স্বার্থের কাছে পরও আপন মনে হয়

গোলাপ সবসময় বুঝতে পারে না যে, গোলাপ ফুলের কাঁটাই গোলাপ ফুলকে সর্বদা রক্ষা করে। আমারাও আমাদের আশেপাশে অনেক উপকারীদের উপকার সময়কালে বুঝতে পারিনা, উপলব্ধি করতে পারি না। যখন বড় ক্ষতি হয়ে যায়, তখন বুঝতে পারি ভুলটি আসলে কোথায় ছিল এবং কি হারালাম। মানুষের জীবনটাই বুঝি এমন, উপকারী আপনজনের ভালবাসার মর্মার্থ মানুষ সময়কালে বুঝতে পারে না। সকল হারিয়ে, সর্বস্বান্ত হয়ে বোঝে। মানুষের প্রকৃতিই এমন যে, সে যে প্রিয়জনকে কাছে পেতে চায়, সে তাকে চায় না; যে তাকে কাছে পেতে চায় না, সে তাকেই চায়। বড় রহস্যময় মানুষের মন। যতটুকু দৃশ্যমান হয়, অদৃশ্য থাকে এর শতগুণ। এরমধ্যেই আমরা প্রতিদিন সম্পর্ক গড়ি এবং সম্পর্ক ভাঙি।

জীবনে অর্থ বিত্ত এবং সৌন্দর্য নিয়ে খুব একটা অহংকার করতে নেই। কখন যে কার অবস্থান কোথায় হবে, কেউ বলতে পারে না। আজ যে মাথায়, কাল সে সময়ের ব্যবধানে পায়ে তলায় চলে যেতে পেরে। তালগাছের মাথা হয়ত, দেখা যায় না, সে অনেক উঁচু; কিন্তু এ মাথাটি কোন পূজায় লাগে না।পক্ষান্তরে দূর্বাঘাসগুলোরকে সবাই পায়ে মাড়িয়ে যায়, কিন্তু সে দেবতাদের চরণে যেমন আশ্রয় পায়, তেমনি প্রয়োজনে মানুষের মাথাতেও আশ্রয় পায়। আমরা কাউকে আশীর্বাদ করতে, পায়ে মাড়ানো দূরর্বাঘাসকেই মাথাতে দেই, যাতে দুর্বার মত সে দীর্ঘজীবী হতে পারে।

স্বার্থে পরে ভালবাসার মানুষ দূরে চলে গেলে দুঃখ পাওয়ার কিছুই নেই, মেনে নিতে হবে এটাই জীবন। এখানে ক্ষণিকের স্বার্থে মানুষ আপন হয়, ক্ষণিকের স্বার্থে পর হয়। যে সম্পর্কগুলো দ্রুত তৈরি হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দ্রখা যায় সে সম্পর্কগুলো দ্রুতই ম্লান হয়ে ভেঙে যায়। সিলভারের কড়াই যেমন দ্রুতই গরম হয়, তেমনি দ্রুতই ঠাণ্ডা হয়। এর গরম হতেও সময় লাগে না, আবার ঠাণ্ডা হতেও সময় লাগেনা।যাপিত জীবনে সম্পর্কগুলো, এ কারণে একটু সময় নিয়ে তৈরি করলে ভাল, মানুষ চেনা যায়। মমতাশূন্য এ জগতে আমরা সবাই অভিনেতা। প্রতিনিয়ত অভিনয় করে যাচ্ছে। কাছের মানুষ পর হতে একদণ্ডও লাগে না, প্রয়োজনেই তাদের স্বার্থের হিংস্র দাত নখগুলো যখন তখন বেড়িয়ে আসে। বিষয়টি যে শুধু বর্তমানে হচ্ছে তা নয়, মহাভারতের যুগেও হয়েছে। তাইতো মিথিলার রাজা রাজর্ষি জনকের মুখে বলতে শোনা যায়, তিনি মিথিলা সহ সারা পৃথিবী হন্যে হয়ে ঘুরেও মমতা রূপ ভালবাসাকে পাননি।

 

প্রেমিক প্রেমিকা নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমাদের মানুষের ভেতরের অন্তঃস্থিত ভালবাসার প্রতি দৃষ্টি থাকা উচিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দৃষ্টি থাকে সৌন্দর্য এবং সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থানে। কে বড় সরকারী কর্মকর্তা, কে বড় ব্যবসায়ী, কে বড় রাজনৈতিক নেতা ইত্যাদি। অতিরিক্ত নগরায়ন মানুষকে স্বার্থপর করে তোলে।বর্তমানে শিক্ষার কারণে, মুখে হয়ত আমারা অনেক মানবিক তত্ত্বকথা বুলি আউড়ে যাই। কিন্তু পেটে থাকে এক স্বার্থের ক্ষুধার্ত হিংস্র কুমির। সম্পর্কের সামান্য নাড়াচাড়াতে নারীপুরুষ নির্বিশেষে এ কুমির অনেক সময়েই তার নিজ স্বরূপে বাইরে বের হয়ে আসে। মানুষ তখন কাছের মানুষকে বুঝতে পারে, চিনতে পারে। সাময়িক ব্যাথা পায়, হৃদয় ভেঙে যায়, আবার সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে সকলই ভুলে যায়। কাছের মানুষের সাথে যখন টাকা পয়সার সম্পর্ক চলে আসে, তখন তাদের ভালমন্দ দু’টি রূপই প্রকাশিত হয়ে যায়।

বিপদকালে মানুষের স্বার্থপর রূপটি ভয়াবহ রূপে প্রকট হয়। বর্তমান করোনাকালে হৃদয়বিদারক বিভিন্ন ঘটনাগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে চারিপাশের স্বার্থপর নিষ্ঠুর চেহারাখানাগুলো। তাহলে কি কবি সাহিত্যিকদের বলা কথাগুলোই আজ সত্যি হচ্ছে, এ পৃথিবীতে কেউ কারো নয়, সবই স্বার্থপর জগতের লোকদেখানো মায়ার খেলা।

এ সম্পর্কগুলো তো বটেই, মানুষ অনেক সময়েই কাছের মানুষের অবদানকে ভুলে যায়। তাদের অবদান এবং ভালবাসাকে মূল্যায়ন করতে পারে না। বিষয়টি কবি নজরুল ইসলামের একটি গানে অত্যন্ত সুন্দর করে আছে।কবি বলেছেন, গান সমাপ্ত হয়ে গেলে গানের পাখিকে কেউ মনে রাখে না। সবাই চাঁদের জ্যোৎস্নাকে চায়, কিন্তু এ জ্যোৎস্নার উৎস চাঁদকে কেউ খুঁজতে যায় না। সবাইকে প্রতিনিয়ত আলো দিতে কত প্রদীপের প্রাণ যে পুড়ে কাল হয়ে যাচ্ছে; আমরা কতজন এর খবর রাখি। জগতে একজনকে নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসতে গিয়ে আরেকজন হয়ত নিঃশব্দে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, আমরা টেরই পাচ্ছি না।ভালবাসার প্রকাশ কেউ করতে পারে, অনেকেই পারে না; তাদের ভালবাসা আমৃত্যু অপ্রকাশিতই থেকে যায়।

 

স্বার্থের সুতোয় টান পড়লে মানুষ কেন পরিবর্তিত হয়, এর উত্তরগুলো আমরা সবাই জানি, আবার মাঝেমাঝে মনে হয় কিছুই জানি না। যত জানি ততই জানি না। বিষয়গুলো কখনো স্পষ্ট, কখনও অস্পষ্ট কিম্ভূতকিমাকার রকমের। কাছের মানুষকে খুব বেশী অগ্রাধিকার দিলে, সময় দিলে, সে তখন দূরের হতে চায়। তাই সম্পর্কগুলো মধ্যপন্থায় দুজনের বিশ্বাসের উপরে প্রতিষ্ঠিত রাখতে হয়। জীবনে অহেতুক যাকেই বেশী অগ্রাধিকার দেয়া হয়, সেই তখন তাকে অবমূল্যায়ন করতে চায়।সম্পর্কের মধ্যে অবিশ্বাস ঘুণপোকার মত। ঘুণপোকা একবার কাঠে ধরলে কাঠকে শেষ করেই তবে ছাড়ে । কাছের মানুষকে মাঝেমধ্যে বোঝাতে হয়, একজনকে অন্যজনের প্রয়োজনীয়তা, তবেই সম্পর্ক দৃঢ় হয়। কারো জন্যেই জীবন থেমে থাকে না। আজ মনে হচ্ছে যাকে ছাড়া একদণ্ড বাঁচব না, সম্পর্ক ভেঙে গেলে; এ কথাগুলোই মনে পড়লে হাসি আসবে। নিজের পাগলামির জন্যে, নিজেকেই তখন জোকার মনে হবে। তবে হ্যাঁ, কিছু সত্যিকারের ভালবাসার অনুভব মানুষের মনে চিরস্থায়ী দাগ কেটে যায়। মানুষ হাজার প্রচেষ্টাতেও এ দাগ মুছতে পারে না। হয়ত মোছার প্রয়োজনও পরে না।জীবনে কাঁদানো এবং কাঁদা একই মুদ্রার এপিট আর অপিট। মানুষ শুধু সময়ের ব্যবধানে নিজের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফলাফল ভোগ করে চলে; এর কিছু থাকে দৃশ্যমান, অধিকাংশই হয় অগোচরে।

 

Related Posts