মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য, বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তু, মহাবিশ্বের ভবিষ্যত নিয়ে মানুষের কৌতূহলের সীমা নেই।প্রাচীনকাল থেকে মানুষের মহাবিশ্ব সম্পর্কে অসীম কৌতুহল,যার ফলে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান ও চর্চা গড়ে তুলেছে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভিত্তিপ্রস্তর।জ্যোতির্বিজ্ঞান হলো দৃশ্যমান মহাবিশ্ব সম্পর্কিত এমন এক শাস্ত্র যে শাস্ত্রে সূর্য,চন্দ্র,গ্রহ,উপগ্রহ,নক্ষত্র,নীহারিকা প্রভৃতি মহাজাগতিক বস্তু সম্পর্কিত তথ্যাদির বিবরণ,আলোচনা ও অনুসন্ধান করা হয়।
এটি মূলত একটি পর্যবেক্ষণ নির্ভর বিজ্ঞান।জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাস বেশ প্রাচীনকালের।ধারণা করা হয়,যীশু খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৫০০০ বছর পূর্বে বিজ্ঞানের এই শাখাটির সূচনা ঘটে।জ্যোতির্বিজ্ঞানে আলোচিত যে মহাজাগতিক বস্তুটি প্রাচীনকালের প্রতিটি সংস্কৃতিতে বিশেষ গুরুত্ব বহন করত সেটি হলো তারা।তখনকার ধর্মচর্চায় এর ব্যবহার ছিল অনেক বেশি।প্রাচীন জ্যোতির্বিদরা অনেকেই বিশ্বাস করতেন, তারা স্বর্গীয় গোলকে নির্দিষ্ট স্থানে আবদ্ধ আছে এবং এরা অপরিবর্তনীয়।তবে চৈনিক জ্যোতির্বিদরা বুঝতে পেরেছিলেন নতুন তারার উদ্ভব হতে পারে।তখনকার নাবিকরা তারার মাধ্যমে দিক নির্ণয় করত।আবার ঋতুর সাথে এর সম্পর্কটিও মানুষ আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিল।
এবার আসি তারা সম্পর্কিত আধুনিক ধারণায়। তারা হলো প্লাজমা দশায় অবস্থিত দীপ্তিমান ও প্রায় গোলাকার মহাজাগতিক বস্তু।এরা নিজেদের অভ্যন্তরে থাকা পদার্থকে জ্বালিয়ে ফিউশন বিক্রিয়া ঘটায়।ফিউশন বিক্রিয়া হলো নিউক্লিয়ার সংযোজন বিক্রিয়া যে বিক্রিয়ায় একাধিক হালকা নিউক্লিয়াস একত্র হয়ে অপেক্ষাকৃত ভারী নিউক্লিয়াস গঠিত হয় এবং প্রচুর শক্তি উৎপন্ন হয়।এই শক্তি তারার পুরো অভ্যন্তরভাগ পার হয়ে বহিপৃষ্ঠ থেকে বিকিরিত হয়।ফলে তারাকে জ্বলজ্বল করতে দেখা যায়।রাতের আকাশে খালি চোখে অনেক তারা দেখা যায়।
তবে সুবিশাল দূরত্বের কারণে পৃথিবী থেকে এদেরকে স্থির বিন্দু বলে মনে হয়।আমরা যখন রাতের তারাভরা আকাশের দিকে তাকাই তখন দেখতে পাই,কিছু তারা এককভাবে রয়েছে আবার কিছু তারা একসাথে একটি তন্ত্র গঠন করে রয়েছে।যখন দুটি তারা একসাথে থাকে তখন সাধারণত এরা একে অপরকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে।আবার এরা যখন বেশি কাছাকাছি চলে আসে তখন একে অন্যের বিবর্তনকেও প্রভাবিত করতে পারে।
সৃষ্টির শুরুতে নক্ষত্র বা তারা ছিল গ্যাস ও ধূলিকণার মেঘরূপে।এই মেঘে ছিল হাইড্রোজেন ও ডিউটেরিয়াম (ভারী হাইড্রোজেন)। এই মেঘকে বলা হয় নেবুলা।মহাকর্ষের টানে এই গ্যাস ও মেঘপুঞ্জ জমাট বাঁধতে শুরু করে।ফলে এর অভ্যন্তরের চাপ ও উত্তাপ বাড়তে থাকে।উত্তাপ ক্রমশ বেড়ে এতই বেশি হয় যে,হাইড্রোজেন ফিউশন বিক্রিয়া ঘটে।ফলে হিলিয়াম পরমাণু সৃষ্টি হয় এবং বিপুল পরিমাণ শক্তি নিঃসৃত হয়।এভাবে নক্ষত্র বা তারার জন্ম হয়।
পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বে আনুমানিক ১০^২২ থেকে ১০^২৪ সংখ্যক তারা রয়েছে।কিন্তু তার অধিকাংশই পৃথিবী থেকে খালি চোখে দেখা যায় না। তারার অভ্যন্তরভাগের জ্বালানী মূলত হাইড্রোজেন।তারার মধ্যকার হাইড্রোজেন জ্বালানী ফুরিয়ে গেলে এর মৃত্যু ঘটে।একটি তারার সর্বমোট ভর মূলত তার বিবর্তন ও চূড়ান্ত পরিণতি নির্ধারণ করে দেয়।ভরের উপর নির্ভর করে তারার মৃত্যু বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে থাকে।
যেসব তারার ভর সূর্যের ভর অপেক্ষা ১.৪ গুণ কম এবং আকার পৃথিবীর আকারের সাথে তুলনীয় তাদের শ্বেত বামন বলে।শ্বেত বামনের জ্বালানী শেষ হলেও এদের মধ্যে উচ্চ শক্তিসম্পন্ন মুক্ত ইলেকট্রন থাকে যেগুলো শক্তি বিকিরণ করতে পারে।শক্তি বিকরণের পর ইলেকট্রনগুলো পরমাণুর সাথে এঁটে যায়।ফলে কালের ব্যবধানে শ্বেত বামন তারা নিষ্প্রভ থেকে নিষ্প্রভতর হতে থাকে।যাকে কালো বামন বলে।এই কালো বামন একটি নিষ্প্রভ বাতি ছাড়া আর কিছুই নয়।এভাবেই শ্বেত বামন তারা ধীরে ধীরে তাপীয় বিকিরণের মাধ্যমে নিষ্প্রভ হয়ে কালো বামনে পরিণত হয় এবং জীবনচক্র শেষ হয়।
আবার যেসব তারার ভর সূর্যের ভরের ৩ গুনের অধিক সেসব তারা কৃষ্ণবিবরে পরিণত হয়।অর্থাৎ প্রচণ্ড মহাকর্ষীয় বলের কারণে এর মহাকর্ষ ক্ষেত্র থেকে কোন কিছুই বের হতে পারে না।এমনকি আলোও না।আর এরূপ তারার জীবনচক্র কৃষ্ণবিবর হিসেবেই শেষ হয়।