হঠাৎ এক‌দিন বদ‌লে গে‌লো জীবন

জলপাই র‌ঙে‌র সালোয়ার কা‌মিজের উপর সোনাসী র‌ঙের রেশমি সুতা দি‌য়ে ডিজাইন ক‌রা ড্রেসটা প‌রে, মাথার চুলগু‌লো পিছ‌নে একটা বেনী ক‌রে‌ছি । কা‌নে ছোট্ট এক জোড়া দুল । চো‌খে একটু কাজল দেই দেই ক‌রে অার দেওয়া হ‌লো না । হা‌তে হাত ঘ‌ড়িটা পর‌তে পর‌তে ঘর থে‌কে বে‌রি‌য়ে এলাম । ত‌ড়িঘ‌ড়ি ক‌রে বের হ‌তে গি‌য়ে দরজার সাম‌নে একটা ইটের সা‌থে হুঁচট খেয়ে, প‌ড়ে যে‌তে যে‌তে নি‌জে‌কে কো‌নো রকম সাম‌লে নিলাম । অার একটু হ‌লেই প‌ড়ে গি‌য়ে ব্যথা পেতাম ।

বড় বড় কদম ফে‌লে মোটা‌মো‌টি দৌ‌ড়ের উপর স্টেশ‌নে এসেই দে‌খি, মীনা অার সন্ধ্যা দা‌ড়ি‌য়ে অা‌ছে । অামা‌কে দে‌খে দু’জ‌নেই ব‌লে উঠ‌লো, কি রে এতো দে‌ড়ি কর‌লি কে‌নো ? ট্রে‌নের ‌তো খবর হ‌য়ে গে‌ছে দশ মি‌নি‌টের ম‌ধ্যে চ‌লে অাস‌বো । অা‌মি বললাম, একটু কাজ ছি‌লো রে ।

পাঁচ মি‌নিট পর বা‌ড়ি থে‌কে বের হ‌লে ট্রেনটা অাজ মিস করতাম নির্ঘাত । অামা‌দের বা‌ড়ি থে‌কে বা‌রো কি‌লো দূ‌রে সদ‌রের ক‌লে‌জে অামরা তিন বান্ধবী রোজ ‌ট্রে‌নে ক‌রে গি‌য়ে ক্লাস ক‌রি ।অামা‌দের মত অারও অ‌নে‌কেই অা‌ছে যারা রোজ এই ট্রে‌নের নিয়‌মিত যাত্রী । কেউ ক‌লেজ ক‌রে কেউ অ‌ফি‌সে যায় । দশ মি‌নিট পর ট্রেনটা এসে হা‌জির । অাজ ট্রেনটা একদম রাইট টাই‌মে চ‌লে অাস‌ছে । বে‌শি ভাগ সময় প‌নে‌রো বিশ মি‌নিট লে‌টেই অা‌সে । ট্রেন লে‌টে অাস‌লে সমস্যা নেই, প্রয়োজ‌নের তা‌গি‌দে যাত্রীরা অ‌পেক্ষাই ক‌রে । সমস্যা হ‌চ্ছে ঐ যাত্রীদের যারা লে‌টে অাসে ।তা‌দের জন্য তো অার ট্রেন অ‌পেক্ষা কর‌বে না । ট্রেন চল‌বে তার নিয়‌মে ।

অামরা ‘গ’ নাম্বার ব‌গি‌তে উঠে গেলাম । একটু সাম‌নে অাগা‌তেই সন্ধ্যা একটা সিট পে‌য়ে ব‌সে কোচকাচ ক‌রে মীনাকেউ ব‌সি‌য়ে দি‌লো । ওরা যে সিটে ব‌সে‌ছে ঐ সি‌টে জানালার পা‌শে একজন ছে‌লে ব‌সে অা‌ছে বিধায়, অামা‌কে বসা‌তে পার‌ছে না । পা‌শে ম‌হিলা মানুষ থাক‌লে তার গা ঘে‌ষে চাপাচা‌পি ক‌রে হ‌লেও অামা‌কে ব‌সা‌তো । অা‌মি দা‌ড়ি‌য়ে অা‌ছি দে‌খে মীনা এক চোখ টি‌পে বলল, তুই অামার কো‌লে বস । অা‌মি ও‌কে এক ধমক দি‌য়ে বললাম, চুপ থাক তো । দা‌ড়ি‌য়ে থাক‌তে অামার কো‌নো সমস্যা হ‌চ্ছে না ।

অামা‌দের কথা শু‌নে জানালার পা‌শে ব‌সে থাকা ছে‌লেটা উঠে দা‌ড়ি‌য়ে বল‌লো, অাপ‌নি অামার সি‌টে বসুন । অা‌মি বস‌তেই চা‌চ্ছিলাম না । ছে‌লেটা এতো ক‌রে রিকু‌য়েস্ট কর‌ছি‌লো যে না ব‌সে পারলাম না । একটা ধন্যবাদ দি‌য়ে জানালার পা‌শে ব‌সে গেলাম । মীনা অামার দি‌কে চে‌য়ে অার একবার চোখ টিপ‌লো । এ চোখ টিপার মা‌নে হ‌লো ” এর জন্যই তো‌কে কো‌লে বস‌তে ব‌লে‌ছিলাম । যা‌তে ক‌রে ছে‌লেটা যেন তো‌কে বস‌তে দেয় বুঝ‌লি ” অা‌মি ওর চোখ টিপার মা‌নে বু‌ঝে একটু মৃদু অাসলাম ।

ট্রেনটা ছে‌ড়ে দি‌য়ে‌ছে অা‌মি বাই‌রের দি‌কে তা‌কি‌য়ে অা‌ছি । ছু‌টে চলা জীবন ঝক্ঝক্ ক‌রে এগি‌য়ে যা‌চ্ছে সদ‌রের দি‌কে । ছে‌লেটা দা‌ড়ি‌য়ে অা‌ছে । তার গা‌য়ে সাদা র‌ঙের ফুলহাতা শার্ট । হাতাটা কনুই‌য়ের কা‌ছে ভাজ ক‌রে রাখা । জি‌ন্সের নীল র‌ঙের প্যান্ট পা‌য়ে কা‌লো র‌ঙের জুতা । চেহানায় কেমন যেন একটা ভদ্রতা ভদ্রতা ভাব । হঠাৎ ছে‌লেটা প‌কে‌টে রাখা মোবাইল ফোনটা বে‌জে উঠ‌লো । ছে‌লেটা রি‌সিভ ক‌রে বলল, হ্যাঁ মা এই তো প্রায় চ‌লে অাস‌ছি । অার বিশ ত্রিশ মি‌নিট মত লাগ‌বে বাসায় পৌছা‌তে । ব‌লে ফোনটা রে‌খে দি‌লো । কথা শু‌নে বুঝলাম সাম‌নে যে স্টেশ‌নে অামরা নাম‌বো ছে‌লেটাও সে স্টেশ‌নেই নাম‌বে । স্টেশ‌নে চ‌লে অাসার অাগ মুহু‌র্তে ছে‌লেটা বলল, সি‌টের নি‌চে একটা ব্যাগ অা‌ছে একটু এগি‌য়ে দি‌বেন প্লিজ । উপ‌রে রাখার জায়গা পাই‌নি তাই নি‌চে রে‌খে‌ছি । অা‌মি হ্যাঁ অবশ্যই ব‌লে নিচু হ‌য়ে ব্যাগটা ‌সি‌টের নিচ থে‌কে বের কর‌তে গি‌য়ে কিছুটা ব‌্যথা পেলাম । আহ: ক‌রে উঠ‌তেই ছে‌লে‌টি বলল, সাবধা‌নে বেশ ভা‌রি কিন্তু অাপ‌নি শুধু একটু টে‌নে নিচ থে‌কে বের ক‌রে দেন বা‌কিটা অা‌মি দেখ‌ছি ।আ‌মি টে‌নে বের ক‌রে দিলাম ।

<

ব্যাগটা হা‌তে নি‌য়ে অামা‌কে ধন্যবাদ দি‌য়ে, সে দরজার দি‌কে অাগা‌তে থাক‌লো । অামরাও উঠে দরজার দি‌কে এগি‌য়ে যা‌চ্ছি । ‌পেছন ফি‌রে ছে‌লেটা বলল, অাপনারাও এখা‌নে নাম‌বেন ?
সন্ধ‌্যা বলল, জ্বি ।
ক‌লে‌জে যা‌চ্ছেন বু‌ঝি ?
হুম ।
‌ট্রেন থে‌মে গে‌লো, অামারা নে‌মে ক‌লে‌জে চ‌লে গেলাম, ছে‌লে‌টি বা‌ড়ি চ‌লে গে‌লো । তার ঠিক, দু‌দিন পর ক‌লেজ থে‌কে বের হওয়ার সময় ছে‌লে‌টি‌কে গে‌টে দা‌ড়ি‌য়ে থাক‌তে দে‌খে কিছুটা অবাক হলাম । আমরা তিন জন একজন অ‌রেক জ‌নের মু‌খের দি‌কে তাকালাম । মীনা একটু ফিক ক‌রে হে‌সে দি‌লো । অামরা এ‌গি‌য়ে যা‌চ্ছিলাম অামা‌দের‌কে আরও বে‌শি অবাক ক‌রে দি‌য়ে ছে‌লে‌টি পিছন থে‌কে “এই যে শুন‌ছেন ?” ব‌লে ডে‌কে বসল ।

আমরা দাড়ালাম, ছে‌লে‌টি কা‌ছে এ‌সে আমা‌কে বলল, অাপনা‌র নাম‌ কি তমা ? অা‌মি বললাম কেন ? আমার নাম দি‌য়ে অাপ‌নি কি কর‌বেন ? কি দরকার অাপনার ? ‌ছে‌লে‌টি বলল, ভ‌য়ের কিছু নেই । আ‌মি অাপনার ভা‌লোর জন‌্যই বল‌ছি অাপ‌নি কি তমা ?
না আ‌মি তমা নই ।
আস‌লে, সে‌দিন বা‌ড়ি ফি‌রে আমার ব্যাগের  ‌চে‌ইনের সা‌থে একটা ব্রেস‌লেট পে‌য়ে‌ছি  সেটা‌তে ডিজাইন ক‌রে তমা লেখা ।আ‌মি ম‌নে ক‌রে‌ছি সেটা অাপনার । যাই‌ হোক অামার ম‌নে হয় ভুল হ‌য়ে‌ছে  বল‌তেই আ‌মি তা‌কে থা‌মি‌য়ে দি‌য়ে বললাম, ব্রেস‌লে‌টের কথা অা‌গে বল‌তে পার‌লেন না ? দুই দিন ধ‌রে খুঁ‌জে  খুঁ‌জে পাগল হ‌য়ে যা‌চ্ছি ।
আপ‌নি যে বল‌লেন অাপনি তমা নন ।
আ‌মিই তমা ব্রেস‌লেটটা দিন ।

ছে‌লেটা একটা হি‌সে‌বি হা‌সি হে‌সে প‌কেট থে‌কে ব্রেস‌লেটটা বের ক‌রে দিল । সে‌দিন গা‌ড়ি‌তে ওনার ব‌্যাগ এগি‌য়ে দেয়ার সময় ম‌নে হয়  কো‌নোভা‌বে তার  ব‌্যা‌গের চেইনের সা‌থে আট‌কে গি‌য়ে থাক‌বে । আ‌মি প্রথ‌মে তা‌কে নাম না বললার জন‌্য স‌রি , অার প‌রে জি‌নিসটা ফেরত দেয়ার জন‌্য ধন‌্যবাদ জানালাম ।

‌সে‌দি‌নের পর থে‌কে ছে‌লেটা নানা অজুহা‌তে অামার সা‌থে যোগা‌যোগ করার চেস্টা ক‌রে‌ছে । কিন্তু আ‌মি পাত্তা দেইনি । প্রায় পাঁচ মাস পর হঠাৎ ক‌রে বাবা অামার বি‌য়ে দি‌বে ব‌লে ঠিক ক‌রে‌ছে । ছে‌লে ব‌্যাং‌কের ম‌্যা‌নেজার ‌দেখ‌তে শুন‌তে না‌কি ভা‌লো । এমন পাত্রকে মানা ক‌রে‌ দি‌লে নাকি বিরাট বড় ভুল হ‌বে । আমা‌কে দে‌খে পছন্দ হ‌লেই বি‌য়ে পাকাপা‌কি হ‌য়ে যা‌বে ।

আ‌মি পাত্রপক্ষের সাম‌নে ব‌সে আ‌ছি । একেক জন এ‌কেক প্রশ্ন কর‌ছেন আ‌মি মাথা নিচু ক‌রে সবার প্রশ্নের উত্তর দি‌য়ে যা‌চ্ছি । ‌যে পা‌ত্রের এ‌তো প্রশংসা শু‌নে‌ছি তা‌কে দেখার ই‌চ্ছে যে নেই তা কিন্তু নয় । কিন্তু মাথা উচু ক‌রে তাকা‌তেই কেমন ভয় ভয় কর‌ছে । তবু সাহস ক‌রে মাথা তু‌লে তাকাতে এমন এক ঝটকা খেলাম নি‌জে‌কে সামলা‌তে বেশ কিছুটা সময় লে‌গে গে‌লো । চো‌খে চোখ পড়‌তেই, ইসারা ক‌রে বোঝা‌তে চাই‌ছে হ‌্যা আ‌মি, এতো সহ‌জে পিছু ছাড়ার মানুষ নই ।

হ‌্যা এই মানুষটা অামার পিছু ছা‌ড়ে‌নি । এখন অামা‌দের মাথার উপর একটাই ছাদ । সেই ছাদের  নি‌চে অামা‌দের সাজা‌নো গোছা‌নো সংসার ।

Related Posts

9 Comments

  1. খুবই ভালো লাগলো আপু।
    আরেকটি কথা আপনাকে জানাতে চাই, “অ” -অক্ষরটির সাথে “া” যোগ করে “আ” বানাবেননা। এতে করে পোস্ট পাবলিশ হওয়ার পর “আ” অক্ষরটি “অা” এভাবে দেখায়..

    “আ” -অক্ষরটি সরাসরি কি-বোর্ড থেকে খুঁজে তারপর লিখার চেষ্টা করুন।

মন্তব্য করুন