সামিম অনেকদিন পর তার দাদুবাড়ি এসেছে। তার দাদুবাড়ি বাংলাদেশের একটি সুজলা-শ্যামলা গ্রামে। সামিম এবং তার পরিবার ঢাকায় থাকে। এবার শীতের ছুটিতে তার পরিবার ছুটি কাটাতে তাদের দেশের বাড়িতে এসেছে। এখানে সামিমের দাদা-দাদি আর ২ জন কাজের লোক থাকে।
সামিম ঢাকায় পড়াশোনা করে। সে আধুনিক জীবনযাপন করে থাকে। গ্রামে এসে মোটেও তাকে ভালো লাগে না। সে তাই মনমরা হয়ে ঘরের এককোণে বসে থাকে। এই গ্রামেই থাকে একটি ডানপিঠে বালক। সে রাত দিন কিছুই বুঝে না। যখন ইচ্ছা যেখানে সেখানে চলে যায়। কারণ, তাকে শাসন করার মতো কেউই নেই। তার বাবা শহরে কাজ করে। আর তার সৎ মা তার কোনো খোঁজই রাখে না।
ফলে সে কোথায় গেলো, কি খেলো, তা নিয়ে মাথা ঘামাবার কেউই নেই। তার মা বেঁচে থাকলে হয়তো তার খোঁজ করত। কিন্তু তার মা তো কবেই মারা গেছে। এই বালকটি হাটে-বাজারে কারো কোনো কাজ করে দিলে তারাই একে খেতে দেয়। বাড়িতে কারো কাজ করে দিলে, তারাও একে ভালো খেতে দেয়। কিন্তু তার নিজের বাড়িতে হাড়-ভাঙ্গা খাটুনি করার পরও তার সৎ মা তাকে ভালো করে খেতেই দেয় না। তাই প্রায় রাতের বেলাও সে তার বাড়ি ফেরে না।
সামিম যেদিন এই গ্রামে আসলো, সেদিন এই বালকটি তার সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য আসতে চেয়েছিল। কিন্তু, রহিম চাচার একটা বিশেষ কাজ করার জন্য সে দিনের বেলা আসতে পারে নি। তাই সে রাতের বেলা এসেছে। সে জানে যে এই বাড়ির লোকেরা সামিমকে কোন ঘরে থাকতে দিবে। কারণ, এই বাড়ির একমাত্র বংশরক্ষক হলো সামিম। তাই তাকে তারা সবচেয়ে ভালো ঘরটা দিবে। সেখানে সে ঘুমাবে।
আর সে ঘরটা হলো বাগানের পাশে। তাই সে চুপি চুপি ওই বাড়িতে ঢুকে বাগানের দিকে গেলো। বাগানের ভিতরে প্রবেশ করে সে। এরপর চুপি চুপি করে ওই ঘরের জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। জানালাটা তখন বন্ধ ছিল। তাই সে জানালায় টোকা দেয়। কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে সে ডাকতে থাকে, “কে আছো? জানালা খুলো। জানালা খুলো।”
এই শব্দ শুনে সামিম হকচকিয়ে উঠে। সে বুঝতে পারে না। এটা কিসের ডাক। কারণ, ডানপিঠে বালকটি খুব নরম সুরে ডাকতে থাকে। আর ঠাণ্ডা হাওয়ার কারণে সব আওয়াজ যেন কিরকম ভুতুরে ভুতুরে ঠেকতেছিল। সামিম খুব ভয় পেয়ে যায়। কারণ, আওয়াজটা সময়ের সাথে সাথে আরও বেশী করে বাজতে থাকে। সে ভয়ে দরজা খুলে অন্য রুমে চলে যায়। সেখানে গিয়ে তার বাবা-মাকে, দাদুকে ডেকে আনে। সবাই এই আওয়াজ শুনে।
১মে তাদের কাছে কিছু মনে হয় না। কিন্তু অনেক্ষন ডাকার পরও যখন সামিম জানালা খুলল না, তখন বালকটি আরও জোরে জোরে ডাকতে লাগে। এতে করে ঠান্ডার কারণে, তার গলা বসে যায়। আর তার আওয়াজ অনেক বেশী ভুতুরে মনে হয়। ফলে বাড়ির লোকজন মনে করে জানালার ওপাশে নিশ্চয়ই কোনো ভুত আছে। তাই তারা লাঠি, আগুন নিয়ে বাগানের পাশে দৌড় দিলো।
বালকটি দেখল অবস্থা বেগতিক। সে মনে করলো, সে সামিমকে ডিস্টার্ব করার জন্য মনে হয় পানিশমেন্ট পাবে। বাড়ির লোকজন তাকে মনে হয় ইচ্ছামতো মারবে। তাই সে ভয়ে প্রাচীর টপকে পালিয়ে গেলো। বাড়ির লোকজন এসে দেখে বাগানে কেউ নেই। তাই তারা চলে যায়।
পরের রাতে আবার সে সামিমকে ডাক দেয়। সামিম আবার ভুতের কথা মনে করে বাড়ির লোকজনদের ডাকে। বাড়ির লোকজনও আবার ভুতের কথা মনে করে লাঠি, আগুন নিয়ে বাগানে দৌড় দেয়।
বালকটি আবারো ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়।
এভাবে ৩-৪ দিন ঘটলো।
এরপর ৫ম দিনে দিনের বেলা এসে বালকটি সামিমকে ডাক দেয়। কারণ আজকে বালকটির দিনে কোনো কাজ ছিল না। ফলে আজকেও সামিমসহ বাড়ির সবাই দিনের বেলাতেই ভয় পেয়ে যায়। তারা মনে করে, এটা মনে হয় অনে ভয়ংকর ভুত। ভয়ংকর না হলে, দিনের বেলা কোনো ভুত আসতে সাহস পেত না। ফলে ভয়ে তারা বাগানেই গেলো না। বালকটি কোনো সাড়া-শব্দ না পেয়ে চলে যায়।
এই ঘটনা রাতারাতি গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামের সবারই বিশ্বাস জন্মে যে, ওই বাগানে নিশ্চয়ই কোনো ভুত থাকে। তারা তাই ভুতের ভয়ে রাতের বেলা কেন, দিনের বেলাই কেউ ওই বাগানের ত্রি-সীমানার কাছেও যায় না।
এই ঘটনা বালকটির কানেও যায়। কিন্তু সে ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারে না। কারণ, সে যদি বলে, “আমি ওখানে গিয়ে ডাক দিতাম”, তবে অনেকেই তাকে বদমাইশ, জোচ্চোর, ইত্যাদি বলে ডাকবে। তাছাড়া, তার পিঠে উত্তম মাধ্যমও পড়তে পারে।
তার উপর সামিমের পরিবার অনেক সম্পদশালী। তারা জানতে পারলে, তাকে হয়তো তাদেরকে ভয় দেখানোর জন্য গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিতে পারে। কেউই তাকে সাহায্য করবে না। তার বাবা তো শহরে থাকে। আর সৎ মা তো সবসময় চায় সে মরুক। এসব কথা ভেবে বালকটি চুপ করে থাকে। এ ব্যাপারে কোনো কথাই বলে না।
অন্যদিকে গ্রামে এ নিয়ে একটা তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যায়। ওই বাগানে ভুতের বাস, পেত্নির বাস, শাকচুন্নির বাস, ইত্যাদি নানান কথা বলা শুরু হয়।
একজন আরেকজনের কানে কানে বলে, “নিশিরাইতে কার ডাক শোনা যায়!”