কিয়ামতের দিন আমাদেরকে ৫টি বিষয় অবশ্যই জিজ্ঞাসিত হতে হবে।
হাদীসের অনুবাদঃ
ইবনে মাস’উদ (রা.) নবী (সা:) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি ইরশাদ করেছেন: কিয়ামতের দিন ইবনে আদমের পা তার রবের নিকট থেকে নড়তে পারবে না, পাঁচটি বিষয় জিজ্ঞাসিত না হয়ে। (আর তা হলো) তার আয়ুষ্কাল সম্পর্কে-কিভাবে তা সে ফুরিয়েছে, তার যৌবন সম্পর্কে-কিসে তা সে ক্ষয় করেছে, তার সম্পদ সম্পর্কে- কোথা থেকে সে তা উপার্জন করেছে এবং কোন পথে তা ব্যয় করেছে, আর তার জ্ঞান সম্পর্কে- তদানুযায়ী সে কী আমল করেছে। (তিরমিযী শরীফ)
রাবী / বর্ণনাকারীর পরিচয়ঃ
হাদীসটি বর্ণনাকারীর নাম আব্দুল্লাহ ইবনে মাস’উদ (রা.)। তার পিতার নাম মাস’উদ আর মাতার নাম উম্মু ‘আবদ। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা:) এর খাদেম ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পর থেকে রাসুল (সা:) এর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তার সাথে সাথে ছিলেন। এ কারণে হাদীস বর্ণনায় তার উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে।
ইসলাম গ্রহণের পূর্বে কিশোর বয়সে তিনি কুরাইশ গোত্রের এক সর্দার উকবা ইবনে আবু মুইতের ছাগল চড়াতেন। নবীজীর সাথে তার সাক্ষাতের বর্ণনা তিনি নিজেই দিয়েছেন। প্রতিদিনের ন্যায় তিনি উকবার ছাগলের পাল নিয়ে বের হয়েছেন। তিনি দেখতে পেলেন, দু’জন বয়স্ক লোক,যাদের চেহারায় আত্নমর্যাদার ছাপ বিরাজমান, দূর থেকে তারা তার দিকেই এগিয়ে আসছেন। তারা ছিলেন খুবই ক্লান্ত এবং পরিশ্রান্ত। পিপাসায় তাদের গলা ও ঠোট শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। কাছে এসে তারা তাকে সালাম জানিয়ে বললেন, তোমার ছাগলগুলো থেকে কিছু দুধ দুইয়ে আমাদেরকে দাও। আমরা তা পান করে আমাদের পিপাসা নিবৃত্ত করি।
তাদের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘এটা আমার দ্বারা সম্ভব নয়, কারন ছাগলগুলো তো আমার নয়। আমি এগুলোর রাখাল ও আমানতদার মাত্র।’ লোক দুটি আমার এ কথায় অসন্তুষ্ট হলেন না বরং তাদের মুখমন্ডলে উৎফুল্লতার ছাপ ফুটে উঠল। তাদের একজন আবার বললেন, ‘তাহলে এমন একটি ছাগী আমাকে দাও যে এখনও পাঠার সংস্পর্শে আসেনি।’ ইবনে মাসউদ তখন নিকটেই দাড়িয়ে থাকা ছোট একটি ছাগীর দিকে ইশারা করে দেখিয়ে দিলেন। লোকটি এগিয়ে গিয়ে ছাগীটিকে ধরে ফেলে এবং ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বলে হাত দিয়ে তার ওলান মলতে লাগলেন। এ দৃশ্য দেখে ইবনে মাসউদ মনে মনে বলছিলেন: কখনও পাঠার সংস্পর্শে আসেনি এমন ছাগী কি দুধ দেয়? কিন্তু কি আশ্চর্য! কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাগীটির ওলান ফুলে উঠে এবং প্রচুর পরিমানে দুধ বের হতে থাকে। দ্বিতীয় লোকটি গর্তবিশিষ্ট পাথর উঠিয়ে নিয়ে বাঁটের নিচে ধরে তাতে দুধ ভর্তি করেন। তারপর তারা উভয়ে পান করেন এবং তাকেও পান করান। ইবনে মাসউদ বলেন, আমি যা দেখছিলাম তা সবই আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। আমরা সবাই যখন পরিতৃপ্ত হলান তখন সেই পুন্যবান লোকটি ছাগীর ওলানটি লক্ষ্য করে বললেন, ‘চুপসে যাও’। আর অমনি তা পূর্বের ন্যায় চুপসে গেল। তারপর আমি সেই পূন্যবান লোকটিকে অনুরোধ করলাম, আপনি যে কথাগুলো বললেন আমাকে তা শিখিয়ে দিন। তিনি বললেন: তুমিতো শিক্ষাপ্রাপ্ত বালক। এই পূন্যবান লোকটিই ছিলেন রাসুলুল্রাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার সাথে ছিলেন আবু বকর (রা.)। এ ঘটনার কিছুদিন পরই ইবনে মাসউদ ইসলাম গ্রহণ করেন এবং রাসুল (সা:) এর একজন একনিষ্ঠ খাদেম হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) ছায়ার মত রাসুল (সা.) কে অনুসরণ করতেন। সফরে কিংবা ইকামাতে, গৃহের অভ্যন্তরে বা বাইরে সব সময় তিনি তার সাথে থাকতেন। রাসুল (সা:) ঘুমালে তিনি ঘুম থেকে জাগাতেন, গোসলের সময় পর্দা করতেন, বাইরে যাবার সময় জুতা পরিয়ে দিতেন, ঘরে প্রবেশের সময় জুতা খুলে দিতেন এবং লাঠি ও মিসওয়াক বহন করতেন। হুজরায় অবস্থানকালেও তিনি তার কাছে যাতায়াত করতেন। রাসুল (সা:) নিজের সকল বিষয়ে তাকে অবগত হওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। এ কারণে তাকে ‘সাহিবুস সির’ বা রাসুল (সা:) এর সকল গোপন বিষয়ের অধিকারী বলা হত। ৩২ হিজরী মোতাবেক ৬৫২ খৃস্টাব্দে তিনি ইন্তিকাল করেন।
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
হাদীসে রাসুল (সা:) পাঁচটি বিষয়ের উল্লেখ করে বলেন, কিয়ামতের দিন কোন বান্দাই এক পাও নড়তে পারবে না এই পাঁচটি বিষয়ের সন্তোষজনক জবাব না দিয়ে। নিম্নে আমরা সেই ৫টি বিষয়ের আলোচনা দেখব।
১. আমরা আমাদের আয়ুষ্কাল কিভাবে কাটিয়েছিঃ
জীবন বা আয়ু মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক অপার দান। জীবন যাপনের জন্য যে যতটুকু আয়ু পায় তার ভিত্তিতেই তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে এবং এর আলোকেই সে পুরুষ্কৃত বা তিরোষ্কৃত হবে। এখানে কোন কিছুই লুকানোর সুযোগ নেই। আল্লাহ বলেন, “প্রতিটি মানুষের ভালো ও মন্দ আমি তার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছি। আর কিয়ামতের দিন আমি তার জন্য একটা লেখা বের করব, যা সে খোলা কিতাব হিসেবে পাবে। বলা হবে তোমায় আমলনামা পড়। আজ তোমার হিসেব নেয়ার জন্য তুমি নিজেই যথেষ্ট।” (সুরা-বনী ইসরাঈল)
তাই আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহুর্তের কর্মের ব্যাপারেই সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে। আমাদের জীবনকে জবাব দিহিতার আলোকে গড়ে তুলতে হবে।
২. যৌবনকালকে আমরা কিভাবে ক্ষয় করেছিঃ
মানুষের জীবনে যৌবনকাল এক গুরুত্বপূর্ন অধ্যায়। এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাওয়ার উপযুক্ত সময় তার। গোটা জীবনের হিসেব নেয়ার পরও তাই আলাদা ভাবে আবার যৌবন কালের হিসেব নেয়া হবে। যৌবনকাল হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সময়। এ সময় শক্তি সাহস বেশী থাকে, যা ইচ্ছে তাই করা যায়। তাই এই যৌবনকাল আল্লাহর আনুগত্যে কাটাতে পারলে তার পুরস্কারও বিশাল। হযরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা:) ইরশাদ করেছেন: ’সাত শ্রেনীর লোক আছেন যাদেরকে মহান আল্লাহ তার আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দিবেন, যেদিন অন্য কোথাও কোন ছায়া থাকবে না। তারা হলেন-
* ন্যায়পরায়ন শাসক
* আল্লাহর ইবাদতের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা যুবক
* যার অন্তর মসজিদের সাথে লেগে থাকে
* এমন দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর জন্যই পরস্পরকে ভালোবাসে, আল্লাহর জন্যই পরস্পরে মিলিত হয় এবং তার জন্যই পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়
* যে একান্তে আল্লাহকে স্মরন করে তার ভয়ে অশ্রুসজল হয়
* ঐ ব্যক্তি যাকে কোন সম্ভ্রান্ত সুন্দরী রমনী অশ্লীলতার দিকে ডাকলেও সে বলে যে, আমি আল্লাহকে ভয় করি এবং
* ঐ ব্যক্তি যে দান করার পর তা এমনভাবে গোপন রাখে যে ডান হাত দিয়ে সে কি দান করল তা তার বাম হাতও জানে না।’(বোখারী)
এই হাদীসের ২ নম্বরেই যৌবনের কথা বলা হয়েছে। তাই আমাদের যৌবনকালের গুরুত্ব দিতে হবে এবং তা আল্লাহর আনুগত্যে অতিবাহিত করতে হবে।
৩. সম্পদকে আমরা কোথা থেকে আয় করেছিঃ
চাহিদা অসীম। চাহিদা পৌন:পুনিক। মানুষ মাত্রই সম্পদের মুখাপেক্ষী। তাই এই চাহিদা মেটাতে তাকে সম্পদ আহরণের চেষ্টা করতে হয়। এখানেই হলো কথা। এই সম্পদ আহরণ মানুষ ইসলাম নির্দেশিত পথেও করতে পারে, আবার অবৈধ পথেও করতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই ভুলে যায় সে কোথা থেকে সম্পদ আহরণ করছে। তাই সম্পদ আহরণ মানুষের জন্য এক মহা পরীক্ষাও বটে। যারা সম্পদ আহরণে হালাল-হারামের তোয়াক্কা করে না তাদের সম্পর্কে রাসুল (সা:) বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি কোথা থেকে সম্পদ আহরণ করল তার তোয়াক্কা করে না, মহান আল্লাহও তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাতে কোন তোয়াক্কা করবেন না।’
৪. সম্পদকে আমরা কোথায় ব্যয় করছিঃ
সম্পদ অর্জনের যেমন ইসলামী নীতিমালা রয়েছে, তেমনি আমাদের অর্জিত সম্পদ আমরা কোথায় কোথায় ব্যয় করতে পারব তারও নির্দেশনা ইসলামে রয়েছে। কিয়ামতের দিন আমাদের সম্পদ ব্যয়ের হিসাবও দিতে হবে। সুরা আল-বারাকার ২:৩ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন: “যারা গায়েব এর প্রতি ঈমান আনে, সালাত কায়েম করে এবং আমরা তাদেরকে যে রিযক দিয়েছি তা থেকে খরচ করে।” তাহলে বুঝা যাচ্ছে আমাদের সম্পদের মূল মালিক আল্লাহ তায়ালা। তিনি আমাদেরকে সম্পদ দান করেছেন। সুতরাং তার নির্দেশিত পথেই আমাদেরকে সম্পদ ব্যয় করতে হবে।
এই প্রসঙ্গে আল্লাহ আরও বলেন: “ওহে যারা ঈমান এনেছো! তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় করো সেই সম্পদ থেকে যা আমরা তোমাদের দান করেছি। (ব্যয় কর) সেই দিনটি আসার আগেই যেদিন অর্থের কোন আদান প্রদান থাকবে না, বন্ধুত্ব থাকবে না এবং থাকবে না সুপারিশও। মূলত: কাফিররাই হলো যালিম।” (সুরা- আল বারাকাহ, ২:২৫৪)
অতএব যখনই আমরা সম্পদ ব্যয় করতে যাব তখনই আমাদের স্মরন রাখতে হবে এটা আল্লাহর দেয়া সম্পদ। আল্লাহ না দিলে এই সম্পদ অর্জন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। তাই তার নির্দেশিত পথেই আমাদেরকে সম্পদ ব্যয় করতে হবে এবং আমাদের জবাবদিহীতার অনুভুতি নিয়ে ব্যয় করতে হবে। কারন, আল্লাহর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমরা এক পাও নড়তে পারব না।
৫. ইলম অনুযায়ী আমরা কি আমল করেছিঃ
আমলের পূর্বশর্তই হলো ইলম। কারন ইলম না থাকলে আমল করা যায় না। এজন্য ইলম অর্জন করতে হবে। তাই আমল করার জন্য প্রথমে আমাদেরকে ইলম অর্জন করতে হবে। বলা হয়েছে- ‘জ্ঞানার্জনের জন্য প্রয়োজনে সুদুর চীন দেশে যাও।’
জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনও বলেন: “(এ লোকের চাল-চলন ভাল, না ঐ ব্যক্তির যে) আদেশ পালন করে চলে, রাতের বেলা দাড়ায় ও সিজদাহ করে, আখিরাতকে ভয় করে এবং তার রবের রহমতের আশা করে? তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন, যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান হতে পারে? বুদ্ধিমান লোকেরাই উপদেশ গ্রহণ করে থাকে।” (সুরা আল-যুমার,৩৯:৯)
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর বলেন, না জেনে বেশি ইবাদত করার চেয়ে জেনে বুঝে অল্প ইবাদত করাও উত্তম। প্রকৃত ফকীহ সেই যে বুঝে শুনে ইবাদত করে, আর প্রকৃত জাহিল সেই যে নিজেকে পন্ডিত মনে করে। মানুষ দু’রকম: মুমিন এবং জাহিল। অতএব তুমি মুমিনকে কখনও কষ্ট দিও না, আর জাহিলের সাথে বিতর্ক করো না।
অতএব আমরা বুঝতে পারছি আমল করার জন্য আমাদেরকে ইলম অর্জন করতে হবে অর্থাৎ জানতে হবে। আর সেই ইলম অনুযায়ী আমাদেরকে আমল করতে হবে। ইলম না থাকলেও যেমন চলবে না, আবার যেটুকু ইলম আছে সে অনুযায়ী আমল না করলেও চলবে না। কারণ প্রত্যেকেই তার ইলম অনুযায়ী আমল করেছে কিনা সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কেউ এক পাও নড়তে পারবে না।
হাদীসের শিক্ষাঃ
* ইলম সঠিক না হলে আমলও সঠিক হওয়ার সুযোগ নেই।
* আমল বিহীন ইলম ফলবিহীন গাছের ন্যায়।
* না জেনে বেশী ইবাদত করার চেয়ে জেনে-বুঝে অল্প ইবাদত করাও উত্তম।
* সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে যেমন আমাদেরকে হালাল-হারামের লক্ষ্য রাখতে হবে, তেমনি সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও হালাল-হারামের খেয়াল রাখতে হবে।
* আমাদের সমগ্র জীবন আল্লাহর রাস্তায় পরিচালিত করতে হবে।
* যৌবনের রয়েছে অনেক গুরুত্ব। তাই যৌবনকাল যাতে কোনভাবেই পথভ্রষ্ট না হয় সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে হাদীসের আলোকে জীবন গঠন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের তৌফিক দান করুন। আমীন।