৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷ রক্তঝরা ফাগুন ৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷
সালটা ১৯৫২। ফেব্রুয়ারী মাসের মাঝামাঝি। আনিসের কাছে ঢাকা শহরের পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত মনে হতে লাগল। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রায় প্রতিদিনই শিক্ষার্থীদের মিটিং-মিছিল আর বিক্ষোভ চলছিল। এখানে ওখানে পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষ চলতে থাকে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই আনিসের শশুর ঢাকায় চলে এলেন। অবশ্য এই আগমন ঠেকানোর জন্য সেবার আনিসের আর তেমন কিছুই করার ছিলনা।
আনিসের সাথে লতার বিয়ে হয়েছিল আরও দুই বছর আগে আনিস তিন মাসে একবার বাড়ি গিয়ে দু-তিনদিন থেকে আবার ঢাকায় ফিরে আসত। সরকারি চাকরির সুবাদে সে ঢাকায় একটা ছোট রুম ভাড়া করে থাকতো। তার চাকরির বয়স তখন মাত্র আড়াই বছরের মতো। বিয়ের পর থেকেই লতার ইচ্ছে ছিল ঢাকায় স্বামীর কাছে বেড়াতে যাবে, কিন্তু বাড়তি খরচের ভয়ে আনিস নানা অজুহাতে এতোদিন ঢাকা আসার ইচ্ছেটা ঠেকিয়ে রেখেছিল।
যতবারই আনিস বেড়াতে গেছে লতা ওকে ঢাকায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আবদার করেছে। আনিস গ্রীষ্মকালে তাকে বলল, ‘ঢাকায় খুব গরম, আবহাওয়া ঠান্ডা হোক তখন যেও।’ শীতকালে বলেছে, ‘এখন তো খুব ঠান্ডা, সামনে ফাগুন মাস আসছে। তখন যেও।’এবারও লতার ঢাকায় আসা হতো না যদি বাবা জমিজমা সংক্রান্ত কাজে ঢাকায় না আসতেন। লতাকে নিষেধ করতে আনিসেরও বিবেকে বাধল। বিয়ের পর থেকে বেচারি লতাকে নিয়ে গ্রামের বাইরে কোথাও যায়নি। মেয়েটাও তো আর তেমন কিছু চায়নি। দুদিনের জন্য ঢাকায় বেড়াতে আসতে চেয়েছে, এই যা! নিজেকে সান্ত্বনা দেয় আনিস। প্রকৃতিতে ফাগুন এসেছে ঠিকই কিন্তু বাঙালির মনে তখন গ্রীস্মের দাবাদহ। পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছিল। আনিসের মনও তাই চিন্তিত হয়ে উঠল!
লতাকে আনিসের কাছে রেখে আনিসের শশুর একদিন পরেই বাড়ি ফিরে গেলেন। ঢাকা শহর দেখিয়ে এক সপ্তাহ পরে আনিস লতাকে বাড়ি দিয়ে আসবে। এমনটাই সিদ্ধান্ত ছিল।
অফিস থেকে বিকেলে বাসায় ফিরে আনিস লতাকে নিয়ে রিক্সায় বেড়াতে বের হয়। বড় বড় দালানকোঠা, বাস-গাড়ি খুব বিস্ময়ের সাথে দেখতে থাকে লতা। রাস্তার পাশে ফুটে থাকা কৃষ্ণচূড়া দেখে লতা খুবই বিমোহিত হয়ে যায়! কিন্তু আনিসের মনে শঙ্কা। দেশের যা পরিস্থিতি, যেকোনো সময় একটা কিছু ঘটে যেতে পারে। তাই আর সন্ধ্যার পর বাইরে থাকাটা নিরাপদ মনে করে না সে। রাতে রেডিওতে ভাষা আন্দোলনের খবর শুনে আনিসের মন আরও বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। খবরে বলল যে, আগামীকাল ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। সারারাত নির্ঘুম কাটাতে হলো আনিসকে। অবশ্য লতা অত কিছু বোঝে না। সে গ্রামের মেয়ে। সে শুধু জানে, রাষ্ট্রভাষার জন্য শহরের বাঙালিরা আন্দোলন করছে। লতা তাই রাত গভীর হওয়ার আগেই ফাল্গুনের হিমেল বাতাসে ঘুমিয়ে যায়।
পরদিন ছিল ফেব্রুয়ারি ২১ তারিখ। সকালে যথারীতি আনিস অফিসে গেল। লতা স্বাভাবিকভাবেই ঘরে ছিল। হঠাৎ সে বাইরে হইচই শুনতে পেল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে, লোকজন বলাবলি করছে- আজ নাকি পুলিশ ছাত্রদের মিছিলে গুলি করেছে।
অনেক লোক আহত হয়েছে। কেউ কেউ মারাও গেছে। চারদিক থেকে লতা মিছিলের তীব্র স্লোগান শুনতে পেল- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ লতার মনে তখন ভয় কাজ করতে শুরু করল। মনটা অস্থির হয়ে উঠল। হঠাৎ দরজায় জোরে কড়া নাড়ার শব্দ। বাইরে আনিসের কন্ঠ শুনে দরজা খুলে দেয় লতা। দরজায় কোন রকমে দাঁড়িয়ে থাকা আনিস লুটিয়ে পড়ে। তার ডান হাতে গুলি লেগেছে। রক্তে ভেসে গেছে জামা। লতা এক টুকরো কাপড় এনে আনিসের ক্ষতস্থানে বেঁধে দেয়। লতার হাত কাপতে থাকে। তার চোখে পানি, হাতে রক্ত।