বাংলা নববর্ষের ইতিহাস অনেক পুরোনো।প্রজাদেরখাজনা আদায়ের সুবিধার্থে সম্রাট আকবরের আমলে ইংরেজি ও আরবি সনের পাশাপাশি ৫ নভেম্বর ১৫৫৬ সালে বাংলা বর্ষের সূচনা করেন । বাংলা নববর্ষ প্রবর্তন করেছিলেন মুঘল সম্রাট আকবর। এই সনের নাম শুরুতে ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ হিসেবে পরিচিতি পায়।
পার হয়ে যাওয়া বছরের গ্লানি,কষ্ট, পাওয়া না পাওয়ার বেদনা ভুলে গিয়ে বাংলা নতুন বছরকে নবরুপে বরণ করে নেওয়া বাঙালির এক চিরায়ত এবং সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। আর এটিই এখন বাংলা নববর্ষ নাম ধারন করে বাঙালি জাতিসত্ত্বার জানান দেয়।বৈশাখ মাসের প্রথমদিন নববর্ষ উদযাপিত হয়।শুধুমাত্র বাংলাদেশেই নয়,ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরাসহ সারা বিশ্বের বাঙালিরা এ দিনটি ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার মাধ্যমে পালন করে থাকে।যুগ যুগ ধরে পালিত এ অনুষ্ঠান পালনের ঢঙে কিছুটা পরিবর্ত্ন হলেও জাতির প্রাণের স্পন্দনে মিশে থাকা এ উৎসব পালনের আগ্রহে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি।”বাংলা নববর্ষের একাল সেকাল” সম্পর্কে এবার একটু আলোকপাত করা যাকঃ
খাবারঃ
সেকাল- ভোজনরসিক হিসেবে বাঙালির যথেষ্ট সুনাম আছে।উৎসব যেন নানা রকম বাহারী খাবার ছাড়া পূর্ণতা পায়না।বাংলা নববর্ষের দিনেও সামর্থ অনুযায়ী হতো হরেক রক্ম খাবারের আয়োজন। খুব সকালে মরিচ-পেয়াজ দিয়ে ঢেঁকি ছাঁটা মোটা চালের পান্তা ভাত,শতপদের শাকসবজি আর ভিন্ন স্বাদের রান্না। টাটকা ফলমূল এক ভিন্নমাত্রা যোগ করতো।বৈশাখী মেলায় বিক্রীত বা নিজের ঘরে বানানো কদমা, বাতাসা, খই, মুড়কি, নাড়ু,সন্দেশ ইত্যাদি ছিল ভোজনরসিকদের স্বাদ গ্রন্থির খোরাক।এভাবেই খাবার আর নববর্ষ পালন যেন এক সুতোয় গাঁথা ছিল।
একাল- নববর্ষ উদযাপনের আমেজ যখন ক্রমেই গ্রাম থেকে শহুরে পরিবেশে বাড়তে শুরু করে তখন আরো অনেক পরিবর্ত্ন লক্ষ্য করা গেল। কোথা থেকে যেন নববর্ষ উদযাপনে যুক্ত হলো পান্তা-ইলিশ। দামী ইলিশ মাছের ভাজা সঙ্গে পান্তা ভাতের সাথে পানি মিশিয়ে পান্তা-ইলিশ খেয়েই দিনটি শুরু করে শহুরে এবং গ্রামের বিত্তবান মানুষগুলো। পান্তা –ইলিশ গ্রামাঞ্চালে অনেকের জন্য এখনো স্বপ্নই বটে ইলিশের আকাশ ছোঁয়া দামের কারনে। আর মধ্যাহ্ণ ভোজে নানান রকমের ভারী খাবার যেমন পোলাও-মুরগী অথবা পোলাও- অন্য রেসিপি। কেউ কেউ দল বেঁধে রেস্টুরেন্টে ফাস্ট ফুড খেতেও যায়।এরকম আরো রুপান্তর প্রতিনিয়ত হচ্ছে।
পোষাকঃ
সেকাল- নববর্ষ উদযাপনকে কেন্দ্র করে নতুন পোষাক পরিধান ও বাঙালির জাতিসত্ত্বার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে।আগের সময়কালে পুরুষেরা সাধ্যমত নতুন লুঙ্গি, ধুতি ,পাঞ্জাবী আর মেয়েরা শাড়ি, ব্লাউজ বা নতুন সালোয়ার কামিজ পরত। মাথায় মনের আবেগের সাথে মিল রেখে খোঁপা করতো। সনাতন ধর্মের তারা আলতা, সিঁদুর, কুমকুম বেশ সখ্যতা পরিলক্ষিত হতো। আর অভিজাত শ্রেণির সোনা-রূপার অলংকার ব্যবহার মেয়েদের কাছে আলাদা মূল্যায়ন পেতো। মোট কথা, নিজেদের সামর্থের সবটুকু দিয়ে নিজের পছন্দমতো ভালো কাপড় পরার প্র্য়াস সাবার মধ্যেই ছিল।
একাল- বানিজ্যিক এ যুগে বিভিন্ন ব্রান্ডের দ্রুত গজিয়ে উঠার ফলে পোষাকে বাহারী ডিজাইন এবং রঙের বৈচিত্রতা খুব বেশি লক্ষ্য করা যায়।লাল সাদা মিশ্রিত পাঞ্জাবী এবং শাড়ী খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের বিভিন্ন ছবি সম্বলিত টি-শার্ট, ফতুয়া ছেলের পছন্দের শীর্ষের দিকে আছে।মেয়েদের শাড়ীর সাথে মিল রেখে বিভিন্ন অলংকারের ব্যবহার উৎসবে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে।তবে এ যুগে দামী পোষাক পরিধানের এক মানসিক প্রতিযোগীতা খুব বেশি ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের মাঝে।তাই বলা যায়, আগের মতোই নতুন পোষাকের প্রতি আলাদা আকর্ষণের ব্যাপারটি আজো বিন্দুমাত্র পাল্টায়নি।
হালখাতাঃ
একাল এবং সেকাল – ব্যবসায়ীদের এবং ক্রেতাদের মধ্যকার সম্পর্কের যে রসায়ন সারা বছ্র ধরে বিদ্যমান থাকে, তা আরো মধুর করতেই হালখাতার প্রচলন। দেনা –পাওনার হিসাব মিটিয়ে নতুন হিসাবের খাতা চালু করার প্রক্রিয়াই মূলত হালখাতা।এ দিনে ব্যবাসায়ীরা দাওয়াত দিয়ে তাদের ও এ যুগে দাওয়াত পত্রের মাধ্যমে যে দাওয়াত দেওয়া হয় , সেটা তখন ছিলনা বললেই চলে।নববর্ষে এই হালখাতার প্রচলন উৎসবকে ভিন্ন স্বাদ দিয়েছে উৎসবপ্রেমী মানুষগুলোকে।
আচার-অনুষ্ঠানঃ
সেকাল- অনুষ্ঠান ছাড়া বাঙালির উৎসবের আমেজ যেন অনেকটাই ফিকে হয়ে যায়।নববর্ষকে কেন্দ্র করে নানা অনুষ্ঠান আবহমান কাল ধরেই প্রচলিত।বৈশাখী মেলা আয়োজন করা হতো গঞ্জে এবং গ্রামের অলিগলিতে।শিশুদের জন্য নাগরদোলা, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, সাপের খেলা, পুতুল নাচ, জারি গান, সারি গান, বাউল-ভাটিয়ালী-মুর্শিদী গানে মুখর হয়ে উঠতো মেলা প্রাঙ্গন।ছেলে বুড়ো সবাই মিলে আনন্দ চিত্তে মেলা উপভোগ করতো।কোথাও কোথাও রাতে যাত্রা বা মঞ্চ নাটক প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হতো।সব মিলিয়ে নানা অনুষ্ঠান মেতে থাকতো বাঙালি জাতি।
একাল- বৈশাখী মেলা এখনকার দিনে প্রচলিত থাকলেও আগেরকার দিনের মত জৌলুস পরিলক্ষিত হয়না।তবে মেলাতে শিশুদের আগ্রহে এতটুকুন ভাটা পড়েনি।জারি গান, সারি গান ইত্যাদি মন মাতানো গানের আসর এখন আর নেই বললেই চলে। নববর্ষকে ঘিরে আয়োজন করা হয় কনসার্ট যা তরুনদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়।
নব্বই সনের দিকে চালু হওয়া রমনার বটমূলে বর্ষবরণের সংস্কৃতি আজো মূল অনুষ্ঠান হিসেবেই আছে। আর অলিখিত অনুষ্ঠান হিসেবে আছে প্রিয়জনকে নিয়ে শখের জায়গাগুলো পরিভ্রমণ করা যা আগেও ছিল এখনো আছে।
খেলাধূলাঃ
সেকাল -খেলাধূলা বাঙালি ও বাঙালি জাতির পরিচায়ক।নববর্ষের দিনে গ্রামীণ সমাজে প্রচলিত জনপ্রিয় খেলাগুলো নববর্ষের আনন্দে আরো ভিন্ন মাত্রার আন্অন্দ প্রদান করতো। গোল্লাছুট, নৌকাবাইচ, হা-ডু-ডু, কুস্তি ও লাঠি খেলা ছিল সবার কাছেই সমাদৃত। মেয়েদের প্রিয় ছিল কড়ি, গুটি, কানামাছি, বাঘবন্দি খেলা। নববর্ষ উপলক্ষ্যে আয়োজন করেই এগুলো খেলা হতো।গ্রামবাসী দল বেধে আসতো এ আয়োজন দেখতে।এমনও দেখা যেতো পাশের এলাকা থেকে খেলায় প্রতিযোগীতা করার জন্য।সে প্রতিযোগীতাই ছিল আনন্দের খোরাক। সে সময় বৈশাখে পাশা খেলার ও প্রচলন ছিল।
একাল- আগেরকার দিনে খেলাধূলার আবেশ খুব বেশি থাকলেও এখনকার যুগে বৈশাখ উপলক্ষ্যে খেলাধূলা খুব একটা চোখে পড়েনা। কোথাও কোথাও প্রীতি ফুটবল বা ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করা হয় আনন্দের খোরাক হিসেবে ।
পরিশেষে, প্রযুক্তির যুগে ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একে অপরকে বার্তা পাঠানোর মাধ্যমে সামাজিক সখ্যতা কিছুটা কমলেও নববর্ষের আমেজ আজো কমেনি এবং ভবিষৎতেও এর আয়োজন এবং আমেজে ভাটা পড়বেনা।বাংলা নববর্ষের স্বরুপ যুগ যুগ বেঁচে থাকুক বাঙালির মনে, বাঙালি জাতি সত্ত্বার সাথে মিশে থাকুক বাংলা নববর্ষ।