাই। মেঝেতে একটা নরম শীতল কোন কিছুর একেবারে উপরে নিজেকে আবিষ্কার করে। বুঝতে দেরি হয় না, কোন পঁচে যাওয়া লাশের একেবারে ওপরে এসেই পড়েছি। ইচ্ছার সবটুকু দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। কিন্তু হাত পা যেন অবশ হয়ে গেছে একেবারে। অবশেষে কিছু গভীর আঁশটে গন্ধ নিতে নিতে জ্ঞান হারাই…

চারপাশে পাখির কিচিরমিচির শব্দ। জন-মানবের কর্মব্যস্ততার শব্দ। সবকিছু মিলিয়ে সকালের কাঁচামিঠা রোদ এসে মুখে লাগতেই উঠে বসি। রাতের কথা মনে পড়তেই, নাহ!  একি সত্যিই আমি বেঁচে আছি। আমার সারা শরীর এত ব্যাথা কেন ? কোনরকমে উঠে দাঁড়িয়ে ধীর পায়ে দ্বিতীয়তলা থেকে নেমে আসি। শরীরে বিভিন্ন রকমের আঁচড়ের চিহ্ন। বাড়ির কেয়ার-টেকার হাসিমুখে বলে, সারারাত ছিলেন কোথায়। ভোরবেলা এসে আপনাকে ডাকলাম দরজা বন্ধ ছিল ভেবে আর ডাকি নি। দরজা বন্ধ ! স্তম্ভিত চোখে তাঁর দিকে তাঁকিয়ে থাকি। আপনি ভোরবেলায় এসেছেন ? তাহলে !  নিহারঞ্জন!  নিহারঞ্জনকে দেখেছেন ?

কে নিহারঞ্জন ? নিহারঞ্জন নামে তো পুরো এই মফস্বলে কেউ থাকেনা। অবশ্য অনেক আগে একজন ছিলো। সহিনী নামের একটা মেয়েকে ভালোবাসতে। এক ভরা বৃষ্টির রাতে ঐ মেয়েটার ধর্ষণ করা দেহ বাজারে পরে থাকতে দেখা যায়, এরপরদিন শেষরাতে হাসপাতালের মর্গে নিহারঞ্জনের দেহটাও পড়ে থাকতে দেখা যায়। আফসোস! ছেলেটা বোবা ছিলো, তাই হয়তো মড়ার সময় কাউকে ডাকতে পারে নাই ! – বাড়ির কেয়ার-টেকার কি যেন বিড়বিড়িয়ে আনমনে   হয়ে অন্যদিকে হাঁটতে লাগলেন।

নিহারঞ্জন নেই ?এতদিন তাহলে!  মাথার নিউরণগুলো কাজ করছেনা। সকালবেলা হাত-মুখ ধুঁয়ে নাস্তা করতে বাজারে চলে গেলাম। কিছু প্রশ্ন আমার মনে তখনো ঘুরপাক খাচ্ছে। চায়ের দোকানে কয়েকজন বৃদ্ধকে দেখলাম কি একটা বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করছে। কিছুটা দূরে রহমান শেঠকে দেখলাম, মাথা নিঁচু করে দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে,

‘আসসালামু-আলাইকুম, কি অবস্থা আপনার’

“ভালোনা বাবা-“- কান্নামিশিত কণ্ঠে বললেন রহমান শেঠ।

‘কেন, কোন সমস্যা ?’

“মা মরা মেয়েটা শেষ-মেষ আমারে ছাইরাও চইল্যা গেলো”- বলতে বলতে তিনি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।
শক্ত হাতে ওনাকে ধরে রাখি।

কিহ! সহিনীর মৃত্যুসংবাদ আমার অন্তরে যুদ্ধের দামামা বাঁজার শব্দে বেঁজে উঠে। তাহলে কাল রাত্রে ! রহমান শেঠের দিকে আমি আমার সংশয় মোচন করার জন্য শেষ প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিই। আসগর আলী সাহেবের কথা কিছু জানেন। গতকাল দুপুরে তাঁর ঘরে তাঁর লাশ পাওয়া যায়, জানেন না ? সন্ত্রাসীর কাজ, পেটে ছুরি মাইরা ভুড়ি বাইর কইরা ফেলছে।রহমান শেঠের শেষ কথাটা আমার মাথার প্রতিটা নিউরণ ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন করে দেয়।

চারপাশে না তাঁকিয়ে আমি উদভ্রান্তের মত দৌড়াতে থাকি। পেছন মুড়ে তাঁকালে হয়তো দেখতাম, বিদায় না জানিয়ে চলে আসার মত অশোভন আচরন দেখে রহমান শেঠ আমার গতিপথের দিকে বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে। রূমে ঢুকে ব্যাগের জিনিষপত্র দ্রুত হস্তে ঢুকাতে থাকি। প্রয়োজনী-অপ্রয়োজনীয় সব একসাথে ব্যাগে ভরে নিই। বাড়ির কেয়ার-টেকারের হাতে দুই-হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে রেলস্টেশনে চলে আসি। বাড়ির কেয়ার-টেকার হতভম্ব হয়ে আমার আতঙ্কগ্রস্ত চেহেরার দিকে তাঁকিয়ে থাকে। সেদিনের পর থেকে কখনো আমি সেই মফস্বলে আর ফিরে যায়নি।জীবনের কালোতম একরাতের ইতি টেনে এসেছিলাম হয়তোবা আমারও……

পরদিন, সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফিরে আসি। চেহেরার এমন বেহাল অবস্থা দেখে আম্মা তো হট্টগোল বাঁধিয়ে দেয়। সামান্য চেহেরা নষ্ট হওয়ায় হট্টগোল বাঁধিয়ে দিয়েছি, সেদিন রাত্রের কথা জানালে কি করতো সেটা ভেবে আমার হাঁসি পায়। কয়েকদিন পর জীবন-যাপন স্বাভাবিক হয়ে উঠলে ব্যাগপত্র থেকে প্রয়োজনীয় জিনিষগুলো একে একে বের করতে থাকি। প্রায় দেড় ফুট লম্বা অপুর্ব সুন্দর চেহারার নারী মূর্তি। পরনে নীল রংয়ের অন্তর্বাস আঁকা। কপালে লাল রংয়ের গোল টিপ আঁকা ।সামনে বাম দিকে ভরাট বুকের স্তন্যের উপর দিয়ে লম্বা ঘন চুলগুলো কোমর পর্যন্ত ছড়ানো। হালকা ত্রি-ভংগীমায় দাড়ানো, মুখে এক চিলতে মিষ্টি হাসি, মাদকময় দৃষ্টিতে কেমন যেন রহস্যময় আহ্বান। স্তন্যটা সত্যিই খুব পুষ্ট!

মূর্তিটাকে দেখে যতটা না অবাক হই তাঁর চেয়ে বেশি অবাক হই মূর্তিটা আমার ব্যাগে এলো কিভাবে। মূর্তিটাকে আমি বাসায় আসার আগে বাড়ির পুরোনো জলায় ফেলে দিয়েছিলাম। কিন্তু ! হঠাৎ কেয়ার-টেকার বুড়োর কথা মনে পড়লো।একদিন বাড়ির ইতিহাস বলার সময় কথায় কথায় বলেছিলেন, চাবিটা যেন ঘরে না ঢুকে! কেয়ার-টেকার চাচা কি ধরনের চাবিরতোড়ার কথা বলেছিলেন, আজ আমি বুঝতে পারছি। নগ্ন নারীমূর্তিটাই ছিলো মূল চাবি। ভরা বৃষ্টির রাত, মূর্তি। সবকিছু আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। সেই থেকে বৃষ্টির রাত্রে আমার ঘুম হয়না। রাত হলেই ঘরের দরজায় মনে হয়, জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে, তিনজন লোক অপেক্ষা করছে প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে, যেই ক্ষুধা মেটাবার সাধ্য কারও নেই।
অদ্ভুত তাদের চেহেরা, অপূর্ব  তাদের শিকার-কৌশল ।

আজকে বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে।  বারান্দায় ধবধবে সাদা পর্দাটা ফ্যানের বাতাসে বারবার উড়াউড়ি করছে। জানালা দিকে তাঁকিয়ে অন্ধকার রাতের বৃষ্টি দেখছি। পর্দাটা উড়াউড়ির সময় হঠাৎ দেখলাম নগ্ন নারীমূর্তিটা তার ভাঙা মাটির দেহ নিয়ে আমার দিকে কূঢ় দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে। চিৎকার করে বলছে,
“আমি সহিনী ! আমার হাত থেকে কারো নিস্তার নেই!কারোও,আমি আমার প্রতিশোধ একাই নিয়ে ক্ষ্যান্ত হব “

বিছানার উপর ব্যবচ্ছেদ করা অবস্থায় একটা লাশ পড়ে আছে। চোখগুলো কোটর থেকে তুলে নেয়া হয়েছে। দোতলার ফ্ল্যাটের কার্নিশ থেকে ঈষৎ গরম তরল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। বৃষ্টির ঠান্ডা পানির সাথে লাল গরম রক্ত মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। শেষরাত। বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশ ফর্সা হয়ে আসছে। এমন সময় দূরে কোথাও একটা কুকুর ডেকে উঠলো, সত্যিই কি কুকুর! ….উ..উ..উ

(সমাপ্ত)

Related Posts

10 Comments

মন্তব্য করুন