“ছয় যুগ ধরে”
গত ছয় যুগ ধরে আপন খুঁজেছি
পৃথিবীর প্রান্তরে কত বনে জঙ্গলে
শত শত কাঁটাসিক্ত পথ অতিক্রম করেছি
অজস্র হিংস্র জন্তুর নিবাসে কড়ানেড়েছি
প্রতিবার রক্তাক্ত করেছে কাঁটাতারের বেড়া
রক্তাক্ত করেছে কাঁটাসিক্ত পথ
দেহকে ছিন্নভিন্ন করেছে বন্য পশুরা
আগুন আর জলের ভাপে সুস্থ করেছে অপরিচিতা
অসুস্থ মস্তিষ্কে বাহুডোরে বাঁধার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছি
বিদায় দিয়েছে সৌজন্যতা বলে।
গত ছয় যুগ ধরে আপন খুঁজেছি
নীড়হারা পাখিদের সাথে উড়ে উড়ে
কত ঝড়ঝাপটা সামলেছি প্রখর আত্মবিশ্বাসে
যোজন যোজন মাইল পাড়ি দিয়েছি জল পিপাসা নিয়ে
মেঘে-রা ডানা ভারী করেছে চরম উপহাসে
মৃত্যুর সাথে সাক্ষাৎ করেছি হিমালয় শিখরে
কোনো এক অভিযানী বাঁচিয়ে তুলেছে পরম মমতায়
তাঁকেও আদুরে কণ্ঠে প্রেম নিবেদন করছি
সেও ফিরিয়ে দিয়েছে বিমুখ হয়ে
ফিরে এসেছি ঠাঁই নিতে মানুষের বুকে।
গত ছয় যুগ ধরে আপন খুঁজেছি
কত নদী কত ঘাটে
কত সাগর কত হাটে
শত জনকে বিভোর স্বপনে নিজস্বতায় রেখেছি
শত জনকে বুকের সাথে লেপ্টে একাকার করেছি
দিন শেষে সবাই মুছে দিছে পরিচয়
ভুলে গেছে আত্মার আত্মীয়তা
অস্বীকার করেছে হৃদ্যতার সম্পর্ক
সবাই অকপটে বলেছে ভুলে যাও, ভুলে গেছি!
আজ সত্যিই ভুলে গেছি ক্ষত
ভুলে গেছি আপন না পাওয়ার বেদনা
সময়ে উপলব্ধি হয়েছে আপন কেউ হয় না।
গত ছয় যুগ ধরে আপন খুঁজেছি
কোথাও কাউকে পাইনি, কাউকে পাইনি।
রচনা কাল: ৮জুলাই ২০২১ ইং।
“এ যুগের কবিতা”
পৃথিবীতে তখন নিয়ম করে সূর্য উঠতো
বর্ষায় বৃষ্টি হতো
কদম ফুটতো
নদী তার ভরা যৌবন নিয়ে কলকল ধ্বনি তোলে ছুটে যেতো অজানা গন্তব্যে
মাঝিরা নদীর কলকল ধ্বনির সাথে গল মিলিয়ে গান তুলতো
কী নিদারুণ সে গানের সুর
কী মধুময় সে গানের কথা
জীবন আর স্বপ্নের মাঝামাঝি ছিলো আরেকটি সত্য, যা তাদের কর্মঠ হয়ে উঠতে উদ্ভুদ্ধ করতো
এ সত্য তাদের অন্তঃপুরে ঘণ্টির মতো বাজতো
এ সত্য জানান দিতো তোমাদের বাঁচতে হবে
তোমাদের হাত ধরেই আধুনিক সভ্যতা গড়ে উঠবে
সময়ের পরিক্রমায় শিল্পায়ন হলো
আধুনিক সভ্যতার নামে গড়ে তোলা হলো দালান
নৌকার পরিবর্তে জাহাজ
রেলওয়ে-আকাশযান
পৃথিবী তার নিজস্বতায় গৌরব উজ্জ্বল হলো
পৃথিবীর সন্তানেরা আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলো প্রযুক্তিতে
তারা তৈরি করলো মারণাস্ত্র
তারা সক্ষম হলে পৃথিবীকে জিম্মি করতে
তারা ক্ষমতা আর রাজত্বের লড়াইয়ে শুরু করলো ভয়ানক হিংস্রতা
তারা ভুলে গেলো মহাসত্য
ভুলে গেলো সবাই পৃথিবীর সন্তান
তারা রচনা করলো প্রথম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো ঘৃণ্য ইতিহাস
তাদের হাত ধরে ছিটকে পড়লো নদী আর প্রকৃতির সাথে বেঁচে থাকা অজস্র প্রাণ
তাদের তুলির আঁচড়ে আঁকা হলো হৃদয় বিদারক সহস্র দৃশ্য
লাশের উপর শিশুদের হামাগুড়ি
রক্তাক্ত আঁচল
মুছে যাওয়া সিঁদুর!
যা তাদের অমরত্ব এনে দিলো পৃথিবীতে
তাদের আঁকিবুঁকি মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই নিলো
তারা উপাধি পেলো শিল্পী হিসেবে
অনাথ বাচ্চাটার হুহু করা আর্তনাদ নাম পেলো গানে
যে ছেলেটা স্বজন হারিয়ে নিয়মিত মরা নদীর পাড়ে কান্না করতো তাকে উপাধি দেওয়া হলো সুরকার
যে ওই সময়কার পরিস্থিতি নিরসনের জন্য গাধাগাধা প্রতিবেদন তৈরি করলো তাকে উপাধি দেওয়া হলো কবি
এভাবেই আমাদের ঐতিহ্যের সাথে মিশে গেলো শিল্প, গান, সুর ও কবিতা
আমরা প্রত্যেকেই হয়ে উঠলাম শিল্পী, গায়ক, সুরকার ও কবি
ওই সময়টা ধিরে ধিরে কুয়াশার আড়ালে ঢাকা পড়তে আরম্ভ করলো
আর আজ সবাই দিব্যি ভুলে গেছে
ভুলে গেছে সেই নদী ও মাঝির কথা
ভুলে গেছে সেই মাটি ও মানুষের কথা
আজ মনে নেই সেই শিল্পীর আঁকিবুকি
আজ মনে নেই সেই গায়কের গান
আজ মনে নেই সেই করুণ সুর
আজ মনে নেই কবিতার শ্লোক
আজকের শিল্পী, গায়ক, সুরকার, কবির কলম ব্যস্ত প্রেম-প্রিয়তা, বিরহ আর কাতরতায়!
অথচ এ কলমের কাজ ছিলো ক্ষুধা, আশ্রয়হীনতা, অসহায়ত্বকে তুলে ধরা।
তাই এ যুগের কবিতা এমনই হোক;
এসো হে শিল্পী এঁকে লও তারে
যে আজ নিরুপায়
তার ছবিটাই যেন চিরকাল
দেয়ালে শুভাপায়
এসো হে গায়েন গেয়ে নাও
আজই মন খুলে
তোমার গানের তালে তালে
যেন অনাহারী ক্ষুধা ভুলে
এসো হে সুরকার তোলো সেই সুর
যে সুর বাজে মাঝিদের প্রাণে
অভোলা শোক ভুলে যেতে চাই
তোমার এই সুরের টানে
এসো হে কবি অক্ষের ধারে
লিখে যাও কবিতা
তোমার লেখায় ঠাঁই দিও তারে
যে হারিয়েছে স্ব-ভিটা।।
রচনা কাল:১৯ জুলাই ২০২১ ইং।