আ’মরি বাংলা ভাষা
আজ সুমি বিদেশে এসে প্রথম স্কুলে যাবে, ভেতর ভেতর খুব উত্তেজিত সে। গত সপ্তাহে আম্মু আর ছোট ভাই এর সাথে ইটালিতে বাবার কাছে চলে এসেছে ওরা। বাবা আগে থেকেই থাকতেন। দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার পর এবার সবাই একত্রে থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল। দেশে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে সেভেন পর্যন্ত পড়লেও বিদেশে আসার প্রস্তুতি হিসেবে ইংরেজিটাও মোটামুটি শিখে নিয়েছিল সুমি। আজ প্রথম সে এই দেশের স্কুলে যাবে। নানা জল্পনা-কল্পনা শেষে বাবার হাত ধরে স্কুলে গেল সুমি। প্রথমদিনটা ভালো কাটল ওর। শিক্ষক, ক্লাসের অন্যরা সবাই বেশ বন্ধুসুলভ। কিন্তু একটা বিষয় মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগলো ওর। এখানে কেউ বাংলায় কথা বলতে পারেনা। দু-চারজন বাংলাদেশী থাকলেও এদেশে জন্ম হওয়ায় খুব একটা বাংলা ওরা পারে না। অন্য ভাষায় কতক্ষণ আর কথা বলা যায়! নিজের সব অনুভূমি স্বত:স্ফূর্তভাবে প্রকাশ করার জন্য বাংলায় কথা না বললে কি বলে! সবকিছু পেয়েও বিদেশে এসে কেমন যেন অদ্ভুত এক শূণ্যতা অনুভব করছে সুমি।
বন্ধুরা কেমন আছো সবাই? তোমারাও নিশ্চয়ই সুমির মনের দু:খটা বুঝতে পারছো তাই না?
আসলেই মাতৃভাষার কথা বলার তৃপ্তিই আলাদা। এই ভাষাটা তো আমাদের মায়ের কাছ থেকে শিখে আসা, তাইতো এতো বেশি আপন লাগে এই ভাষাকে।
তোমরা কি জানো বাংলা আমাদের মাতৃভাষা হওয়ার পিছনে সুন্দর একটা ইতিহাস আছে? বাংলাকে বাষ্ট্রভাষার মর্যাদার আসীন করার জন্য অনেক মানুষের দীর্ঘদিনের সংগ্রামের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। তোমরা তো জানোই ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হওয়ার পর পূব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্ম হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেশি, এদেশের মানুষ বাংলাতেই কথা বলে। কিন্তু তারপরও পশ্চিম পাকিস্তানিরা চাইছিল ঊর্দুকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করতে। বিভিন্ন সভাতেও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন নেতারা এই বিষয়টিকে জোরালোভাবে ঘোষণা দিচ্ছিল। কিন্তু এই দেশের মানুষেরা বিষয়টিকে সহজভাবে নিতে পারলো না। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে স্মারণলিপি পেশ করা হলো। কিন্তু তাপরও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে সরকার গড়িমসি করতে লাগলো। আন্দোলন এবার তীব্র রূপ ধারণ করলো। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী, ৮ ই ফাল্গুন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্রজনতা মিছিল বের করলো। ঢাকা মেডিকেলের কাছে আসলে পুলিশের গুলিবর্ষণ শুরু হলো। শহীদ হলেন সালাম, বরকত, শফিুউর সহ অনেকেই। কিন্তু এই শহীদদের আত্নত্যাগ বৃথা যায়নি। শেষ পর্যন্ত বাংলাই হলো এদেশের বাষ্ট্রভাষা।
আপোষহীন বাংলাভাষীদের অব্যাহত আন্দোলনে ১৯৫৮ সালের তৎকালীন পাকিস্তানের সংবিধানের বাংলাকে দেয়া হয় রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা। বাংলার দামাল ছেলেদের এই আত্মত্যাগ বিশ্ব দরবারে স্বীকৃত পায়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কো বাংলাকে ‘আন্তর্জান্তিক মাতৃভাষার’ স্বীকৃত দেয়। ২০০০ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী সারাবিশ্বের অসংখ্যা দেশের পালিত হয় আন্তর্জান্তিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।
তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো তাহলে বেশ সংগ্রাম করেই আমরা বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে পেয়েছি। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও ভাষার জন্য আত্মত্যাগের এমন দৃষ্টান্ত নেই। । তাইতো জাতিসংঘ ইউনেস্কো থেকে এই দিনটাকে আন্তর্জান্তিক মাতৃভাষা দিবস করা হয়েছে।
বন্ধুরা, এমন গৌরবোজ্জল অর্জনে নিশ্চয়উ তোমরাও খুব গর্ব অনুভব করছো, তাই না?
প্রকৃত পক্ষে ভাষা মানুষের জন্য আল্লাহর এক অপূর্ব নিয়মত। কুরআন পাকে এসছে-“খালাকাল আল্লামাহুম বায়ান।”
অর্থাৎ তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনি তাকে শিক্ষা দিয়েছেন তবে প্রকাশের উপযোগী ভাষা।
[আর-রাহমান; ২-৩]
ভাষা দিবসের এই মাসে এই মাসে আমরা নতুন করেই আবার আমাদের ঐতিহাসিক অর্জনকে স্মরণ করি। শ্রদ্ধা জানাই সেই ভাষা শহীদদের প্রতি যাদের আত্নত্যাগে এই অর্জন সম্ভব হলো।
কিন্তু বন্ধুরা এই ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে আরে কিছু বিষয়ের ব্যাপারে আমাদের আরো সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা ও রাষ্ট্রভাষা হওয়ার সত্ত্বেও আমাদের উচ্চতর শিক্ষা বা উচ্চতর আদালত সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এখনো ইংরেজী ভাষাই প্রচলিত। জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে এখনো বাংলাকে আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। এর চাইচেও দু:খজনক ইংলিশ মিডিয়াম প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের যেভাবে শিক্ষা দেয়া হয় তাতে তারা বাংলা ভাষা ভালো বলা, বাংলা ভাষার পড়ে পারার দক্ষতাটাও হারিয়ে ফেলে। ভিন্ন ভাষায় ভিন্ন দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি দুটোই যেন হারিয়ে যায়। টিভি খুললেই আমরা বাংলা অনুষ্ঠানের চেয়ে অন্য ভাষার দেশের অনুষ্ঠানকেই আপন করে নেই। তার চাইতেও বেশি কষ্টদায়ক বিষয় হচ্ছে যে মাতৃভাষার জন্য এতো রক্ত ঝরানো ইতিহাস, সেই ইতিহাসও অনে শিশুরাই সঠিকভাবে জানে না। সবার দেখাদেখি শহীদ মিনারে ফুল দিতে গেলেও ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস, ভাষা শহীদের নামও অনেকেই বলতে পারবেনা। এর কারণ এটাই বাংলা ভাষার এই কষ্টার্জিত মর্যাদাকে আমরা শুধুই আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। বাংলা ভাষার এই মর্যাদা শুধু ফেব্রুয়ারী মাসের জন্য নয়, বরং তা সব সময়কার জন্য। এ বিষয়টির আমাদের উপলদ্ধি করা দরকার। বিদেশী ভাষা-সংস্কৃতির আগ্রাসনে আমরাও যদি গা ভাসিয়ে দেই তাহলে এতো কষ্ট করে যারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদার প্রতিষ্ঠিত করলেন, তাদেরকে ও তাদের এই অর্জনকেও অবমূল্যায়ন করা হবে।
বন্ধুরা এসো, ভাষা দিবসের এই মাসে আমরা একতাবদ্ধ হই, মাতৃভাষার বাংলার সঠিক আমরা অটুট রাখবো। রোখ করবো ভাষা বিকৃতি, বোধ করবো এই ভাষাকে অবমূল্যায়নের সব পথ। এই ভাষাই তো আমাদের প্রাণের ভাষা, এই ভাষাতেই আমরা সাবলীল ভাবে প্রকাশ করতে পারি মনে সব অনুভূতি। প্রাণপ্রিয় এই ভাষাকে তার সঠিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত রাখতেই নিশ্চয়ই আমরা আমাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাবো না।! মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এই নিআমতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে আজ থেকেই চলো আমরা হয়ে যায় এক এক জন ভাষার মর্যাদা রক্ষাকারী ভাষা সৈনিক!