আমার নানু বাড়ি আশেপাশের সকল বাড়ি হতে একটু উঁচু জায়গায়। আমার নানারা দুই ভাই ছিলেন। আমার নানা ছিলেন বড়। দুই ভাইয়ের বাড়িতে দুটি ঘর ছিল। ছোট নানা ঢাকায় থাকে। সময় পেলে বাড়িতে ঘুরতে আসেন। আমার নানার চারজন ছেলে আছে। তাদের মধ্যে সেজো মামা অনেকটাই অর্থশালী। জেলা শহরে তার একটি বাড়ি রয়েছে। কিন্তু সবাই চায় গ্রামে থাকতো। গ্রামের মানুষের টানে সব সময় গ্রামের প্রতি লেগেই থাকে।
তাই মামা ও ঠিক করল যে সে গ্রামে একটি টিনের ঘর তুলবে। নানার কাছে সে অনুমতি চাইল। নানা খানিকটা দ্বিধা বোধ করলেও পরবর্তীতে রাজি হয়ে গেল। তাদের ঘরের পাশেই পড়ে থাকা পতিত জমিতে মাটি ফেলা হলো। জঙ্গল সাফ করা হলো। প্রয়োজনে গাছপালাও কেটে ফেলা হলো। বেশ কিছুদিনের মধ্যেই মামার টিনের ঘরটি তৈরি হয়ে গেল। প্রত্যেক ঈদে অথবা যেকোন বন্ধের সময় মামা তার পরিবারকে নিয়ে এসে সেই ঘরে থাকতো। আমাদের পরিবার ও অনেকটাই বড়। তাই আমরাও সময় পেলে সবাই একত্রিত হতাম এবং আমার ওই ঘরটা তে থাকতাম।
কিন্তু সবার সব সময় নানা বাড়িতে যাওয়া হতো না। মামা ও তার কাজের জন্য বেশিরভাগ সময় বিভাগের বাইরে থাকতেন। তাই মামা চিন্তা করল বেশিরভাগ সময় যেহেতু তার ঘরটি খালি পড়ে থাকে তাই যদি ভাড়া দেওয়া হয় তাহলে কিছু টাকাও আসবে আর ঘরটি নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে। তাই ঘরটি ভাড়া দেওয়া হলো গ্রামের একটি ছোট পরিবারের কাছে। তিনজনের পরিবার ছিল সেটি। মা-বাবা ও তাদের ছোট্ট একটি মেয়ে।
যাইহোক বেশ ভালোভাবেই দিন কাটছিল তাদের। একদিন সন্ধ্যায় তার পরিবার মামার ঘরের মধ্যেই বসেছিল। হঠাৎ করেই তারা কিছু একটা দেখতে পেল তাদের ঘরের জানালার বাইরে পূর্বদিকে। বাড়ির পূর্ব দিকটা ছিল একটু অদ্ভুত। বেশ কয়েকটি বড় বড় গাছ সেখানে ছিল। দিনের বেলায়ও তেমন কোনো আলো প্রবেশ করতে পারতোনা ওই জায়গাটুকুতে। তারা দেখল যে শিয়ালের মতো কিছু একটা জিনিস ওই জায়গা টুকুর মধ্যে ঘোরাফেরা করছে।
তারা ভাবলো হয়তো কোন জন্তু জানোয়ার হবে। তাই সে দিকে তেমন একটা খেয়াল করল না। বাচ্চা মেয়েটা ঘরের বারান্দায় বসে ছিল। সন্ধ্যা কেবল শেষ হয়েছে। নানা মসজিদে গিয়েছেন। আমার নানী এবং খালামণি বাড়িতে। হঠাৎ করেই কিছু একটা হামাগুড়ি দিতে দিতে খুব জোরে ওই বাচ্চা মেয়েটির সামনে দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে। বাচ্চা মেয়েটি শিয়াল ভেবে ভয় পেয়ে যায়। সে চিৎকার দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। অন্যদিকে তার মা-বাবা ঘরে খাটের উপর বসে ছিল। ওই জিনিসটি দৌড় দিয়ে তাদের খাটের নিচে ঢুকে। তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়ার কারণে তারা প্রথমে কেউই বুঝতে পারে না যে কি ঢুকেছে। যাই হোক মেয়েটির বাবা সাহস করে খাটের নীচে দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু তখনই শুরু হয় সমস্যা।
হঠাৎ করে ঘরের লাইট গুলো ক্রমাগত জ্বলতে এবং নিতে শুরু করে এবং খাটটি মাটি থেকে বেশ খানিকটা উপরে উঠে যায়। তারা উভয়েই ভয় পেয়ে যায়। আর খাটের নিচ থেকে ক্রমাগত একটি বালিকা মেয়ের কান্নার আওয়াজ আসতে থাকে। বাচ্চা মেয়েটির দৌড়ে গিয়ে আমার নানী এবং খালামণিকে ঘটনাটি বলে। তারা উভয়েই ঘর থেকে বাইরে আসে। ঘরের ভেতরে থাকা মানুষের চিল্লাপাল্লা আওয়াজ শুনে তারা সবাই ঘাবড়ে যায়।
আমার খালা মনি তাড়াতাড়ি আয়াতুল কুরসি পড়ার চেষ্টা করে। কেন জানি বারবার তার ভুল হতে থাকে। নানা মসজিদ থেকে তখনই বাড়িতে আসে। ঘটনাটি নানা দেখতে পায় এবং সবাইকে চুপ হতে বলে। তারপর নানা আয়াতুল কুরসি সহ বেশ কয়েকটি সূরা পাঠ করে। তারপর অবস্থা আগের মত হয়ে যায়। সবকিছু ঠিক হয়ে যাওয়ার পর তারা সবাই খাটের নিচে খোঁজাখুঁজি করে কিন্তু সেখানে কিছুই পাওয়া যায় না।
ওই পরিবার ভয় পেয়ে বাড়ি ছেড়ে দেয়। আমরা ঘটনাটি শুনে সবাই প্রথমে অবাক হই। কারণ এর আগে কখনো এরকম ঘটেনি। আমার মামা বাড়িতে আসে। নানাকে এই ঘটনার ব্যাপারে সব কিছু জিজ্ঞাসা করে। তখন নানা বলে যে সে একবার শুনে ছিল যে এই জমিটুকু অনেক আগে হিন্দুদের শ্মশান ঘাট ছিল। শুধু তাই নয়, অনেক সময় নাকি এখানে ছোট শিশু মেয়েদের জ্যান্ত পুড়িয়ে ফেলা হতো।
ছোটবেলায় শোনা নানা এই কাহিনীকে তেমন একটা পাত্তা দেয়নি। কিন্তু এই ঘটনার পর তারা ওই কাহিনীর সত্যতা সম্পর্কে বুঝতে পারে। তারপর সম্ভবত বড়োসড়ো কোন হুজুর কে দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করানো হয়। এখন ওই বাড়িতে আমরা সবাই বন্ধের সময় অথবা ঘুরতে গেলে থাকি। আর এরকম কোন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় নি আমাদের।