সাম্য। নামটিই বলে দিচ্ছে সে সমতাবিধান মেনে চলে। সে অনেক সহজ সরল। ঠাকুরগাঁও এর সেরা স্কুলে পড়েও তার কোনো অহংকার নেই। সে সাদা-সিধে পোশাক পরিধান করে। আমি কখনোই তাকে জাক-জমক, জমকালো পোশাক পরিধান করতে দেখি নি। সে কিন্তু গরিব বাবা-মার ছেলে নয়।
সাম্য এর বাবা একজন জমির উকিল। তার মা একজন লাইব্রেরিয়ান। কিন্তু, তবুও সে টাকার বড়াই করতো না। নিজেকে একজন সাধারণ পরিবারের সদস্য বলে মনে করতো। আর ঠিক সাধারণ পরিবারের ছাত্রের মতোই আমাদের সাথে আচরণ করত। সে যে সহজ সরল, এই বিষয়টার সুযোগ নিয়ে অনেকেই তার কাছে বিভিন্নভাবে সাহায্য নেয়। কিন্তু সাহায্য নেওয়ার পরও অনেকেই তাকে অবহেলা করে। বিভিন্নভাবে তাকে সবার সামনে নীচ, গাধা, গর্ধব ইত্যাদি প্রমাণিত করে।
এই তো কয়েক মাস আগের কথা। তখন করোনার জন্য এসাইন্মেন্ট চালু করা হয়েছিল। এসএসসি-২১ ব্যাচের জন্য নির্বাচনিক বিষয়গুলোর এসাইন্মেন্ট লিখতে হবে। আমরা যেহেতু বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম, তাই আমরা মেসেঞ্জার গ্রুপ খুলে সবার সাথে পরামর্শ করে লিখতাম।
এই গ্রুপে যেকোনো জনের কোনো প্রয়োজন হলে, কাউকে পাক আর না পাক, সাম্যকে পাবেই। কারণ, সে একমাত্র ছেলে ছিল, যে সকাল ৮টা থেকে রাত ২ টা কিংবা রাত ৩টা পর্যন্ত বিনা শর্তে মেসেঞ্জারে আসা প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করতো।
আমাদের পোলাপাইনরা সেই সময় কাজের কাজ না করে, সারাদিন তো বটে, সারারাত ধরে শুধু ফেসবুক, মেসেঞ্জার, চ্যাটিং ইত্যাদি নিয়ে ব্যাস্ত ছিল। এসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার আগের রাতে। রাত ১২ টা কিংবা ১টা বাজে। তখন অনেকেই মেসেঞ্জার গ্রুপে মেসেজ দিতে থাকে,
“আমরা এখনো এসাইন্মেন্ট করি নি। কেউ কি সাহায্য করতে পার?”
সেই সময়, সাম্যই ছিল একমাত্র ভরসা। সে সবাইকে তার করা এসাইন্মেন্ট এর ছবি তুলে পাঠিয়ে দিত। সবাই জানে এটি সঠিক হবেই। কারণ, সাম্য সব প্রশ্নগুলো বুঝে-শুনে, বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘেটে, বিভিন্ন বই ঘেটে অন্যদের সাথে পরামর্শ করে উত্তর লিখে। আবার এসাইনমেন্ট সংক্রান্ত যেকোনো প্রশ্ন থাকলে যে কেউ দিন-রাত যেকোনো সময় ওই গ্রুপে মেসেজ করলে, দেখা যেত আমাদের সাম্যই সবার আগে রিপ্লাই দেয়। সে ওই প্রশ্ন সংক্রান্ত অনেক বড় ব্যাখ্যাও দিত, যেন সেই ব্যাখ্যা পড়ে অন্যরা বুঝতে পারে প্রশ্নগুলোর উত্তর কি হতে পারে। এতে অনেকেই উপকৃত হয়।
কিন্তু, বাঙালি বলে কথা। এতো বড় ব্যাখ্যা দিলে, অনেকেই তাকে বাচাল বলে সম্বোধন করে। তারা বলে, “এই সাম্য চুপ থাক। এতো ডিটেইলসে বলতে হবে না। আমরা বাচ্চা নাকি, যে সব কিছু বুঝিয়ে দিতে হবে? একটু হিন্টস দিলেই তো হয়।”আরও নানানজন নানান কথা বলে তাকে অপমান করে।
আবার এসাইনমেন্ট শেষ হবার পর, যখন স্কুল খুলল, তখন সবাই তাকে ডেমাতে লাগলো। সবাই বলাবলি করতে লাগে, “সাম্য ছেলেটা ইদানিং বখাটেদের মতোই হয়ে গেছে। সারারাত ধরে মেসেঞ্জার, ফেসবুকে একটিভ থাকে। কার সাথে যে কি করে, কে জানে!” আরও কত কি।
অবশ্য আমিও তাকে এরকম কিছু বলেছিলাম। তবে পরে আমার ভুল বুঝতে পেরে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিই। কারণ, সে তো তার প্রয়োজনে মেসেঞ্জার, ফেসবুকে একটিভ থাকতো না, সে আমাদের কথা ভেবেই নিজের ঘুম বিসর্জন দিয়ে মেসেঞ্জারে একটিভ থাকতো।
কিন্তু আমাদের পোলাপাইনরা তাকেই অবহেলা করে। তাদের কি একবারও মনে হয় না, এই ছেলেটা তো আমাদের জন্য এতো কিছু করে। আমরা কিছু না পারি, তাকে তো একটু সম্মান দিতে পারি। কিন্তু কে শোনে কার কথা! তারা সাম্যকে বিভিন্নভাবে হেনস্থা করতেই থাকে। তবুও, সাম্য তাদের বিভিন্ন প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
আমারই ভীষণ রাগ হয়। একদিন আমি সাম্যকে বলি, “ওরা তো তোকে পাত্তায় দেয় না, বরং; তোকে হেনস্থা করে। তবুও তুই কেন ওদের সাহায্য করিস ভাই?
সাম্য মুচকি হেসে জবাব দেয়, “আমি আমার জীবদ্দশায় সবাইকে সাহায্য করার চেষ্টা করব। সে আমাকে পাত্তা দিক আর না দিক, সম্মান দিক আর না দিক, আমি আমার কাজ করেই যাব। কুকুর যদি আমাকে কামড়ায়, আমি কি তাকে কামড়াতে পারি?”
তার এই কথা আমার এখনো মনে আছে। সে অন্যের কাছে অবহেলার পাত্র হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে সে বন্ধুদের মধ্যে সেরা!