ভালোবাসার গল্প পড়তে কেমন লাগে?
আচ্ছা, ভালোবাসার গল্পে আপনি কোনটা পছন্দ করবেন? হ্যাপি এনডিং নাকি স্যাড এনডিং!!!
…………
আমি রাফসান। এই গল্পের নায়িকা, হেনা, সে আমার বউ হয়।
আজ থেকে মাস তিনেক আগে, প্রখর রৌদ্রতাপের দিনগুলোর কোন এক সোমবারে আমি আর হেনা তিনবার করে পরস্পরের জন্যে কবুল পড়ি।
………
আজ আমার বিয়ে।
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই বুকের ভেতরকার ধুকপুকানিটা মনে হয় ১০০০ গুন বেড়েছে। কেন বলছি? কারন, রাতে ধুকপুকানি থাকলেও নিঃশ্বাস নিতে তেমন অসুবিধা হচ্ছিলনা, মনের ভাব লুকিয়ে রেখে সবার সামনে উপর উপর বেশ একটা শক্ত আর পুরুষালি ভাব রেখে চলতে পারছিলাম। কিন্ত সকাল ৭টায় ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই কেমন জানি দুর্বল লাগছে, কথা বেধে যাচ্ছে মুখে, আমতা আমতা স্বর বের হচ্ছে। এমনিতে আমার গলার স্বর তেমন একটা খারাপ না। এখন সেটা রাতে মাত্র ২ ঘন্টা ঘুম হবার কারণে নাকি আমার বিয়ের কারণে সেটা পুরোপুরি বুঝতে পারছিনা।
যাহোক, মা বললেন, “শোন বাবা, আজ আর চা হবেনা। সবাই অনেক ব্যস্ত!” কথাটায় আমার একটু কেমন জানি লাগলো, আজ আমার বিয়ে। শুনেছিলাম, বিয়ের পর নাকি ছেলেরা পর হয়ে যায়! কিন্ত আমার তো মনে হচ্ছে আমার মা’ই আমাকে পর করে দিচ্ছেন, তাও আমার এখনও বিয়ে হয়নি!
সংশয় আর দুঃখভাড়াক্রান্ত মন নিয়ে বারান্দায় এলাম। বাড়িতে মানুষে গিজগিজ করছে। আমার নানার সৎ বোনের দেবরের নাতনিটাও এসেছে আমার বিয়ে খেতে। আমার বিয়েটা কিন্ত খুব ছোট পরিসরে হচ্ছে। এই হল তার নমুনা মাত্র। বড় গোষ্ঠীর ছোট আয়োজন আর কি। কত করে বললাম, একটা কমিউনিটি সেন্টারে বিয়েটা হোক, মায়ের এক কথা, তার একমাত্র ছেলের বিয়ে হবে তার এই তিনতলা বাড়ির ছাদে। আমার নানা, দাদার বংশে কেবল আমার বাবা ও মায়েরই এক সন্তান। বাকিদের ৪ থেকে শুরু। তাই আমার বিয়েটা এক দিক দিয়ে তাদের কাছে বিশেষ কিছু।
সাতজন, একসাথে সাতজন মামাতো, খালাতো, ফুফাতো ভাই বোন চিৎকার করে উঠলো পেছন থেকে। আমার যায় যায় অবস্থা। হাতের উপর ভাসিয়ে (সবাই মিলে হাতের উপর তুলে) আমাকে উঠানের নারিকেল গাছটার নিচে নিয়ে এল। আমাদের বাড়ির উঠানে এই একটাই গাছ, তাও আবার চারিদিকে বাঁধানো। কারণ, আমার মায়ের নারিকেল খুবই পছন্দের। মা বলেন, নারিকেলের সাথে নাকি মানুষের অনেক মিল। সে যাই হোক। গাছের গোড়ার চারদিকে চারটা খুঁটি পূঁতে তার উপর লাল একটা চাদর টানিয়েছে। এটা নাকি আমার আজকের গোসলখানা। লোকের দেয়াল থাকে, ছাঁদ থাকেনা। আর আমার গোসলখানায় ছাঁদ ছাড়া কিছু নেই।
খালি পেটেই গোসলখানায় আমাকে বসানো হয় ভেবে আফসোস করতে হলনা আমার। একে একে লাল-হলুদ পিঠা, পাঁচ রকম ফল, গুনে দেখলাম, তাও বিভিন্ন রঙ এ ঢং এ কাটা, আর কিছু আজব মিস্টি আমার সামনে ওই নারিকেল গাছের বাঁধানো দেয়ালের উপর রাখা হল। ওহ! এতক্ষণে খেয়াল করলাম যে এই বাঁধানো অংশে বিভিন্ন আঁকিবুকিও করা হয়েছে। আচ্ছা, মানুষতো শীতে পিঠা খায় জানতাম, এই গরমে এরা পিঠা বানিয়েছে! আর ফলগুলো যদি জানতো যে মৃত্যুর পরে এদেরকে এরূপ আকৃতি দেয়া হবে, তবে ওরা কি আদৌ আমার বাবার বাজারের ব্যাগে ঢুকতে ইচ্ছুক হতো! কিন্ত বাটিতে হলুদ বাটা কেন? ওহ! আমার তো আজ হলুদ সন্ধ্যা। থুক্কু! হলুদ সকাল। নাকি হলুদ গোসল?
ছবি তোলা, হলুদ ঘষা আর পেটপূর্তি হবার পর প্রায় ৯টা ৩০ এ আমি আমার রুমের অ্যাটাচড গোসল্কখানায় আসলাম। বেশ আরামেই গোসল সেরে এলাম। দেয়ালঘড়িতে ১০টা ১৬। ঘড়িটা আমার হবু চাচাশ্বশুড় আমাকে দেখতে এসে আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। এবং সেখানে উপসস্থিত সবাইকে ঘড়ি কেনার দরকার হলে তার দোকানেই যেতে বলেছেন। ওনার ঘড়ির ব্যবসা কিনা!
চাচাতো বোনের থেকে ক্যামেরাটা একরকম ছিনিয়েই নিতে হল। হলুদের ছবি দেখছিলাম, সব ছবিতেই আমি হাঁ করে আছি, আর সামনের জন আমাকে খাইয়ে দিচ্ছে এমনভাবে হাতটা রেখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টিনন্দন হাসি দিয়েছে। আমি বর আর আমার গুরুত্ব নিয়ে আমি বেশ আতংকিত!
বাবার তাড়ায় বরের পোশাক পড়ে নিলাম। পরে জানলাম বাবাকে নাকি মা তাড়া দিয়েছে যাতে আমি তৈরি হয়ে নেই। আমি বর, আমার আজকের পোশাক পাজামা, পাঞ্জাবি, আর কিছু একটা পাঞ্জাবির উপর পরেছি। কি বলে এটাকে? হাতে একটা ঘড়ি নেবার ইচ্ছা ছিল। কিন্ত সে ঘড়ি দেবেন চাচাশ্বশুড়, ওবাড়িতে যাবার পরে। ওনার আবার ঘড়ির ব্যবসা কিনা!
আচ্ছা, ওপাশের উনি কি শাড়ি পরেছেন তাহলে? আমার পাঞ্জাবি নিল রঙ এর। বিয়েতে নাকি একই রঙ পরে! ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটলো দাদীর ডাকে। তার হাঁটুতে ব্যাথা। সেই নিয়েই গাড়ি চেপে যাচ্ছেন নাতির বিয়ে খেতে। গাড়িতে দাদীকে তুলে দিলাম। আমি সামনের ফুল দিয়ে সাজানো গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। গাড়ীর সাম্নের দিকে ফুল দিয়ে “H+R” লিখেছে। কে সাজিয়েছে তাকে একটা নোবেল দেব ভাবতে ভাবতে গাড়িতে উঠলাম। ধূকপুকানি বেড়েছে ৪৫গুন। আমাকে দরদর করে ঘামতে দেখে খালুজান বলে উঠলেন, “কইরে! বরের জন্যে একটা কিং সাইজ তোয়ালে আনোতো কেউ।” হাসির মেলা বসে গেল চারিদিকে কথটি শুনে।
৬ঘন্টার বিরাট ঝক্কি সামলে অবশেষে বিয়ে হয়ে গেল। ঝক্কির গল্প নাহয় হেনাই লিখবে আপনাদের জন্যে!
“H+R” লেখা গাড়িতে পেছন সিটে আমি আর হেনা। কেউ ট’শব্দটিও করছিনা। হঠাৎ কি মনে করে আমি হাত বাড়ালাম, হেনা কিছুক্ষণ থেমে আমার হাতের উপর হাত রাখতে তার হাত তুললো। তখনি, ঠিক তখনই ঘটলো আসল ঘটনা। ফট করে বিপ বিপ বেজে উঠলো। আমার ফোনের অ্যালার্ম!!! কেন দিয়েছিলাম এই সন্ধ্যা ৬টার অ্যালার্ম!!!!!!!
হাতে হাত রাখা আর হলনা। কাশি শুরু হলো। গাড়ি দাঁড় করাতে বললাম। রাস্তা পার হয়ে দোকান থেকে এক বোতল পানি কিনলাম। শুনতে পেলাম হর্ণ, চাকা আর দুড়ুম দাড়ুম সবকিছু গুড়িয়ে যাবার শব্দ। ঘুরে তাকালাম। আমার “H+R” লেখা বিয়ের গাড়ি! আর কিছুই নজড়ে এলোনা আমার। শুধু ভাবলাম, আমার হাত, হেনার হাত আর অ্যালার্ম। কেন বেজেছিল অ্যালার্ম। কিসের অ্যালার্ম ছিল ওটা! “আপনি তো বর! কি হলো কথা বলুন। এ্যাম্বুলেন্স ডাকুন!” কেউ ডাকছিল, হুঁশ ফিরলো আমার। কল করলাম ৯৯৯ নাম্বারে।
বাসর রাত কাটলো আমাদের হাসপাতালে। হেনা বিরল প্রজাতির বউ যে কিনা বউয়ের বেশে অপারেশন টেবিলে। হেনার মাথায় কোন আঘাত লাগেনি। হাতের মেজর একটা শিরা কেটেছে, পায়ের হাড় ভেঙ্গে মাংসে ঢুকে গিয়েছে। ২মাস থাকবে পর্যবেক্ষণে। আমি হেনার হাত ধরেছি সে রাতে। কিন্ত হেনা ছিল অজ্ঞান!হেনার পায়ে ইনফেকশন হয়। তাই হাসপাতাল পিরিয়ড আরো দীর্ঘস্থায়ী হলো।
অবশেষে ৩ মাস পরে হেনা “বাই ওয়ান, গেট ওয়ান ফ্রি” এর মত নিজের সাথে দুটো ক্র্যাচ নিয়ে আমাদের ঘরে প্রবেশ করলো। হেনা বিছানায় বসেছে যেটাতে আমি গত তিন মাস ঘুমাইনি হেনা আসবে বলে!
“বাহ! ভালোই হলো, পরবর্তীতে আমাদের কেউ পা ভাংলে নতুন করে আর ক্র্যাচ কেনা লাগবেনা। ” হেনার ক্র্যাচ দুটো হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে বলতে লাগলাম। এই মূহুর্তে ঘরের সবাই ভুত দেখার মত করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ আমার নানার সৎ বোনের দেবরের নাতনিটা এগিয়ে এসে বলল, “ এই পা ভাঙ্গা মেয়েটা তোমার কি হয়?”
আমি বললাম, “সে আমার বউ হয়।”
#গল্প_”সে_আমার_বউ_হয়”#