আজ আপনাদের একজন চল্লিশোর্ধ শিক্ষার্থীর কথা শোনাবো! হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। এই বয়সে এসেও আমেরিকার সারাজিবো নগরে বসবাসকারী আলেকজান্ডার হেমন অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে প্রতিনিয়ত শিখছেন, আর তার শেখাকে কাজেও লাগাচ্ছেন। পেশায় সাংবাদিক হেমন ৪৪ বছর বয়সে তার জন্মস্থান সারাজিবো থেকে চলে আসেন শিকাগোতে। স্বভাবতই নতুন জায়গায় এসে তাকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। ইংরেজিতে দক্ষ না হওয়ায় তাকে নতুন করে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা আনতে হয়। খুব কম সময়ের ভিতর তিনি এই ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন এবং ৫ বছর পরেই ইংরেজি ভাষায় একটি পূর্ণাঙ্গ আর্টিকেল লিখেন যা প্রকাশিত হয় নামকরা এক ম্যাগাজিনে।
একজন বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করতে করতে তিন বছরের ভিতরেই তিনি ইংরেজি ভাষাটা রপ্ত করে ফেলেন। এখন, আলেকজান্ডার হেমন লিখছেন নিউ ইয়র্কার, দ্যা প্যারিস রিভিউ এবং দ্যা নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানগুলোতে। শুধু তাই নয়, অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী উপন্যাস লেখা সহ লেখালেখির মাধ্যমে তিনি বাগে নিয়েছেন বেশ কয়েকটি ফেলোশিপ।
বুড়োরা নতুন কিছু শিখতে পারে না- এই ধারণাই ভুল প্রমাণিত করে দিয়েছেন জনাব হেমন। পড়া কিংবা জ্ঞান অর্জন শুধু তরুণ বয়সী কাজ বললে ভুল হবে। বরং বলা চলে এটি একটি অশেষ প্রক্রিয়া।
এখনকার পৃথিবীতে নলেজ বা জ্ঞানার্জন খুব মূল্যবান এক বিষয়। এখনকার নলেজ ইকোনমি আমাদের সে কথাই বলে। বিশেষকরে নিত্যনতুন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন বিদ্যা আত্মীকরণে জ্ঞানার্জনের বিকল্প নেই। আর সে কারনেই, বিদ্যজনের মতে, জ্ঞানার্জনের জন্য বিনিয়োগ আমাদের সময়ের সবচেয়ে সেরা বিনিয়োগ।
জ্ঞানার্জনের সেরা কৌশল
আপনার হয়ত মনে হতে পারে, জ্ঞানার্জনের জন্য আমাদের আইকিউ এর সক্ষমতা আর কত সময় আমরা অধ্যয়ন করছি- মোটামুটি এই জিনিসগুলোই বেশি দরকার। তবে, বিদ্যজনদের মতে, ‘কীভাবে আমরা পড়ছি’ বা ‘কি কি কৌশল ব্যবহার করছি পড়া’র’ ক্ষেত্রে – এই বিষয়গুলোও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
এ ব্যাপারে ‘মেটাকগনিশন’ নামে একটি কার্যপ্রক্রিয়ার কথা গবেষকরা বলেছেন। যাকে বলা হয় ‘থিংকিং অ্যাবাউট থিংকিং’। এই প্রক্রিয়ায় পরিকল্পনা, পর্যবেক্ষণ ও প্রতিফলনের মাধ্যমে আমাদের শেখা আরও উন্নত হতে পারে। ইনস্টিটিউশন ফর মেটাকগনিশন রিসার্চ -এর গবেষণা ও প্রশিক্ষণ পরিচালক মারসেল ভেনম্যাণ আবিষ্কার করেন যে, নতুন কিছু শেখার ক্ষেত্রে যারা মেটাকগনিশনে জড়িত তারা উচ্চ আইকিউ স্তরের ব্যক্তিকেও হারিয়ে দেয়!
শেখা বা জ্ঞানার্জনের ৪ কৌশলঃ
১) রিপিটিশন বা পুনরাবৃত্তি
নতুন কিছু শেখার ক্ষেত্রে রিপিটিশন বা পুনরাবৃত্তি একটি দারুন কৌশল। পুনরাবৃত্তির কারণে আপনার শেখা জিনিসটি মস্তিষ্কে গেঁথে যায়। বিশ্ববিখ্যাত বই ‘ব্রেন রুলস’এর লেখক জন মেদিনা বলেন, মস্তিষ্কে শেখা জিনিস সংরক্ষণে সবচেয়ে শক্তিশালী উপায় হচ্ছে পুনরাবৃত্তিকরণ। ‘স্পেইশড রিপিটিশন’ নামে একটি প্রক্রিয়া রয়েছে যার মাধ্যমে আপনি প্রতিনিয়ত একটি রুটিনের মাঝে থেকে নতুন কিছু শেখার প্রক্রিয়া চালু রাখতে পারেন। যেমন, ধরুন ২০২০ সালে আপনি ফ্রেঞ্চ ভাষা শিখতে চাচ্ছেন। এখন ‘স্পেইশড রিপিটিশন’ প্রক্রিয়ায় প্রতি রাতে আপনি শেখার জন্য একটি সময় নির্ধারিত করবেন। তারপর ব্যাকরণ ও ভাষাগত খুঁটিনাটি বিষয়ের জন্য আরও কিছু সময় রাখবেন। মনোযোগ হারানোর আগ পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলতে থাকবে। ঘুমানোর আগে আপনার পুরো প্রক্রিয়াটি রিভিউ করার জন্য বাকি সময়টা দিতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় চলতে থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই আপনার শেখার ক্ষেত্রে একটি বড় পরিবর্তন আপনি নিজেই আবিষ্কার করতে পারবেন।
২) রিফ্লেকশন বা প্রতিফলন
প্রডাক্টিভিটি এক্সপার্ট স্কট ব্যারি কাউফম্যান ২০১৬ সালে এক গবেষণায় খুঁজে পান যে ৭২ শতাংশ মানুষ শাওয়ার নেওয়া অবস্থায় ক্রিয়েটিভ আইডিয়াগুলো খুঁজে পায়! এধরণের অপ্রাসঙ্গিক ও অপ্রস্তুত মুহূর্তে দারুন সব আইডিয়া মাথায় চলে আসার ব্যাপারটি আসলেই অভিনব। কারন আমাদের মস্তিষ্ক আদতে মূল বিষয়টি নিয়ে সবসময়েই ভাবতে থাকে। তবে এধরণের অপ্রস্তুত মুহূর্ত আসলেই মস্তিষ্কের সাথে এর সংযোগ ঘটে যায়। আর ব্যাপারটিই হচ্ছে মস্তিষ্কের রিফ্লেকশন বা প্রতিফলন। এ কারনেই বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মচারীদের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠায় অধিকতর ভালো সার্ভিস বা অভিনব আইডিয়া পাওয়ার আশায়। এছাড়া এক্ষেত্রে নিয়ম মেনে ঘুমানোরও পরামর্শ দেওয়া হয়। বিদ্যজনের মতে এধরনের বিশ্রাম আমাদেরকে নতুন নতুন আইডিয়া তৈরিতে সাহায্য করে এবং নতুন কিছু শেখার প্রক্রিয়ায় রসদ দেয়।
৩) শিক্ষকতা কিংবা শেখানো
নিজের জ্ঞান বা বুদ্ধি নিজের মাঝে রেখে বসে থাকার মানে নেয়। বরং আপনার জ্ঞান শেখানোর মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার মাঝে নিজেই উপকৃত হবেন। নিজের লব্ধ জ্ঞান অন্যকে শেখাতে গিয়ে অনেক ধরণের নতুন চিন্তা ও ভাবনার উদ্রেক ঘটে। সাথে সাথে নিজের জানাটাও আরও পরিপক্ব হয়।
৪) ক্ষেত্র বদল
মাল্টি টাস্কার ইয়ন মাস্কের জীবনী ঘাটলে দেখা যায়, উনি প্রতিনিয়ত উনার পেশার ও শেখার ক্ষেত্র পরিবর্তন করতেন। এক জায়গায় বসে না থেকে বিভিন্ন টেক কোম্পানিতে উনি ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং রপ্ত করেছেন টেক ইন্ডাস্ট্রির খুঁটিনাটি সব কিছুই। যা তার লব্ধ জ্ঞান ও শিক্ষাকে আরও পাকাপোক্ত করেছে এবং নিজেকে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলেছে। তাই নতুন নতুন বিষয় শেখার ক্ষেত্রে জ্ঞানের ক্ষেত্র বদল করাটা খুবই ভালো এক পন্থা।
এটা আসলে কোন কাকতালীয় ঘটনা নয় যে বিশ্বের সফল ব্যক্তিরা সারা জীবনই নতুন নতুন বিষয় শেখার ক্ষেত্রে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন। এখনকার পৃথিবী যে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে সেই গতি ধরতে আমাদেরকে সফল ব্যক্তিদের মতোই নতুন নতুন বিষয় সম্পর্কে সমালোচনামূলকভাবে চিন্তা ও পর্যালোচনা করবার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। আর এক্ষেত্রে শেখা বা জ্ঞানার্জনের কৌশলগুলো হতে পারে সহায়ক মাধ্যম।