সালটা হয়তো ২০১১ কিংবা ২০১২ সাল হবে। ঠিক করে মনে করতে পারছি না। ডিসেম্বরের শেষ পর্যায়ে,কন কনে শীত। হঠাৎ করে নোয়াখালির হাতিয়া, নিঝুমদ্বীপ যাওয়ার সুযোগ চলে আসলো। শহরের ব্যস্তময় জীবন অতিবাহিত করতে করতে একঘেয়ে চলে আসছে। তাই হাতিয়া, নিঝুমদ্বীপ ভ্রমনের সুযোগটা হাতছাড়া করি নি।
আমি আর আমার বন্ধু তুহিন শহরের একটা ভাল কোম্পানিতে চাকরি করি। দুজনে এখনো বিয়ে করিনি। তাই ভ্রমনের যে কোন সিদ্ধান্ত কোন কিছু না ভেবেই নেওয়া যায়। তুহিনই প্রথম আমাকে হাতিয়া, নিঝুমদ্বীপ ঘুরতে যাওয়ার অফার করলো। দেখলাম যে সামনের সাপ্তাহে রবি এবং সোমবার অফিস বন্ধ আছে আর শুক্র,শনিবার তো এমনিতে বন্ধ।
তাহলে মোট চারদিন আমরা সুযোগ পাবো ঘুরতে যাওয়ার জন্যে। আমরা আমাদের আরেক ব্যবসায়ী বন্ধু সোহেলকেও আমাদের সাথে ভ্রমন করার জন্য অফার করলাম। সোহেলও রাজী হয়ে গেল আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য। তিনজনের সম্মতিতে ঠিক হল আগামী বৃহস্পতিবার রাতে আমরা নোয়াখালির উদ্দেশ্যে রওনা দিবো। আজ মঙ্গলবার হতে আর একটা দিন আছে।
যেহেতু চারদিনের ভ্রমন তাই তেমন একটা গোছগাছের দরকার পড়েনি। ওহ বলে রাখা ভাল হাতিয়া তুহিনের দুরসম্পর্কের এক মামা থাকেন। আমরা প্রথম উনার বাড়িতেই উঠবো। দেখতে দেখতে বৃহস্পতিবার চলে আসলো। আমরা রাতের কোচের জন্য টিকিট কাটলাম।
ঢাকার টিটি পাড়া থেকে আমাদের বাস ছাড়বে রাত ১২.৩০ মিনিটে। তিনজনই মোটামুটি একটু সময় হতে রেখে বের হলাম। রাস্তায় জ্যাম থাকা সত্বেও আমরা যথাসময়ে বাস কাউন্টারে হাজির হলাম। ঠিক সময়ে বাস ছাড়লো। বাসে খাওয়ার জন্য শুকনো কিছু খাবার আর পানি নিলাম। সারারাত বাস চলল।
ভোর ৬ টার দিকে আমরা নোয়াখালি এসে পৌঁছালাম। বাস থেকে নামলাম। কনকনে ঠান্ডা। এখনো সূর্য উঠেনি। আমাদের প্রথমে যেতে হবে চেয়ারম্যান ঘাট, ওখান থেকে হাতিয়ার উদ্দেশ্যে সী ট্রাক(অনেকটা লঞ্চের মত), ট্রলার এগুলা ছেড়ে যায়। একটা সিএনজি করে ঘাটের দিকে রওনা দিলাম।
যাওয়ার পথে নোয়াখালি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বদ্যালয়ও দেখা হল। প্রায় ঘন্টা খানেক পর আমরা ঘাটে এস পৌঁছেছি। ঘাটে দেখলাম যে অনেক ভীড়। ভিতরে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম সী ট্রাক কয়টায় ছাড়বে। জানতে পারলাম সকাল ৯.৩০ মিনিটে ছাড়বে। এখনো প্রায় ৪০ মিনিট বাকি আছে। টিকিট কেটে এর মাঝে আমরা নাস্তা সেরে নিলাম।
ততক্ষনে চারদিক রোদ ঝলমলে করছিলো। সী ট্রকে উঠে আমরা আমদের আসনে বসলাম। যথাসময়ে ছাড়লো। সাগরের জলের ঢেউতে হেলে দুলে চলতে লাগলো আমাদের নৌযানটি। চারদিকে অপরূপ সৌন্দর্য দেখে আমরা মুগ্ধ হলাম। সাগরে দেখলাম অনেক মাছ ধরার ছোট বড় ট্রলার। মাঝে মাঝে কয়েকটা লাইটার জাহাজও দেখা মিলল। প্রায় দুঘন্টা পর হাতিয়ার ঘাটে আমাদের নৌযানটি ভিড়লো।
আমরা নামলাম সীট্রাক থেকে। দেখলাম যে তুহিনের মামা আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। আমাদের দেখে উনি খুব খুশি হলেন। একটা অটোতে উঠে আমরা উনাদের বাড়ি পৌঁছালাম। সবাই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। আমরা আসাতে দুপুরে ভাল ভাল রান্নার আয়োজন করা হলো। সবাই গল্প করতে করতে দুপুরের খাবার খেলাম। মামার থেকে সব জেনে নিলাম। তিনি আমাদের সব বললেন এবং আমাদের সাথে নিঝুমদ্বীপ যেতে রাজী হলেন এবং অনেক উৎসাহ দেখালেন।
যেহেতু আমরা এখানে ভাল করে কিছু চিনি না তাই উনি আমাদের সাথে যেতে রাজি হওয়াতে আমাদের জন্য ভালই হল। ঠিক করলাম আজ এবং কাল আমরা হাতিয়া ঘুরবো পরের দুদিন নিঝুমদ্বীপ ঘুরবো। খাওয়ার পর রেষ্ট নিয়ে বিকালে মামা আমাদের নিয়ে বের হলেন। দেখলাম যে হাতিয়াতে ছোট ছোট যানবাহন আর অনেক মোটরসাইকেল। প্রথমে মামা আমাদের নিয়ে গেলেন মাছের আড়তে ।
দেখলাম হরের রকমের সাগরের মাছ। দামেও সস্তা আর তরতাজা। রাতের জন্য মামা আমাদের জন্য বড় সাইজের দুইটা ইলিশ মাছ নিলেন। মোটামটি দুদিন হাতিয়া ঘুরে আমরা পরেরদিন সকালে নিঝুমদ্বীপের উদ্দেশ্যে ট্রলারে করে রওয়া দিলাম। হাতিয়া থেকে নিঝুমদ্বীপ দেখাও যায় মাঝে একট নদী। ট্রলারে করে মোটামুটি ৩০/৪০ মিনিটের মত লাগলো। নিঝুমদ্বীপ নেমেই একটা ভাললাগা শুরু করলো।
এতদিন নিঝুমদ্বীপের হরিনের গল্প শুনেছি আজ নিজের চোখে দেখবো। প্রথমে আমরা রাতে থাকার জন্য একটা ছোটখাট হোটেল ঠিক করলাম। এখনকার মত তখন থাকা খাওয়ার এত সুযোগ সুবিধা ছিল না। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে ধেয়ে বিকালে দ্বীপ ঘুরতে বের হলাম। এখানকার টাটকা সুস্বাদু মাছ খেতে খুবই মজাদার। খেয়েধেয়ে একটা জঙ্গলের মাঝে হাঁটা শুরু করছি, একটু দুর যেতে চোখে পড়লো কয়েকটা হরিন।
আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে দৌড়ে পালালো। তখন এখনকার মত এত স্মার্টফোন ছিল না,তবুও একটা হ্যান্ডক্যাম নিয়ে গেছিলাম। মুহুর্তগুলো ধরে রাখার জন্য। তো দুদিন ঘুরলাম,খেলাম অনেক মজা করলাম। বিকালে মামার সাথে আবার হাতিয়া চলে আসলাম। রাতে মামার সাথে অনেক গল্প হল। মাঝে মাঝে মন খারাপও লাগলো। আগামীকাল সকালে আবার সেই যান্ত্রিক শহরে চলে আসতে হবে। গল্প করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেল, সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে মামার ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো। সবাই ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করলাম। মামি অনেক মজার মজার পিঠা বানালেন। এসব মজার স্মৃতি গুলা ভুলার নয়। মামা মামির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা দিলাম সেই যান্ত্রিক শহর ঢাকার উদ্দেশ্যে।