কনকনে শীত! জানালার গ্লাসটা আবছা কুয়াশায় ঢাকা। এমন শীত এর আগে কখনো পড়েছে বলে সালেমের মনে হয়না। জানালার পর্দাটা ঠিক করে সে আবার আগের স্থানে গিয়ে বসলো। বাসার সবাই তখন সালাতুল ফজরে মগ্ন। ওয়ারড্রবের উপর থেকে সে ছোট সাইজের কুরআনটা হাতে নিয়ে প্রাণ ভরে চুমু খেলো। এ’যে তার প্রাণ! এই কুরআনকে বুকে গেঁথে নেওয়ার জন্যই তো তার এই সংগ্রাম।
সালেম খুন মনোযোগ দিয়ে তেলাওয়াত করছে। তার এই সমধুর তেলাওয়াত শুনে যে কেউ গভীর ভাবনায় হারিয়ে যাবে। মারওয়ার বেলায়ও বিপরীত কিছু ঘটলো না। বেশ কিছুক্ষণ ভাইয়ের তেলাওয়াত শুনে সে তৃপ্তি নিলো।
“চা খাবি?”
বোনের দিকে তাকিয়ে সালেম মুচকি হাসলো।
এই হাসি সম্মতির লক্ষ্মণ। মারওয়া ভাইয়ের দিকে সাদা কাপটা এগিয়ে দিতে দিতে বলল,
“আচ্ছা সালেম ভাই-বোনের সম্পর্ক এতো সুন্দর হয় কেন?”
চতুর সালেম এই উত্তর সাথেসাথে দিতে পারলো না। এহেন প্রশ্ন শুনে প্রথমে তার কপালটা ভাঁজ হয়ে গেলো। এই উত্তরটা কি আদৌও তার জানা আছে?
সে হাল ছাড়লো না। কিছুক্ষণ তন্ময় হয়ে ভাবলো।
ভাইকে চিন্তিত দেখে মারওয়া কথা ঘুরিয়ে বলল,
“থাক বাদ দে। আচ্ছা শুন ভেবেছিলাম আজ একটু বেরোবো। অনেকদিন হলো এখানে এসেছি। জানিস আমার খুব বিরক্ত লাগছে। এভাবে আর থাকা যায় তুই বল?”
“উঁহু! অবশ্যই না। কোথায় যাবে ঠিক করেছো?”
মারওয়া ঠোঁটে হাসি এনে বলল,
“তুই তো জানিস আমাদের দৌঁড় হাতিরঝিল পর্যন্ত। এবারও নাহয় সেখান থেকেই ঘুরে আসবো।”
সালেম কুরআনের চেইন লাগাতে লাগাতে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে। এখন যেহেতু দিন ছোট তাই আমাদের দেরী করা চলবে না। আসরের সালাত আদায় করেই আমরা দু’জন বেরোবো ইনশাআল্লাহ্।
আজ তেমন মানুষ নেই। কিছুক্ষণ পরপর দু একজন মানুষ দ্রুত পায়ে এই পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। খুব তাড়া আছে বলেই হয়তো কারো দিকে কেউ তাকাচ্ছে না। বেশ ঠাণ্ডা পড়ছে। মারওয়া ধবধবে সাদা চাদরটা গায়ে জড়াতে জড়াতে বলল,
” তোর কি ঠাণ্ডা লাগছে না ভাইয়া? তোকে কত করে বলেছি হাতে করে সুয়েটারটা নিয়ে আসার জন্য।”
“আরে আপুমনি তুমি একটু বেশিই বকছো। আমি কি তোমাকে বলেছি যে আমার শীত করছে?”
মারওয়া হাসলো। নিকাব ভেদ করে তার হাসির শব্দ বেরোলো না। সে চাদরের একপাশ ভাইয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“চল আজ দু’জন মিলে এই চাদর গায়ে দেয়।”
সালেম আনমনে হাসলো। এই মেয়েটা আসলেই পাগল। প্রিয় মানুষদের জন্য নিজের সবটুকু বিসর্জন দিতে রাজি। এজন্যই তো সে এতো ভালোবাসে তার প্রিয় বোনটাকে।
“আপনেরা ফুল লইবেন?”
দূর্বল কন্ঠের কথাটা সালেমের কানে না গেলেও মারওয়ার কানে এসে থেমে গেলো। সে ডান পাশে তাকিয়ে দেখলো দু’জন ছেলে-মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দেখেই তার বুকের ভেতর হুহু করে উঠলো। সে সালেমকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,
“এই সালু!”
সালেম ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ফুল কিনবে?”
মারওয়া ক্ষীণ কন্ঠে জবাব দিলো,
“না। এই ফুলগুলোর সাথে সময় কাটাবো। ঝরে পড়া ফুলগুলোর মধ্যে যে ধুলো জমেছে তা আজ আমাদের সাথে মাখামাখি করে নিবো।”
সালেম বোনের কোনো কথাই বুঝতে না পেরে অবুঝ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
মারওয়া খুব গভীরভাবে তাদের দেখছে। ছেলেটার বয়স আট আর মেয়েটার চার কিংবা পাঁচ হবে। মারওয়া ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলল,
“তোমরা কি আমার সাথে বসবে? আমি তোমাদের সাথে অনেক গল্প করবো।”
মেয়েটা রাজি হয়ে গেলেও ছেলেটা কিছু বলল না। বারবার নিজের বালতিটে থাকা বাকী ফুলগুলোর দিকে চোখ বুলাতে লাগলো। এই বয়সেই তার কাঁধে দায়িত্ব! মারওয়া মৃদু হেসে বলল,
“চিন্তা করো না ভাইয়া। তোমার ফুলগুলো আমি কিনে নিবো।”
এবার আর সে ‘না’ করতে পারলো না। খিলখিল করে হেসে দিয়ে বোনকে বলল,
“মিমু তুই বয় ভাইয়ে তোর জন্য বেলুনটা নিয়া আইতাছি।”
ভাইয়ের কথায় পিচ্চি মেয়েটার চেহারায় এক অন্যরকম আনন্দ দেখা গেলো। মারওয়া মেয়েটাকে নিজের পাশে বসিয়ে মাতায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“কি নাম তোমার?”
“মিম।”
“আর তোমার ভাইয়ের নাম?”
“সিয়াম।”
“বাহ বেশ সুন্দর নাম তো! কে কে আছে তোমাদের বাসায়?”
মিম চিকন চিকন কন্ঠে জবাব দিলো,
” মা ভাইয়ে আর আমি।”
“বাবা নেই?”
মেয়েটার মন খারাপ হয়ে গেলো। সে ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“মা বলে আব্বায় নাকি মইরা গেছে। কিন্তু আমরা জানি আব্বায় বাঁইচা আছে। আমার ভাইয়ে তারে চিনে।”
তাদের কথা বলার মাঝেই ছেলেটা একটা বড় বেলুন এনে তার বোনের হাতে দিলো। মারওয়া লক্ষ্য করলো একজন দিয়ে আনন্দিত আর উপর নিয়ে আনন্দিত। আর তাদের এই দুজনের আনন্দ দেখে মারওয়া এবং সালেমের চোখে পানি চলে এলো।
মারওয়া মৃদু কন্ঠে বলল,
“বড় হয়ে কি হতে চাও তোমরা?”
মিম জোরে জোরে বলল,
“আমি বড় হইয়া একজন ডাক্তার হইতে চাই।”
“আর তুমি কি হতে চাও সিয়াম?”
ছেলেটা কিছুক্ষণ ভেবে তারপর বলল,
“আমি কি হমু সেটা ঠিক জানিনা। তবে এটা কওন যায় আমি বড় হইয়া আমার মারে আর বইনেরে বালা রাখমু। আমি বড় হইয়া আমার বইনের স্বপ্ন পূরণ করমু। আমার বইন হইবো একজন বড় ডাক্তার। আমি তখন সবাইরে চিৎকার কইরা কমু ” এই ফুলওয়ালার বইন আইজ ডাক্তার হইছে”
এবার মারওয়া নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না। সে মিমকে নিজের কাছে টেনে জড়িয়ে ধরলো। এই জড়িয়ে ধরার মাঝে অন্যরকম এক আনন্দ লুকিয়ে ছিলো। এই আনন্দ যে পৃথিবীর সব কিছুর বিনিময়েও পাওয়া যাবে না।
“জানেন আপা আমরা গরীব বইলা সবাই আমগো দিহে কেমন করি চাহে। তারা মনে করে আমরা মানুষ না। আচ্ছা আপনেই কন গরীব হইছি বইলা কি আমগোরে মানুষ কওয়া যাইবো না?”
সালেম এবার কিছুটা নড়েচড়ে বসে বলল,
“অবশ্যই মানুষ! আমরা সবাই মানুষ চাই কেউ ধনী বা গরীব হোক। সবাইকে আল্লাহ তাআ’লা সৃষ্টি করেছেন। আর তাছাড়া আমরা সবাই-ই তো মাটির তৈরি। সময় পুরালে মাটিতেই মিশে যেতে হবে।”
সিয়ামের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সে ময়লা লেগে থাকা দুই হাতে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল,
“এই কথাটা কেউ বোঝেনা। আমগোরে শুধু ধাক্কা আর খারাপ কথা কইতে পারলেই বড়লোক সাবে গো শান্তি লাগে।”
সালেম আফসোস ভরা কন্ঠে বলল,
“এভাবে বলো না প্লিজ। আমার অনেক খারাপ লাগে। আমি বুঝতে পারছি সব। আমাদের দেশের তথাকথিত কিছু মানুষ এমন বিহেভ করে যা সত্যিই মেনে নেওয়া যায় না। তবে তোমাদের দু’জনের জন্য অনেক অনেক দু’আ রইলো পিচ্চিরা।”
মারওয়া এবং সালেম তাদের দুজনের হাত ধরে নিজেদের সাথে নিয়ে গেলো। সারা বিকেল ধরে চারজন ভাই-বোন ঘুরাঘুরি করলো শহরের পথে। সাথে ছিলো মায়া আর অনেক আনন্দ। অবশেষে যাওয়ার সময় হয়ে গেলো। মারওয়া তাদের হাতে কিছু টাকা দিলো। সালেম স্থানীয় দোকান থেকে কিছু খাবার কিনে তাদের হাতে দিলো। যাবার আগে দুই ভাই-বোন তাদের জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। মারওয়া নিঃশব্দে চোখের পানি বিসর্জন দিলো।
বিদায়ের আগে সিয়াম কান্না জড়ানো গলায় বলল,
“আপনেরা দু’জন সত্যিই অনেক বালা। আমগো আবার কোনো একদিন দেহা হইবো। সেদিন আপনেগোরে অনেক জায়গায় লইয়া যামু।”
সূর্যটা আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে। সালেম এবং মারওয়া কোনো কথা বলছে না। তারা এক দৃষ্টিতে আসমানের দিকে তাকিয়ে আছে। আজকের এই সময়টা ছিলো তাদের জীবন স্মরণ রাখার মতো একটা সময়। সালেম বোনের হাতে হাত রেখে বলল,
“ভাই-বোনের সম্পর্ক এতো সুন্দর হয় কেন বলবো আপুমনি?”
মারওয়া ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“অবশ্যই! আমি তোর উত্তর শুনতে চাই।”
সালেম নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“আবদার, ভালোবাসা, খুনসুটি, রাগ আর অভিমান থাকে বলেই ভাই বোনের সম্পর্ক গুলো এতো এতো সুন্দর হয়! ভাই রাগ করলে বোন ভাঙ্গাবে, বোন আবদার করলে ভাই পূরণ করবে। শত বিপদেও একজন আরেকজনের হাত শক্ত করে ধরে ভরসা যোগাবে। আর আমার মনে হয় এজন্যই সম্পর্ক গুলো এতো মধুর হয়।”
মারওয়ার চোখের পানি ছলছল করছে। সে ভাইয়ের হাত শক্ত করে ধরে বলল,
“যেমন ঐ ফুলগুলোর সম্পর্ক! দেখেছো কি সুন্দর একজন আরেকজনের হাত ধরে থাকে। সবসময় ভালো থাকুক তারা এবং আমরা।”
“উঁহুম এভাবে বলো ” সবসময় ভালো থাকুক ভাই-বোনের সম্পর্ক গুলো আর ভালো রাখুক প্রত্যেক ভাই-বোনকে…!