সোনিয়া হোসেন
১৮-১৯ বছরের মেয়ে বড় ঘোমটা দিয়ে ঘরে বসে আছে ।
সে কিছুতেই মুখ দেখাছে না । আশেপাশের বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে গেছে । সবাই তাকে যা তা তিরস্কার করছে ।
তুই কোন লজ্জায় এ গ্রামে এসেছিস।
তোর তো বাবার ঠিকানা নেই । সারা জীবন নানীর বাড়িতে থেকেছিস ।
তোর বাপ তোকে মেয়ে বইলা স্বীকার করে নাই ।
এখন শুনতাছি, তুই নাকি রাস্তায় রাস্তায় ঘুইরা টাকা রোজগার করোস ।
এ গ্রাম থেইকা খুব সকালে চইলা যাবি । নইলে তোরে আমরা সবাই মিল্যা মুখে চুন কালি দিমু ।
শয়তান এই বয়সে নেশা খাওয়া শিখছোস । তোরে আমরা মারমু ।
মেয়েটা মাথা নিচু করে বসে ছিল । লোকজন আস্তে আস্তে চলে গেল । মেয়েটা ওর নানীর সাথে শুয়ে পড়লো ।
নানু ওকে বলছে, আচ্ছা শানু, তুই কি মদ-গাজা খাস? তোরে দেইখা তাই মনে হইতাছে ।
আমার কাছে সত্য কথা কবি কিন্তু । মিছা কথা কবি না কিন্তু ।
শানু- হু নানী, আমি শহরে যাইয়া এগুলো খাওয়া শিখছি ।
অহন আমার প্রত্যেক দিন এগুলা না খাইলে ভালা লাগে না । প্রত্যেক দিন একটা কইরা বড়ি খাইতই হইবো । না খাইলে শুরীর কেমন যেন কামড়ায়, জ্বালাপোড়া করে ।
নানী কইলো-ছিঃ ছিঃ! এসব কি কস । তুই কার থাইকা এইসব খাওয়া শিখলি? ক্যান, মা প্রথম যখন আমারে এক বাসায় দিলো কাজের জন্য । ঐ বাসার আপা তো প্রত্যেক দিন ১ শিশি মদ খাইতো রাতের বেলায় । আফাই তো আমারে দিতো । একটু একটু কইরা আমিও খাইতাম । পড়ে আমার নেশা ধইরা গেল । আফা তো সব সময় বড়িও খাইতো ।
আমি মাঝে মাঝে খাইতাম । একদিন আপার তিন চার বান্ধবী মিল্যা ঘরে মদ আইনা খাইছিল । খালা-খালু প্রায়ই অনেক রাত্রে কইরা বাড়ি আইতো । আসার পর তারা ঘুমাইয়া পড়তো । আমাগো আর বেশি খোঁজ করতো না । এইভাবেই আমাগো সবারই নেশা ধইরা গেছিল । একদিন আপা কলেজ থেকে আইসাই অজ্ঞান হইয়া পড়ে । তাড়াতাড়ি তাকে ক্লিনিকে নিয়া যায় । ওরা কইলো উনাকে মাদকমুক্ত হয় এমন ক্লিনিকে নিয়া যায় । আপাকে ওরা ওখানে ভর্তি কইরা দেয় । আর আমাকে সেই বাড়ি থেইকা বিদায় কইরা দিলো ।অনেক বাসায় আমি কাজ খুঁজি কিন্তু কাজ পাই না, সবাই কয় মেয়েটাকে দেখলে মনে হয় নেশা করে এঁকে রাখা ঠিক হব না ।
আমার জমানি ৩০০ টাকা ছিল । ওইটা দিয়াই দুই চার পাঁচ দিন চলছি । কেউ আমারে খাওয়ার টাকা দেয় নাই, কাজেও রাখতে চায় নাই । শেষমেশ দেশে আইছি তোমাগো কাছে ।
এখানেও আমারে সবাই তিরস্কার করতাছে । আমি ওহন কই যামু । নানু, আমার যে খুব পেটে ব্যথা । এখন আমি কি করুম । মা তো ঘুমাইতাছে । আমার খুব বেশি ব্যথা তুমি তাড়াতাড়ি মারে ডাকো । শানুর মার মন খারাপ হইয়া গেল । ক্যান এত পেট ব্যথা । সকালেই সে খেয়াল করেছিল । শানুর মুখটা কেমন যেন হলুদ । কোন রকমে গ্রামের হাঁসপাতালে নিয়ে গেল । ডাক্তার বললো, ওর জন্ডিস হইছে । বিশ্রামে থাকতে হবে ।
কিন্তু শানুর মার কপাল খারাপ । হাসপাতাল থেকে আসার সময় খুব ভোরে শানু রাস্তায় মারা গেল । বাড়ির কাছাকাছি প্রায় এসে পড়েছিল । বৃদ্ধ নানি দৌড়ে আসে, কাঁদতে কাঁদতে শানুর মা অজ্ঞান হয়ে যায় । দূরে দাঁড়িয়ে শানুর বাবা তাঁর মেয়ের লাশ দেখছে ।
বলার সাহস নেই । সে শানুর বাবা । সে ছিল বড়লোকের ছেলে। শানুর মা ছিল তাদেরই প্রতেবেশী । অপেক্ষাকৃত গরীবের মেয়ে । ওরা লুকিয়ে বিয়ে করে । শানুর জন্ম হয় । কিন্তু শানুর মাকে কোনদিন তার শ্বশুর বাড়ি মেনে নেয় না । ছেলেকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেয় । শানুর মার বদনাম হয়ে যায় । কেউ জানে না শানুর বাবা কে ?
শানুর বাবা দূর থেকে মেয়ের লাশ দেখে চোখ মোছে ।
ভাবে এরকম শানু অনেক আছে এ দেশে ।
এই শানুর অপরাধ কী? শানুর মারই বা কি অপরাধ । অপরাধ, শানুর মা না বুঝে শুনেই অল্প বয়সে লুকিয়ে বিয়ে করেছিল শানুর বাবাকে । শানুর বাবা ? প্রতারক । শানুর মা ? অবুঝ । সাবধান, টিনএজ মেয়েরা । এরূপ অপরিপক্ক সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের জীবন কলঙ্কিত করো না । শুধু নিজের জীবন নয় । ধ্বংস হয়ে যায় শানুর মত বেড়ে উঠা নিস্পাপ শিশুটিও । শানুর বাবা হয়েও যেন তুলসী ধোয়া পানি । এই আমাদের সমাজ , ধন্যবাদ ।