বর্তমানে সারা বিশ্বে একটি মহা আতংকের নাম “করোনা”। চীনের উহানে ২০১৯ সালের শেষের দিকে এই ভাইরাসটি প্রথম দেখা যায় এবং ক্রমেই তা মহামারী আকার ধারণ করে বিশ্বের প্রায় সব দেশে ছড়িয়ে পড়ে। স্থবির হয়ে যায় বিশ্ব। সব দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে লকডাউন দেওয়া হয়। বাংলাদেশে এখনও এই লকডাউন চলছে।
আমি আমার এতটুকু বয়সে কখনো এমন ভয়াবহ মহামারী দেখিনি। তাই প্রতিদিনই নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছি। প্রায় তিন মাস ধরে ঘরে আবদ্ধ আমরা। বিভিন্ন জাতীয় দিবস, জাতীয় উৎসবও পালন করতে হয়েছে ঘরে বসে। এতদিন ঘরে থেকে দম যেন বন্ধ হয়ে আসতে চায়। চারপাশে শুনি মানুষের মৃত্যুর খবর। ভেসে আসে প্রতিবেশীদের আর্তনাদ! বুকটা হাহাকার করে ওঠে। এই রোগে মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। এই মৃত্যু যেন সমাজের মানুষের কাছে এক অভিশাপ! কেউ মৃত ব্যক্তির জানাযায় অংশগ্রহণ করে না। এমনকি দাফনের জন্যও মানুষ পাওয়া যায় না।মন চাইলেও মানুষ যেতে পারে না। কারণ গেলে নিজের জীবনেরই ঝুঁকি। আশেপাশের মানুষের মৃত্যুর খবর শুনলে তার আপনজনের দুঃখ ততটা বোঝা যায় না,যতক্ষণ না নিজের কোনো আপনজন মারা যায়।
একদিনের ঘটনা। সকালে ঘুমে থাকা অবস্থায় শুনতে পাই বাবা কাঁদছে। বুকটা ধ্বক করে ওঠে! লাফিয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়ি। কাঁদার কারণ জানতে চাইলে মা বলে আমার এক ফুপি মারা গেছে। শুনে খুব খারাপ লাগে। উনি আমাকে বড্ড বেশি আদর করতেন। বুকের ভেতর কোথাও যেন তার শূন্যতা অনুভব করি! এই দুঃসময়েও রক্তের টানে তাকে শেষবার দেখার জন্য ছুটে চলে যাই আমরা। গিয়ে তাকে শেষ বিদায় দেই। যখন তাদের ঘরে গেলাম তখন শুনলাম তার মেয়েও করোনায় আক্রান্ত। শুনে কিছুক্ষণের জন্য আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম! এর পরেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমরা সবাই মিলে তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম। দুঃখের বিষয় হলো আমার ফুপিকে দেখতে তার নিকট আত্মীয়রাও যায়নি এবং গোসল ও জানাযায় দুই তিনজন অচেনা মানুষ ছাড়া আর কেউ ছিল না।অবশেষে আমরা সবাই বাসায় ফিরে আসলাম। বাসায় এসে সবাই প্রথমে গোসল করে ফেলি। তারপর দুপুরের খাবার সেরে ঘুমিয়ে পড়ি। জীবন থেকে ধীরে ধীরে মুছে যেতে থাকে মানুষটির স্মৃতি। এটাই তাহলে বাস্তবতা!
এভাবেই আমার দিন কাটছিল খাওয়া দাওয়া, ঘুম, পড়াশোনা আর ইবাদত করার মধ্য দিয়ে। বিকালে ছাদে গিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করি। প্রকৃতিও যেন তার রং ছড়াতে থাকে। বিভিন্ন ধরনের পাখি উড়তে থাকে সেসময়। এসব দেখে মুগ্ধ হই আমি। অনেক মানুষ ছাদে উঠে ঘুড়ি উড়ায়। সেগুলো দেখি। আর ভাবি, ভাগ্যিস ছাদে উঠতে পারি! তা না হলে হয়তো মানসিকভাবে অসুস্থই হয়ে যেতাম।
একদিন দুপুরে গোসল সেরে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম। সেখানে দেখি কতগুলো দরিদ্র মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সবাইকে একজন লোক কার্ড দিল। তার নির্দেশ অনুযায়ী পুরুষ ও মহিলারা আলাদা লাইন ধরে দাঁড়িয়েছিল।তাদের ছবি নানাভাবে তোলা হচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে বুঝতে পারলাম এখানে ত্রাণ দেওয়া হবে। সেটি দেখে রুমে চলে এলাম। আমি খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি মানুষগুলো লাইন ভেঙে দাঁড়িয়ে আছে এবং তাদের চোখে মুখে ক্লান্তি ও হতাশার চিহ্ন। আবার কেউ কেউ আনমনে গালাগাল করছে। বুঝতে পারলাম যাদের ত্রাণ দেওয়ার কথা ছিল তারা ছবি তুলে নিজেদের প্রচার প্রচারণা শেষ করে ত্রাণ না দিয়ে পালিয়েছে। এটি দেখে দুঃখে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। এই দুঃসময়েও মানুষরূপী পশুগুলো এসব ধোঁকাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে! কবে এগুলোর ইতি ঘটবে-এই প্রশ্নটাই মনের মধ্যে বারবার বাজতে থাকে। তবে মানুষের মনুষ্যত্ব কিন্তু এখনও পর্যন্ত টিকে আছে! কারণ তার কয়েক দিন পরেই দেখলাম একদল স্বেচ্ছাসেবী যুবক অসহায়দের খাবার ও পোশাক দিচ্ছে। এদেরই একজন মাইক দিয়ে লোকদের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছে। আমার মনেও তাদেরকে সাহায্য করার প্রচণ্ড ইচ্ছে জাগে। মনে মনে ঠিক করি বড় হয়ে আমিও মানুষকে সাহায্য করার প্রাণপণ চেষ্টা করব।
দিনগুলো একইরকমভাবে কেটে যেতে থাকে। খবরে প্রতিদিন করোনার আপডেট শুনি। এছাড়াও অন্যান্য খবর থেকে জানতে পারি, নেতারা ত্রাণের চাল, খাবার ইত্যাদি চুরি করে। দুর্নীতি, লোভ তাহলে এখনও যায়নি মানুষের মন থেকে।আবার শুনি অনেকে নিজেদের কষ্টে অর্জিত সম্পদ দিয়ে মানুষকে যথাসম্ভব সাহায্য করছে।কারণ তারা প্রকৃত মনুষ্যত্বের অধিকারী।
লোভ, হিংসা, দুর্নীতি, ধোঁকাবাজি ইত্যাদি এখনও অনেক মানুষের চরিত্রের সাথে মিশে আছে। প্রকৃতি সমতা নিয়ন্ত্রণ করে বলেই হয়তো মানুষকে পৃথিবীতেই এসব পাপের ফল ভোগ করতে হয়। কিন্তু এসব খারাপ মানুষের মধ্যেও এমন কিছু ভালো মানুষ রয়েছেন যাদের কারণে এই পৃথিবী এখনও পর্যন্ত টিকে আছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনার সংক্রমণ ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। এর শেষ কোথায় আমরা কেউ তা জানি না। আমরা সবাই এখন একটা জিনিসই চাই। সেটি হচ্ছে বিশ্ব থেকে যেন এই মহামারী অনেক অনেক দূরে চলে যায়। মানুষ যেন আবার স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। শান্তিতে প্রশ্বাস নিতে পারে। এই রোগের কারণে আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়। পরিবেশ যেন সুন্দর থাকে। ভালো থাকুক সবাই, ভালো থাকুক আমাদের এই পৃথিবী।