লোকসঙ্গীত হচ্ছে কোনো অত্যাধুনিক সংগীত রীতি অথবা কোনো মানসম্মত সংগীত শৈলীর প্রভাবমুক্ত একটি সম্প্রদায়ের গান ও সংগীত । বাংলাদেশের একটি সমৃদ্ধ লোকসঙ্গীত এর ঐতিহ্য রয়েছে যার মধ্যে ধর্মীয় ও পার্থিব গান উভইয় রয়েছে।
লোকসঙ্গীত কে সেই সব ধরনের প্রাচীন সংগীত হিসেবে বর্ণনা করা যায় যা একটি সম্প্রদায়ের হৃদয় থেকে উৎসারিত,অভিব্যক্তি প্রকাশে যা নিজস্ব ধরনের উপর প্রতিষ্ঠিত,ধ্রুপদী সংগীত এবং আধুনিক জনপ্রিয় গানের রীতির প্রভাবমুক্ত। সুর ,কণ্ঠ এবং নাচের সমন্বয়ে সৃষ্ট যে কোনো ধরন বা রূপকে সংগীত হিসেবে বর্ণনা করা যায়।এভাবে লোকগীতি,লোকনৃত্য এবং লোকসুর এর সমন্বয়কে লোকসঙ্গীত বলা যেতে পারে। উদাহরনস্বরুপ,বাউল সঙ্গীত হচ্ছে সুর,সংগীত এবং নৃত্যের সমন্বয়।
লোকসঙ্গীত এর নিচের বৈশিষ্ট্যগুলো রয়েছে : (১) প্রাচীন রীতির উপর ভিত্তি করে একটি গ্রামীণ মানুষ দ্বারা রচিত হয় যা মানুষের মুখে মুখে চলে এসেছে;
(২) সঙ্গীতের এসব প্রাচীন রীতিগুলো ধ্রুপদী অথবা আধুনিক সংগীতের প্রভাবমুক্ত;
(৩) লোকসঙ্গীত দলবদ্ধভাবে অথবা এককভাবে গাওয়া যেতে পারে;
(৪) লোকসঙ্গীত এর জন্য নিয়মিত অনুশীলনের প্রয়োজন হয়না;
(৫) এটি অশিক্ষিত অথবা অর্ধ শিক্ষিত লোকের দ্বারা রচিত এবং তাদের দ্বারা গাওয়া হয়;
(৬) এটি সহজ ভাষা,আঞ্চলিক শব্দ এবং সরল সুরে স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ;
(৭) এর শব্দ এবং সুর উভয়ই আকর্ষণীয়;
(৮) এটি আঞ্চলিক শব্দ ব্যাবহার করে যদিও এর আবেদন সার্বজনীন;
(৯) এটি প্রকৃতি এবং গ্রাম্য পরিবেশের উপর নির্ভর করে;
(১০) এটি প্রাত্যহিক জীবনের সুখ ও দুঃখের বহিঃপ্রকাশ;
(১১) এটি সহজ এবং স্বাভাবিক ছন্দ ব্যাবহার করে;
(১২) এটি মানুষের ভালোবাসা এবং বিচ্ছেদের একটি শক্তিশালী আবেগ অভিব্যাক্তি ধারণ করে।
সংস্কৃতি,উৎসব ,জীবনদর্শন,প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য,নদী,এবং গ্রামীণ ও নদীমাতৃক জীবনভিত্তিক গান নিয়ে বাংলাদেশে লোকসঙ্গীতের বিশাল বৈচিত্র্য রয়েছে।এই গানগুলো সামাজিক বৈষম্য এবং দারিদ্র্য, পার্থিব জগৎ এবং অতিপ্রাকৃত বিষয় নিয়েও রচিত।নদী এবং নৌকার উপমা ব্যাবহার করে আধ্যাত্মিক গানগুলো রচিত।যেহেতু আমাদের দেশ নদীমাতৃক দেশ,তাই ভাটিয়ালি সঙ্গীতের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা।লোকসঙ্গীত পরিবেশ অনুযায়ী সৃষ্টি হয় এবং বেড়ে উঠে।বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মাঝে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভিন্নতা দেখা যায়।তাই বাংলাদেশের লোকসঙ্গীত অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। এভাবেই উত্তরে ভাওয়াইয়া,পূর্বে ভাটিয়ালি এবং দক্ষিণ পশ্চিমে বাউল গানের সৃষ্টি
বিভিন্ন উপজাতিদের সংস্কৃতি এবং জীবনধারা ও লোকসঙ্গীতকে প্রভাবিত করে। সাঁওতাল,গারো,হাজং,চাকমা,মনিপুরী,ত্রিপুরা,মারমা ইত্যাদি উপজাতিরা বছরের পর বছর ধরে উপজাতীয় বাঙালি সংস্কৃতি ও জীবনধারার সাথে মিথস্ক্রিয়া করে রয়েছে। মিথষ্ক্রিয়া টি লোকসঙ্গীতের সমৃদ্ধিতে সুস্পষ্টরূপে প্রতিফলিত হয়েছে।
লোকসঙ্গীত একক ভাবে অথবা দলগত ভাবে গাওয়া হয়।একক ভাবে গাওয়া লোকসঙ্গীত গুলো হচ্ছে বাউল,ভাটিয়ালি, মুর্শিদী এবং মারফতি।আর দলবদ্ধ হয়ে গাওয়া গানের মধ্যে রয়েছে কবিগান, লেটু,আলকাপ এবং গম্ভীরা।কিছু সংগীত বৈশিষ্টের দিক দিয়ে আঞ্চলিক,কিন্তু অন্য গুলো বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে একই।একইভাবে কিছু গান স্বতন্ত্র ভাবে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য রচিত হয় হিন্দু অথবা মুসলমানদের জন্য;অন্য গুলো ধর্মীয় সীমার বাহিরে চলে যায়। কিছু গান একচেটিয়াভাবে পুরুষদের দ্বারা গাওয়া হয়,কিছু নারীদের দ্বারা আবার কিছু পুরুষ নারী উভয় দ্বারা গাওয়া হয়।তাই শুধুমাত্র নারীরাই ব্রতগান ও মেয়েলি গীতি রচনা করে এবং গায়।কিন্তু ঘরের চাল মেরামত করার সময়কার গানে নারী পুরুষ উভয়ই অংশ নেয় ।