কুরবানীর দিন দুপুরের পর থেকে একটা সাধারণ দৃশ্য সকলেরই চোখে পড়ে। কুরবানীদাতার বাড়ির সামনে একদল মানুষের ভিড়। তাদের কেউ একা এবং কেউ পরিবারসহ, কেউ পেশাদার ভিক্ষুক এবং কেউ গরীব কর্মজীবী, যাদের নিজের কুরবানী দেয়ার সামর্থ্য নেই। আজ তারা সবাই এক কাতারে। কুরবানীর গোশত সংগ্রহের জন্য তারা দলে দলে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরপাক খাচ্ছে। কুরবানীদাতা নিজে বা তার পক্ষ থেকে কোনো লোক তাদের হাতে হাতে এক-দুই টুকরা করে গোশত বিতরণ করছে। হাতে গোশত বিতরণ করছে আর মুখে কাউকে ধমকাচ্ছে, কাউকে তাড়া করছে এবং কারও উদ্দেশ্যে বিশেষ কোনও মন্তব্য করছে।
এ দৃশ্যটা কতটা সুখকর?!! কুরবানী একটি মহান ইবাদত। তার সাথে এ দৃশ্য খাপ খায় কিনা? কুরবানী করা ওয়াজিব (যাদের সামর্থ্য রয়েছে তাদের জন্য) আর গোশত বিতরণ সুন্নত এবং এর গোশত খাওয়াও সুন্নত। ঈদুল আযহার নামকরণই করা হয়েছে এ মহান ইবাদতটির নামে। আল্লাহ তাআলা এ দিন নামায আদায়ের পাশাপাশি কুরবানী করার হুকুম দিয়েছেন। তিনি এরশাদ করেন-
فَصَلِّ لِرَبِّرْ.كَ وَ انْحَ
সুতরাং তুমি নিজ প্রতিপালকের (সন্তুষ্টি অর্জনের) জন্য নামায আদায় কর এবং কুরবানী দাও। সূরা কাউসার (১০৮) :২
প্রথমে নামাযের হুকুম, তারপর কুরবানীর। যেন বলা হচ্ছে- নামাযের মাধ্যমে প্রথমে আল্লাহর সামনে আত্মনিবেদিত হও, তারপর সে আত্মনিবেদনের নিদর্শনস্বরূপ কুরবানী কর। এজন্যই কুরবানী হয় ঈদের নামায আদায়ের পর, তার আগে নয়। হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে-
مَنْ كَانَ ذَبَحَ قَبْلَ الصّلَاةِ فَلْيُعِدْ.
কেউ নামায আদায়ের আগে যবাহ করলে সে যেন নামাযের পর পুনরায় যবাহ করে। সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৫৪৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬২; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৩৯৬; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১৫৩
যেহেতু এ যবাহ কেবলই আল্লাহর উদ্দেশ্যে, সে হিসেবে এর গোশত কারও জন্যই খাওয়া জায়েয না হওয়ার কথা ছিল না কিংবা সকলের জন্য খাওয়া জায়েয হলেও কুরবানীদাতার জন্য খাওয়ার অনুমতি থাকার কথা নয়। কিন্তু মহান আল্লাহ রহমান ও রহিম। তিনি এটা সকলের জন্যই খাওয়া বৈধ করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন-
فَكُلُوْا مِنْهَا وَاَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَ الْمُعْتَرَّ، كَذٰلِكَ سَخَّرْنٰهَا لَكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ.
তখন তার গোশত থেকে নিজেরাও খাও এবং ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্তকেও খাওয়াও এবং তাকেও যে নিজ অভাব প্রকাশ করে। এভাবেই আমি এসব পশুকে তোমাদের আয়ত্তে এনে দিয়েছিল, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও। সূরা হজ্ব (২২) :১৩৬ (আয়াত)
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীসে ইরশাদ করেছেন-
كُلُوْا وَادّخِرُوْا وَتَصَدّقُوْا.
তোমরা খাও, জমা করে রাখো এবং দান খয়রাত কর। সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৫৬৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭২; সুনানে নাসাঈ, হাদীস ৪৪২৬; মুআত্তা মালিক, হাদীস ২১৩৫
এভাবে কুরবানীর গোশত নিজে খাওয়ার এবং অন্যকে খাওয়ানোর জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এ যেন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আতিথেয়তা। সমস্ত মুসলিম এ দিনগুলোতে আল্লাহর মেহমান। তার জন্য নিবেদিত পশুর গোশত তিনি মুসলমানদের জন্য হালাল করে দিয়েছেন মেহমানদারি স্বরূপ যাতে তারা তা খেয়ে তাঁর অনুগ্রহের শুকর আদায় করে। আল্লাহ তাআলার এই আতিথেয়তার গ্রহণ করার মাঝেই রয়েছে বন্দেগীর মাহাত্ম্য। আর এই গোশত বিতরণও নয় গরীবের প্রতি করুণা; বরং এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মেহমানদারির প্রতিনিধিত্ব। তো এটা ইবাদত ছাড়া কি হতে পারে? ইবাদত বলেই গোশত বিতরণে এ নিয়মকে মুস্তাহাব করা হয়েছে, জবাইকৃত পশু সবটা তিন ভাগ করা হবে। তার এক ভাগ নিজেরা খাওয়া হবে, এক ভাগ আত্মীয়- স্বজনদের দেওয়া হবে আর এক ভাগ দেওয়া হবে গরীব-মিসকীনদের। সুতরাং স্পষ্ট হয়ে গেল যে, কুরবানীর পশু জবাই, তার গোশত বিতরণ ও গোশত খাওয়া সবটাই ইবাদত। ইবাদত করার দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ হয় এবং বিপুল ছওয়াব অর্জন হয়।
পরিসমাপ্তি, একটি আয়াত-
لَنْ یَّنَالَ اللهَ لُحُوْمُهَا وَ لَا دِمَآؤُهَا وَ لٰكِنْ یَّنَالُهُ التَّقْوٰی مِنْكُمْ .
আল্লাহর কাছে তাদের (কুরবানীর পশুর) গোশত পৌঁছে না আর তাদের রক্তও না, বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া ও আল্লাহভীতিই। সূরা হজ্ব (২২) :৩৭(আয়াত)