এ দেশে বিয়েসাদিতে বাদ্যগানের রেওয়াজ যুগ-যুগান্তরের।কালের বাঁকে বাঁকে পাল্টেছে ধরণ। গত কয়েক দশকে এ সংস্কৃতিতে ঘটেছে মস্ত রূপান্তর।
আজকের প্রজন্ম নারীদের বিয়ের গীত গাইতে দেখেছে আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে সিনেমায়, আর শুনেছে বড়দের মুখে। নিজ চোখে দেখার সুযোগ মিলেনি সিংহভাগের। পুস্তকপত্রিকা ঘাটাঘাটি করে জানা য়ায়, সেই প্রাচীনকাল থেকেই এই উপমহাদেশের বিয়েতে নাচ-গানের প্রচলন ছিল। আর এটা করত অন্তপুরের মহিলারাই। বিয়েতে বিশেষ করে হিন্দু বিয়েতে মেয়েলি আচার-অনুষ্ঠানের একটা প্রধান অঙ্গ ছিল মঙ্গলগান। পরবর্তীতে ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতায় মুসলমান বিয়েতেও যুক্ত হয় এই অনুষঙ্গ।
একসময় গ্রামাঞ্চলের স্বচ্ছল বাড়ির বিয়েতে গীত ছাড়া ভাবাই যেত না। বিয়ের নানা আনুষ্ঠানিকতায় মহিলারা গোল হয়ে বসে গীত গাইতো। এদের কারও কারও নাকি সাইড প্রফেশন ছিল উৎসব-অনুষ্ঠানে গান গাওয়া। দূর-দূরান্ত থেকে গীত গাওয়ার ডাক আসতো। আসরে বসেই সরল ছন্দে বর-কনের নামসহ বিয়ের গীতিপয়ার রচিত হতো। পরে এ অঞ্চলের পদ্যপ্রিয় মানুষের মুখে মুখে ওসব ছড়িয়ে পড়তো নানাপ্রান্তে। একখান থেকে অন্যখানে যাওয়ার পথে সব লোকগীতের মতো বিয়ের গানের সুর-ছন্দ-কথায় আঞ্চলিকতার প্রভাবে ঘটতো রূপান্তর।
বিয়ের একেক আয়োজনে একেক ধরনের গীত গাওয়া হতো। যেমন বরকে বরণ করার সময় গীত আনন্দ সুরে ভরে উঠত আবার তেমনি কনের বিদায়ের সময় গীতে দুঃখ বেদনা ফুটে উঠত। বাংলাদেশে আদি সমাজ থেকেই অন্তপুরের মহিলাদের অলংকার হিসাবে বিয়েতে নাচ-গানের প্রচলন ছিল। তারা নিজেরা বংশ পরম্পারায় অনেক যত্নে লালন করতো এ ঘরোয়া পরিবেশনা। আজ থেকে কুঁড়ি পঁচিশ বছর আগেও দেখা গেছে গ্রামের বিয়েতে বিশেষ করে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য ‘গীত গাওনি’ মহিলাদের ডাক পড়ত। তাদের অধিকাংশই ছিলেন নিরক্ষর। এসব গান আঞ্চলিক ভাষায় ও স্বতঃস্ফূর্ততায় নারীদের নিজস্ব ছন্দে রচিত হতো।
শহর কিংবা গ্রাম, কোথাও এখন বিয়ের লোকজ গীত গাওয়া হয় না। কালের ধূলোয় তা চাপা পড়েছে। দেশের আনাচে কানাচে থেকে বিয়ের ঐতিহ্যবাহী গীতিকবিতাগুলো সংগ্রহের তেমন কোনো প্রচেষ্টা বা উদ্যোগও চোখে পড়ে না। চর্চিত না হওয়ায় লোকসংস্কৃতির এসব অমূল্যরতন হারিয়ে যাওয়ার হুমকিতে আছে।
এবার বিয়ের গানবাজনার ধরণ পাল্টে যাওয়ার কয়েকটি ধাপে চোখ রাখা যাক। এমন অনেকেই আছেন যারা বেড়ে ওঠার বয়সে বিয়েবাড়িতে দেখেছেন, টুপিতে রঙিন পালক আর রাজকীয় পোশাক গায়ে কয়েকজন বাজনাদার থেমে থেমে বাদ্য বাজাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর ড্রামের দ্রিমদ্রিম, করতালের ঝমঝমানি আর ট্রাম্পেটের পোঁ পোঁ আওয়াজে গমগম করে ওঠছে বিয়েবাড়ি। কর্নেটে বাজানো সুর ছিল কমন, মালকা বানুর দেশে রে বিয়ার বাদ্যবালা বাজে রে। আর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে বাজতো, হলুদ বাটো মেন্দি বাটো..।
ব্যান্ড পার্টির কদর কমে যায় এমপ্লিফায়ার আর লাউড স্পিকার আসার পর। একসময়ের খানদানি ব্যান্ড পার্টিকে এখন আর কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা যায় না। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে ক্যাসেট প্লেয়ারে গান ছেড়ে লাউডস্পিকার বাজানোর প্রচলম শুরু। প্রায় একই সময় ভিসিআর এবং ভিসিপির আবির্ভাবে দেশে অবাধে ঢোকে পড়ে হিন্দি সিনেমা। বিয়েবাড়ির লাউড স্পিকারগুলোকেও দখল করে নেয় হিন্দি গান। নব্বুইয়ের দশকে ছিল ব্যান্ডসঙ্গীতের জোয়ার। ওই সময় বিয়ে বাড়িতে, বিশেষ করে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে গান গাইতে দেখা যেত ছোটবড় ব্যান্ডগুলোকেই। নতুন শতকে ব্যান্ডের দলীয় চেতনায় মরচে ধরায় আর ডিজিটাল সিনথেসাইজারের চমকে গায়ে হলুদের মঞ্চগুলো দখলে নিতে থাকে সলো আর্টিস্টরা। কমার্শিয়াল মনোভাব নিয়ে গাইতে গিয়ে তারা প্রায় সবাই হিন্দি গানকেই প্রায়োরিটি দিতে থাকেন এবং দিয়েই চলেছেন। বিয়ে বা গায়ে হলুদের গান বাজনার সময়সূচিতেও এসেছে বড় পরিবর্তন। আগে এসব সন্ধ্যার পর শুরু হয়ে মধ্যরাতে শেষ হতো। এখন দেখা যায় রাত ১০টার পর শুরু হচ্ছে, আর লাউডস্পিকারে গান চলছে প্রায় ভোর পর্যন্ত। এতে প্রতিবেশিদের কি যে অসহনীয় যন্ত্রণা, বিয়ে বাড়ির কেউ তা ফিরে দেখে না।
ওয়েডিং পার্টিতে গত কয়েকবছর ধরে গোঁদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মতো চেপে বসেছে ডিজে কালচার। বিজাতীয় বিকট বাজনার সঙ্গে উদ্ভট ভঙ্গিতে হাতপা ছুঁড়ে লাফালাফিতেই আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে আমাদের তরুণপ্রজন্ম। ইদানিং বিয়ের ডিজে পার্টিগুলোতে দেখা যায়, অন্যসবার সঙ্গে নাচানাচিতে অংশ নিচ্ছে বর ও কনে দুজনই। ওদের খেমটানৃত্যে হাত তালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছেন বয়োজ্যেষ্ঠর।
এককালে নবাব-জমিদার পরিবারের বিয়েতে বাঈজি নাচের আসর হতো। বিয়েবাড়ির আজকের ডিজে কালচার কি সেই আসরের অপভ্রংশ, যুগের হাওয়ায় বাঈজি এখন কনে স্বয়ং। বেহায়াপনার এই রীতির আমদানি খুব সম্ভবত ভারতীয় টিভি সিরিয়াল থেকে। ভিনদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন গিলে খাচ্ছে আমাদের ঐতিহ্য। আমরা হয়ে উঠছি আত্মপরিচয় বিস্মৃত ও অনুকরণপ্রিয় জাতি।
<iframe width=”640″ height=”360″ src=”https://www.youtube.com/embed/7oiNMcuNTPo” frameborder=”0″ allow=”accelerometer; autoplay; clipboard-write; encrypted-media; gyroscope; picture-in-picture” allowfullscreen></iframe>