সম্ভবত পূজোর গোণ বলেই বড় রাস্তার অভিজাত জায়গাগুলিতে ঢুকতে পারলাম না। অথচ অবস্থা এমন যে, পরের দিনের জন্য অপেক্ষাও করা চলে না। অগত্যা পাশ্ববর্তী গলির ভিতরে একটি খোলা ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়ে ইতস্ততঃ বোধ করতে লাগলাম। ছাত্রটাত্ররা কোথাও থেকে দেখে ফেলে কি না? দেখতে পেলে তো পাশ কাটিয়ে যাবেই না, অবধারিতভাবে এসে অভিবাদন করবে। সিনেমা হলে কিংবা এইসব স্থানে ছাত্রদের গুরুভক্তি বৃদ্ধি পায়, এটা আমি বারবার লক্ষ্য করেছি। তাতে অবশ্য আমি কিছু মনে করি না, কিন্তু আজ এমন এক স্থানে ঢুকবার মুখে পরিচিত কেউ দেখলে নিশ্চই লজ্জায় মাথা হেট হতে আর বাকি থাকবে না।
শুনলাম ঘরের ভেতর থেকে কে মিহি সুরে বলল, ‘ও মেসো, বাবুকে ডাকো না।’
মাসী নহে, মোসো। বারান্দায় বসেছিলেন। এই কথার পর আমাকে ডাকলেন- ‘আসুন বাবু, একজন অবসর হয়েছে।– ওরে কামিনী, বাবুকে বসা।’
কামিনী এগিয়ে এল। রোগা, লম্বা, কালো নোংরা চেহারা। মুখ পান, হাতে পাতার বিড়ি। আমার পছন্দ হলো না। ততক্ষনে আর একজন অবসর হয়ে আসলে সেই দিকে তাকালাম। একে একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মনে হলো। আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে মেসো বলল,- ‘তাহলে বাবু আপনি ঐ মৃণালের কাছেই বসুন না হয়।” তাই বসলাম।
কিন্তু এমন নোংরা পরিবেশ। এদের বাসায় নিয়ে গেলেই সবচেয়ে ভালো হয়। কিন্তু পূঁজোর বাজারে বাসায় যেতে কেউই রাজী হবে না। আর গেলেও টাকা অনেক বেশি চাইবে।
মৃণাল বলল,- ‘আসুন বাবু, কোট্ টোট খুলে আরাম করে বসুন।’ বসলাম কিন্তু মনে শান্তি পাচ্ছিলাম না। এই রকম নোংরা পরিবেশে এই অবস্থায় কারও চোখে পড়লে এই ক্ষুদ্র মফস্বল শহরে ভারী দুর্ণাম হবে।
যা হোক, বেশ খানিকক্ষণ পরে কাজ চুকলো। কিন্তু মনের অস্বস্তিতে আর গরমে মাথা ধরে গেল। মৃণালকে বললাম, “মাথাটা একটু টিপে দাও তো।’
অভ্যস্ত, অভিজ্ঞ আঙ্গুলে মৃণাল আমার মাথাটা টিপে দিতে লাগলো। ভারি শান্তি পেলাম। জিজ্ঞাস করলাম কত দিতে হবে? মৃণাল একটু হেসে কুন্ঠার সহিত বলল, পূঁজোর বাজার! দুশো টাকাই দিন।
আমি তাকে দেড়শ টাকায় রাজি করিয়ে পয়সা বের করতে করতে মোসোর হুঙ্কার শুনতে পেলাম- ‘কি রে মৃণাল! তুই কি আজ এক বাবুকে নিয়েই কাটিয়ে দিবি নাকি? বাইরে যে কয়েকজন বাবু দাঁড়িয়ে আছেন।’
বাড়িতে এসে তাড়াতাড়ি গোসল করে ফেললাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ভালো করে দেখলাম মৃণাল আমার মাথার চুলটা বেশ সুন্দর করেই ছেঁটেছে। চুল যা বড়ো হয়েছিল! ভদ্র সমাজে বের হওয়াই দুষ্কর হয়ে পড়েছিল। তার ওপর আমি আবার মাস্টার মানুষ। ভাবছি যে, শহরের অভিজাত এ.সি. সেলুন গুলোর চেয়ে গলির মধ্যের এই সস্তা সেলুনগুলোতে চুল তো কোন অংশে খারাপ ছাঁটে না বরং পয়সাও কম লাগে। এখন থেকে কি তাহলে ঐ মৃণাল নাপিতের কাছেই যাব?