তুষার বাসায় বসেই অফিসের কাজ করে । অফিস করার জন্য এখন আর কাউকে কোনো নির্দিষ্ট ভবনে হাজির হতে হয় না । ইচ্ছা হলে কেউ সমুদ্রসৈকতে বসে অথবা আত্নীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েও অফিসের কাজগুলো সেরে ফেলতে পারে । অ্যাসাইনমেন্ট বা টাস্ক বণ্টন, সেগুলোর আপডেট, সময় ধরে জমা দেওয়া/নেওয়া- এ সবই ই-মেইল চালাচালির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয় ।
তুষার থাকে ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটে । দু রুমের বাসা । তার রুমটা মাঝারি আকৃতির । রুমের সঙ্গে লাগালো বাথরুম । রুমে বিছানা, ফ্রিজ, এমনকি চেয়ার-টেবিলও রয়েছে । এছাড়াও জামাকাপড় রাখার জন্য আছে একটি আলমারি । এগুলো প্রচলন এখনও আছে; তবে এসবের আউটলুকে অনেক পরিবর্তন্ এসেছে । অফিশিয়াল ও অন্যান্য কাজ সে নিজের রুমে বসেই করে । রুমটিতে বিছানার পাশে রয়েছে একটি ‘মেমরি শেলফ’ । সেখানে রয়েছে অসংখ্য প্রটেকটেড মেমরি ডিভাইস । এগুলোকেই এখনকার বই বলা যেতে পারে, কারণ এখন আর আগের মতো কাগজের বই নেই ।
তুষারের মা-বাবা থাকেন অন্য শহরে । এখানে তার সঙ্গে থাকে একটি রোবটিউল । এখনকার পৃথিবীতে বাসাবাড়ির কাজের জন্য তৈরি ছোট আকৃতির রোবটকে রোবটিউল বলে । রোবটিউল একসঙ্গে গৃহপরিচারক বা গৃহপরিচারিকা এবং বাসার নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করে । তুষারের আর্থিক অবস্থা মোটামুটি ধাঁচের । তাই বাসার কাজের জন্য সে কত খরচে স্বল্প বুদ্ধিমত্তার একটি রোবটিউল কিনেছে। তার বাসার কাজগুলো যে রোবটিউল দেখাশোনা করে, তার নাম ‘জেড-915’। যন্ত্রের নামকরণের আবার আরেক রীতি অনুসরণ করা হয়!
‘জেড-915’ –এর মুখে নির্বোধের মতো বকবকানি শুনতে তুষারের খুব বিরক্তি লাগে । তার মাঝেমাঝে আফসোস হয়; আর্থিক অবস্থা ভালো হলে এই নিচু বুদ্ধির রোবটিউল-এর বদলে হয়তো সে বেশি বুদ্ধিমত্তার ‘রোবটিউল’ অথবা কোনো বুদ্ধিমান ‘রোবট’ কিনত! এখনকর রোবটগুলোর অ্যানালিটিক্যাল অ্যাবিলিটি মারাত্মক; বেশ ভালো পরামর্শ্ দিতে পারে । যাহোক, বাস্তবতার খাতিরে আপাতত রোবটিউলকে নিয়েই তুষারের সন্তুষ্ট থাকতে হবে । ‘জেড-915’ কে সংক্ষেপে সে ‘জেড বলে ডাকে ।
জেড-এর উল্টাপাল্টা কথায় এই মুহূর্তে তুষারের মেজাজ বিগড়ে আছে । জেড বলেছে, ‘বাচ্চা ছেলেটিকে ওই বিল্ডিংয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাওয়া যায়নি- তার মানে তো প্ররলেম সলভড!’
জেড-এর এই কথা তুষারের মাথায় যেন কয়েল জ্বালিয়ে দিল! মেজাজ একটু নামলে তুষার বলল, ‘দেখো জেড, উল্টাপাল্টা কথা বলে আমাকে রাগের আসামি কোনো না । একটা বাচ্চাকে পাওয়া যাচ্ছে না, আর তুমি বলছ প্রবলেম সলভড!
‘বলছি । কারণ বাচ্চাটিকে তার মা ভূল করে বাসাতেই রেখে এসেছিল।’
‘বাসাতেই রেখে এসেছিল মানে!তুমি রোবট’ না ছাগল!’ ‘আমি রোবটিউল জেড-915 । হ্যাঁ, বাসাতেই রেখে এসেছিল কিন্তু তার মনে ছিল না । তাই হাউমাউ করে কেঁদেছে।’
‘এসব কী বলছ আবোলতাবোল!’
‘ঠিকই বলছি । ওই মহিলা বাচ্চাটিকে সঙ্গে করে মেলায় নিয়ে গেলে তো তাকে বিল্ডিংয়েই পাওয়া যেত, তাই না?’
‘সবাইকে কি তুমি নিজের মতো নির্বোধ ভাবো?’
‘তুমি কিন্তু আমার রোবটত্বকে অপমান করছে।’
‘একজন মা সম্পর্কে তুমি যা বললে, তা উদ্ভট। আর কেউ উদ্ভট কথা বললে লজিক অনুযায়ী তার শাস্তি হওয়া উচিত, ঠিক কি না?’
‘ঠিক । কিন্তু আমি তো উদ্ভট কিছু বলিনি।’
‘যথেষ্ট উদ্ভট কথা বলেছ এবং শাস্তি হিসেবেই আমি তোমাকে নির্বোধ বলেছি । ইচ্ছা হলে তুমি রোবটাধিকার খর্বেল অভিযোগে আমার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারো । দয়া করে, এখনে এখান থেকে যাও।’
তুষারের কথাকে একদমই পাত্তা না দিয়ে জেড আবার যেন দিগুণ উৎসাহে কথা বলতে শুরু করল । বলল, ‘এখন আমার কাছে ব্যাপারটা একদন পরিষ্কার! কী ঘটেছে আমি স্পষ্ট কল্পনা করতে পারছি । শুনলে তুমি আমর ওপর খুশি হবে।’
‘আর একটা কথাও শুনতে চাই না । তুমি এখান থেকে গেলে আমি সত্যিই খুশি হব।’
‘আমি যাচ্ছি । তবে শুনে রাখ, যে মানুষগুলো উড়ছিল তাদের কেউ যদি বাচ্চাটাকে নিয়ে উড়ে পালিয়ে যায়, তবে কি সেটা ভূল বলা হবে?’
‘তোমার কি মনে হয় এতগুলো মানুষের চোখ ফাঁকি দিয়ে, বিল্ডিংয়ে গিজগিজ করা নিরাপত্তা সৈন্যদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে একটি বাচ্চা নিয়ে কেউ উড়ে পালিয়ে যেতে পারবে?’
‘এখানেই তো চোরের ক্রেডিট । এতকিছুর পরও সে চুরি করতে পেরেছে।’
‘অরেকজন এসেছেন চোরের সার্টিফিকেট দিতে! প্লিজ যাও তো।’
জেড আর কথা বাড়াল না । একা একা বকবক করতে করতে অন্য রুমে চলে গেল।ঠিক এমন সময় তুষারের অফিসের বস যোগাযোগ মডিউলে যোগাযোগ করলেন।জানালেন, ‘হৃদয়পুর’-এ নাকি কিছু সন্দেহজনক কাজ পরিচালিত হচ্ছে ।ওখানে গেলে ছেলেধরা বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ্ তথ্যও নাকি পাওয়া যেতে পারে । তিনি তুষারকে হৃদয়পুরে পৌছে তাদের স্থানীয় প্রতিনিধি সুমাইয়া তনুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললেন।
নতুন অ্যাসাইনমেন্ট পেয়ে তুষারের বেশ ভালো লাগছে । এই শহরে একটানা অনেকদিন থাকলে তার দমনদ্ধ মতোন লাগে! এখন তো অফিসের খরচেই সে দেশের সবচেয়ে সহেজ স্বাস্থ্যকর প্রাকৃতিক পরিবেশের অঞ্চলটিতে ঘুরে আসতে পারবে । সঙ্গে অজানা রহস্য উদঘাটনের থ্রিলও ফ্রি!
বাসা ছেড়ে কয়েকদিনের জন্য বাইরে কোথাও গেলে তুষারের একটাই চিন্তা; তা হলো জেডকে নিয়ে । অবশ্য আগে যতবারই এভাবে সে বাইরে গেছে, ততবারই জেডকে ফরহাদের কাছে রেখে গেছে। ফরহাদ রায়হান তার একমাত্র ঘনিষ্ঠ বন্ধু । ফারহাদও এখন পর্যন্ত ব্যাচেলর; তবে একজনের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক্ আছে।যাহোক, ফরহাদ সহযোগিতা করায় জেড-এর থাকা নিয়ে তুষারকে এখন আর অন্তত বিচলিত হতে হয় না ।
তুষার যোগাযোগ মডিউলের মাধ্যমে ফরহাদের সঙ্গে যোগাযোগ করল।
‘দোস্ত, কী খবর? হৃদয়পুর যাচ্ছি!’
‘তুই যাচ্ছিস হৃদয়পুরে, আর এদিকে আমার হৃদয় পুড়ে!’
‘মানে! বুঝলাম না!’
‘বোঝার দরকার নেই ।কেন যাচ্ছিস বল?’
ছেলেধরা রহস্যের কিনারা করতে!’
‘আছিস তো ছেলেধরা নিয়ে; এদিকে মেয়েধরা পাল্লায় পড়ে আমার জীবনে লাইফ বলে আর কিছু নেই!’
‘মানে কী ? আজকে কেমন করে যেন কথা বলছিস! তোর হঠাৎ কী হলো?’
‘মেয়ের বাচ-মা তো মেয়েকে আঠার মতো ধরে রেখেছে।’
‘হুম । দাঁড়া, এবার হৃদয়পুর থেকে ফিরে ফাটাফাটি একটা প্ল্যান করতে হবে।’
‘সেই কবে থেকেই তো কত প্ল্যান-প্রোগ্রাম করছি । তুই কেন ফোন করেছিস বলে ফেল । জেডকে আমার কাছে রাখতে বলিস না । এটা বাধে যা বলবি, তা-ই শুনব!’
‘কেন দোস্ত! জেড থাকলে তো তোর কাজেও একটু সুবিধা হবে।’
‘মাথা হবে! ওই আহাম্মক কাছে খাকলে মেজাজটা সবসময় চড়ে থাকে । তুই ওই নির্বোধের সঙ্গে থাকিস কীভাবে?’
‘নির্বোধ হবে পারে কিন্তু সহজ-সরল।’
‘হইছে । এখন রাখছি; টেনশনে আছি । গাধাটাকে রেখে যাস।’
‘ওকে দোস্ত।’
তুষার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল ।যোগাযোগ মডিউল দেখতে ট্যাব-এর মতোই সাধারণ; তবে এর কাজের পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক! বর্তমান পৃথিবীতে যোগযোগের এমন কোনো মাধ্যমে নেই যার জন্য এটি লাগে না । এখন টেলিভিশন বলে কিছু নেই । বিভিন্ন চ্যানেল এই কমিউনিকেশন মডিউলেই দেখা যায় । ‘গুগল আর্থ্ –এর মতো এতে আছে ‘গুগল মার্স্’, ‘গুগল স্যার্টান’ ইত্যাদি । সেগুলোর মাধ্যমে ঘরে বসেই ওসব গ্রহের ভূমিরূপ দেখা যায়, আবহাওয়ার রকমফেরও বুঝতে পারা যায়। এছাড়াও যোগাযোগ মডিউলের জন্য তৈরি হয়েছে মজার মজার অনেক অ্যাপ্লিকেশন । যেমন: এলিয়েনদের সঙ্গে যোগযোগের জন্য একটি অ্যাপ্লিকেশন আছে । সেই অ্যাপ্লিকেশন একটি টুল ব্যবহার করে ‘বেসিক তরঙ্গ উৎপন্ন করা যায় । এ তরঙ্গ পুরো মহাবিশ্বজুড়ে বিস্তৃত হিগস ফিল্ড দিয়ে পরিবাহিত হতে পারে । হিগস ফিল্ডে এই সাংকেতিক বার্তা পাঠিয়ে এলিয়েনদের সঙ্গে যোগযোগ করা সম্ভব- এমনটাই বিশ্বাস করেন অ্যাপ্লিকেশনের নির্মাতাগন!
তুষার যোগযোগ মডিউলে পৃথিবীজুড়ে চলা অরাজকতার খবর শুনে আজকেও রীতিমতো আঁতকে উঠল । কী শুরু হয়েছে! দুর্র্ধ্ষ সন্ত্রাসী দলগুলো এলিমোনাল ট্রিটমেন্ট নিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠছে ।কিন্তু কীভাবে তারা এগুলো হাতে পাচ্ছে, তা এক বিরাট প্রশ্ন! কারণ এলিমোনের অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের বিষয়ে প্রতিটি দেশই সজাগ ও অঙ্গীকারাবদ্ধ । এলিমোনের অপব্যবহারকারীদের জন্যও রয়েছে কঠিন আইনি ব্যবস্থা। ক্ষেত্রবিশেষে রাখা হয়েছে মৃত্যুদন্ডের বিধান!
*আল্লাহ হাফেজ*