আসসালামু আলাইকুম। আমি আপনাদের সাথে আমার দেখা বাস্তব জীবনের ভালোবাসার গল্প শেয়ার করবো। আশা করি সবাই এই গল্পটি মন দিয়ে পড়বেন।
ছেলেটির নাম তাজ আহমেদ, সে বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে এবং তার চার বোন আছে। চার বোন ও বাবা মা তাকে খুব ভালবাসতো। ছেলেটি দেখতে খুব সুন্দর ছিল এবং তার জ্ঞান,বুদ্ধি, আচার আচরণ খুব সুন্দর ছিল। এলাকার সবাই তাকে খুব ভালবাসতো। ছেলেটি লেখাপড়ায় ও খেলাধুলায় খুব ভালো ছিল।
ছেলেটি গ্ৰামের স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিলো এবং সে এসএসসি পরীক্ষায় ভালো পাশ করলো। তাজ আহমেদের ইচ্ছা ছিল এস এসএসসি পাশ করার পর সে ঢাকায় পড়াশোনা করবে। তার ইচ্ছার কথা তার বাবা মা ও বড় দুলাভাইকে বললো। সবাই তার কথা মেনে নিলো। কিছুদিন পরে সে ঢাকাতে তার বড় বোনের বাসায় গেল এবং সেখানে গিয়ে তিতুমীর কলেজে ভর্তি হলো।
দুই বছর পর সে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে। তারপরে সে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। তাজ নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতো। তাজের আচার আচরণ এতটাই ভালো ছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই তাকে একনামে চিনতো। বন্ধুরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো যে তারা কক্সবাজারে বেড়াতে যাবে তাই কয়েকদিনের মধ্যেই সবাই কক্সবাজারে বেড়াতে গেল এবং সেখানে গিয়ে তারা খুব আনন্দ করলো।
এক সপ্তাহ পরে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় চলে আসলো। কক্সবাজার থেকে আসার পরে বন্ধুদের সবার গায়ে জ্বর আসলো ,বন্ধরা সবাই জ্বরের ঔষধ খেয়ে সুস্থ হলো কিন্তু তাজ আহমেদ জ্বরের ঔষধ খায়নি কারণ তাজ ভেবেছিল সামান্য গায়ে জ্বর হয়তো এমনিতেই ভাল হয়ে যাবে। কিন্তু ভালো হলো না, কিছুদিনের মধ্যে তাজের কপালে একটা টিউমারের মত বের হলো। তাজের বড় বোন ও দুলাভাই তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল এবং সেখানে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ধরা পড়লো যে তাজের ক্যান্সার হয়েছে।
এই কথা শুনে তাজের বাবা মা ও বোনেরা মানসিক ভাবে খুব ভেঙে পড়লো কিন্তু তাজ খুব সাহসী ছেলে ছিল। তাজ সবাইকে বললো টেনশন করার কিছুই নাই আল্লাহ যা ভাগ্যে রেখেছেন তাই হবে। তাজের বড় দুলাভাই খুব ভালো ছিল সে তাজকে নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবাসতো। তাজের সমস্ত খরচ টাকা তার বড় দুলাভাই দিতো,কারণ তার বড় দুলাভাই অনেক ধনী ছিল এবং খুব বড় মনের মানুষ তিনি।
মাঝে মধ্যে তাদের দুলাভাই কান্নাকাটি করতো বলে তাজ দুলাভাইকে শান্তনা দিয়ে বলতো দুলাভাই আমাকে নিয়ে টেনশন করবেন না আমি সুস্থ হয়ে যাবো। সবার সামনে নিজেকে খুব সাহসী দেখাতো কিন্তু গোপনে তাজ তার রুমের দরজা আটকিয়ে একা একা কাঁদতো কারণ তাজ খুব ভালো করেই জানে যে তার যে রোগ হয়েছে সেটা মরণব্যাধি রোগ।
ঐ দিকে তাজ একজন মেয়েকে খুব ভালোবাসতো। মেয়েটির বাসা তাজের বড় বোনের বাসার কাছে ছিল। মাঝেমধ্যে তাদের সাথে দেখা হতো কথা হতো আর এভাবেই ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। মেয়েটি তাজের অসুখের খবর পেয়ে খুব কান্নাকাটি করতো কিন্তু তাজের প্রতি তার ভালোবাসা বিন্দু পরিমাণ কমেনি।তাজ ভেবেছিল তার অসুখের খবর শুনে মেয়েটি হয়তো তাকে ভুলে যাবে। একদিন তাজ মেয়েটিকে বললো , তুমি তো জানো আমার ক্যান্সার হয়েছে,তুমি আমাকে ভুলে যাও।
এই কথা শুনে মেয়েটি অনেক কান্নাকাটি করলো এবং বললো ,আমি তোমাকে ভুলে যেতে পারবো না এবং বিয়ে করলে একমাত্র তোমাকেই বিয়ে করবো।একেই বলে সত্যিকারের ভালবাসা যে ভালোবাসা কোন বাঁধা মানে না।
ক্যান্সারের ঔষধ খেয়ে আর ইনজেকশন ব্যবহার করে তাদের মাথার সব চুল পড়ে গেল এবং তাজ অনেক চিকন হয়ে গিয়েছিল।
তারপরে প্রায় দুই বছর চিকিৎসা করতে করতে তাজের শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে একটু উন্নত হল। বেশ কয়েকমাস তাজ ভালো সুস্থতা অনুভব করলো এবং তাদের সুস্থতার মধ্যে তাদের তৃতীয় বোনের বিয়ে ঠিক হলো। তাজ তার বড় বোন, দুলাভাই ও বন্ধুদেরকে নিয়ে গ্ৰামের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলো এবং সেখানে বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করে পনেরো দিন পর সবাইকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসে।
ঢাকায় ফিরে আসার কয়েকদিন পর সে হঠাৎ আবারো অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং তাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়। তাজের শারীরিক অবস্থা ধীরে ধীরে খারাপের দিকে যেতে লাগলো। সবাই বুঝতে পারলো তাজ হয়তো আর বেশি দিন বাঁচবে না এবং ডাক্তারও গোপনে তাজের দুলাভাইকে জানিয়ে দিলো যে তাজ আর বেশি দিন বাঁচবে না।
তাজের যা যা খেতে মন চায় খেতে দিন, তাজের কোন ইচ্ছা যেন অপূর্ণ না থাকে।ডাক্তারের কথা মতো তাজের বড় বোন ও দুলাভাই তাজের পছন্দ অনুযায়ী সব ধরনের খাবার খাওয়াতো, পোশাক কিনে দিতো। হঠাৎ একদিন সকালে তাজ তার দুলাভাইকে বললো আজকে তো পহেলা বৈশাখ, আমার জন্য একটা নীল রঙের শার্ট কিনে আনবেন।
তাজের কথা অনুযায়ী ওর দুলাভাই ওর জন্য একটা নীল রঙের শার্ট কিনে আনলো এবং তাজ খুশি হয়ে শার্টটি গায়ে দিল। সেদিন দুপুরে তাজের বড় বোন তাড়াহুড়ো করে রান্না শেষ করলো এবং টিফিন বক্সে করে ভাইয়ের জন্য দুপুরের খাবার ও রাতের খাবার নিয়ে রওনা দিল এবং মার্কেট থেকে ভাইয়ের জন্য একটি নতুন শার্ট কিনে নিলো। তারপরে হসপিটালে গিয়ে ভাইকে নতুন শার্টটি পরিয়ে দিলো এবং নিজের হাতে ভাইকে খাইয়ে দিলো।
ভাইকে খাওয়ানোর পর বোন বাসায় চলে গেল।আর হসপিটালে তাজের কাছে তাজের মা,চাচাতো ভাই, দুলাভাই ও প্রেমিকা ছিল। ধীরে ধীরে দুপুর পেরিয়ে রাত হলো। তাজের মা তাজকে রাতের খাবার খাইয়ে দিলো এবং তাজকে বললো বাবা এবার তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। তাজের প্রেমিকা তাজের পাশেই ছিল এবং তাজের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো কিন্তু হঠাৎ করে তাজ ওর মাকে বললো মা আমার পা দুটো বাঁকা হয়ে যাচ্ছে, আমার পা দুটো শক্ত করে চেপে ধরো।
এই কথা তাজের প্রেমিকাও শুনতে পায় এবং তাজের মাকে বললো খালাম্মা আপনি এক পা চেপে ধরেন আর আমি এক পা চেপে ধরি। তারপরে তারা দুজনে দুই পা চেপে ধরে এবং তাজের মা তাজকে অনেক দোয়া পড়ালো। মায়ের মুখে মুখে দোয়া পড়ে তাজ ঘুমিয়ে পড়লো।
এবার তাজের প্রেমিকা তাজের মাকে বললো খালাম্মা আপনি একটু ঘুমান, আমি তাজের প্রতি খেয়াল রাখবো, কোন সমস্যা হতে দেখলে আপনাকে ডাক দেবো। এই কথা শুনে তাজের মা শুয়ে পড়লো কিন্তু মায়ের মন তো, সন্তানের জন্য তার।
মনে অস্থিরতা কাজ করছে, কিছুতেই যেন ঘুম আসছে না।তাই মা তাজের পাশে এসে তার শরীর ও মাথায় হাত বুলাতে লাগলো কিন্তু হঠাৎ করে দেখলো যে তাজের শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে। তাজের মা বুঝতে পারলো যে তার আর বেঁচে নেই,সে মারা গেছে। তারপরে তাদের মা তাজের চাচাতো ভাই ও দুলাভাইকে ডাক দিয়ে বললো যে তাজ মারা গেছে, ওকে কাপড় দিয়ে ঢেকে দাও।
এই অবস্থা দেখে তাদের প্রেমিকা এতো চিৎকার দিয়ে কাঁদতে লাগলো যে হাসপাতালের সবাই ছুটে আসলো এবং দেখলো তার আর এই পৃথিবীতে নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। এভাবেই একজন মা তার সন্তানকে হারালো, একজন প্রেমিকা তার প্রেমিককে হারালো, হায়রে নিষ্ঠুর পৃথিবী। সবাই তাজকে গ্ৰামের বাড়িতে নিয়ে যায় এবং সেখানেই তার দাফন কার্য সম্পাদন করে।
সবশেষে তাজের জন্য আপনারা সবাই দোয়া করবেন আল্লাহ যেন তাকে জান্নাত দান করেন আমিন। তাজের ভালোবাসার মানুষটির সাথে ঘর বাঁধা হলো না, তার ঘর বাঁধার স্বপ্ন অপূর্ণই রয়ে গেল। এখানেই অসমাপ্ত ভালোবাসার গল্পের সমাপ্ত । আল্লাহ হাফেজ।