বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি ক্ষুদ্র দেশ। আয়তনে ছোট হলেও দেশটিতে দারুণ সব স্থান রয়েছে যেগুলো ভ্রমণ বা ট্যুরের জন্য পারফেক্ট। আমরা অনেকেই স্বপ্ন দেখি বিদেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে যাওয়ার। কিন্তু বাংলাদেশে যে কত মনোরম এবং ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে সেগুলো কয়জন ঘুরে দেখেছি? আজ আপনাদের এমন ৭ টি স্থানের নাম বলবো যেগুলো জীবনে একবার হলেও ঘুরে দেখা উচিৎ। স্থানগুলোতে কিভাবে যাবেন এবং কোন কোন দর্শনীয় স্থান রয়েছে সেগুলোর বিস্তারিত তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
সুন্দরবনঃ এটি শুধু বাংলাদেশের নয়, পুরো বিশ্বের মধ্যে অন্যতম ভ্রমণ স্থান। অনেক দূরের দেশ থেকেও মানুষ এখানে ঘুরুতে আসে। ১৯৮৭ সালে এটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষনা করা হয়। সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গ কি.মি, যার মধ্যে বাংলাদেশে আছে ৬,০১৭ বর্গ কি.মি এবং বাকি অংসজ ভারতে। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালি ও বরগুণা জেলা নিয়ে বিস্তৃত এই সুন্দরবন।
এখানে গেলে আপনি দেখতে পারবেন বিচিত্র সব প্রজাতির পশু পাখি। আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা বলা শুরু করলে হয়ত সারা দিন পার হয়ে যাবে। সুন্দরবন ভ্রমণে যেতে হলে প্রথমে আপনাকে খুলনা যেতে হবে। ঢাকা থেকে খুলনার বাস সারাদিনই এভেইলেবল থাকে। খুলনা নামার পর ওখান থেকে বাসে করে বা গাড়ি ভাড়া করে মংলা যেতে হবে। মংলা থেকে সরাসরি সুন্দরবনের ট্রলার বা লঞ্চ পাওয়া যায়। সুন্দরবনের ভ্রমণের জন্য নৌপথই একমাত্র উপায়।
কক্সবাজারঃ কক্সবাজার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমুদ্র সৈকত। ভিবিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ প্রতি বছর এখানে ভ্রমণে আসে। ১২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সমুদ্র সৈকত আপনাকে অবশ্যই মুগ্ধ করবে। আপনি বছরের যে কোনো সময় এখানে ভ্রমণ করতে পারবেন, তবে সবাই শীতকালেই যেতে পছন্দ করে। কক্সবাজার যেতে চাইলে আপনি সরাসরি বাস, ট্রেন বা বিমানে করে যেতে পারবেন।
ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজারের অনেক গুলো এসি ও নন এসি বাস রয়েছে। এছাড়া কমলাপুর থেকে প্রতিদিন কয়েকটি ট্রেন ছেড়ে যায় কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। বাসে না গিয়ে ট্রেনে গেলে ভাড়া প্রায় অর্ধেক পরবে। সমুদ্র সৈকতের বালিতে হাটা বা সমুদ্রের পানিতে গোসল করার মত সুন্দর অভিজ্ঞতা পেতে সময় নিয়ে একদিন চলে যান কক্সবাজারে। সমুদ্র সৈকত ছাড়াও আরো যেসব স্থানে ঘুরতে পারেনঃ সেন্ট মার্টিন, মহেশখালী, রামু বৌদ্ধ বিহার ইত্যাদি।
সোনার গাঁঃ ঢাকার অদূরে নারায়নগঞ্জ জেলায় অবস্থিত প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁ। ঢাকার কাছাকাছি হওয়ায় আপনি চাইলে যে কোনো ছুটির দিনে এখানে চলে যেতে পারেন। যারা প্রাচীন ও ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন তাদের জন্য এটি উপযুক্ত স্থান। ঢাকা থেকে সোণারগায়ের লোকাল বাস রয়েছে।
বাসে করে আসলে আপনাকে মোগড়াপাড়ায় নামতে হবে, এখান থেকে রিক্সায় করে সোনারগাঁ যেতে ৫-১০ মিনিট লাগবে। আর পরিবার বা বন্ধুদের সাথে গেলে একটি প্রাইভেট কার বা মাইক্রো ভাড়া করলে ভালো হয়। সোনারগাঁতে প্রাচীন রাজাদের বাসস্থান, রাজবাড়ি, প্রাচীন সব স্থাপনা দেখে আপনি সত্যি মুগ্ধ হবেন। এছাড়াও এখানে সোনারগাঁ যাদুঘর, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন যাদুঘর, পানাম নগর, বাংলার তাজমহল সহ আরো অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে।
রাঙ্গামাটিঃ সাজেক ভ্যালি, ঝুলন্ত ব্রীজ, কাপ্তাই লেকের মত অনেক জনপ্রিয় জায়গার অবস্থান এই রাঙ্গামাটি তে। তাই প্রায় সারা বছর এখানে ট্যুরিস্টদের আনাগোনা লক্ষণীয়। বাঙ্গলাদেশের আয়তনে সবচেয়ে বড় এই রাঙ্গামাটিকে অনেকে রূপের রাণী বলে ডেকে থাকেন। প্রায় ১৪ টি উপজাতির বাসস্থান এই রাঙ্গামটিতে ঘুরে দেখার মত অনেক স্থান রয়েছে।
ঢাকা থেকে রাঙ্গামাটি গামী অনেক বাস রয়েছে। ট্রেনে যেতে চাইলে আগে চট্টগ্রাম নেমে সেখান থেকে রাঙ্গামাটির বাস পাবেন। আপনি চাইলে মাইক্রো ভাড়া করেও যেতে পারেন। রাঙ্গামাটি জেলার মুল আকর্ষন সাজেক ভ্যালি। এই ভ্যালিতে একবার গেলে এর রূপে মুগ্ধ হয়ে আপনার সারাজীবন সেখানেই থেকে যেতে ইচ্ছে করবে। এছাড়াও কাপ্তাই লেক, ঝুলন্ত ব্রীজ, শুভলং ঝর্ণা, রাজবন বিহার সহ অনেক সুন্দর সুনর লেক ও ঝর্ণার দেখা পাবেন এখানে।
শ্রীমঙ্গলঃ মৌলভিবাজারের শ্রীমঙ্গল মূলত এর হরেক রকমের পাহাড় ও চা বাগানের জন্য বিখ্যাত। চা বাগানের সারি সারি টিলা, আকাবাকা পাহারি পথ, সবুজ বনভুমি, হাওড়, বিল ইত্যাদির মনোরম সৈন্দর্যে আপনি হারিয়ে যাবেন। দেশী বিদেশী পর্যটকদের পদভারে এই অঞ্চলটি সারা বছর মুখরিত থাকে। এখানে যাওয়ার জন্য সরাসরি বাস বা ট্রেন পাবেন।
ঢাকা থেকে প্রায় সারাদিনই সিলেটের বাস ও ট্রেন ছেড়ে যায়। শ্রীমঙ্গল থেকে সিএনজি, অটোরিক্সা, বাস সহ অনেক গাড়ি পাবেন পর্যটন অঞ্চল্গুলো ঘুরে দেখার জন্য। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, হাম হাম ঝর্ণা, লাসুবন গিরিখাত সহ আরো অনেক দর্শনীয় স্তান ঘুরে আসতে পারেন। আর হ্যা, এখানে ভ্রমণে আসলে শ্রীমঙ্গলের বিখ্যাত সাতরঙ্গা চায়ের স্বাদ নিতে ভুলবেন না কিন্তু!
পাহারপুরঃ প্রাচীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উপাসনালয়ের কেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত ছিল বর্তমানের সোমপুর বিহার বা পাহারপুর বৌদ্ধ বিহারের প্রায় ধংসাবশেষ এই স্থানটি। নওগার বদলগাছী উপজেলায় অবস্থিত এই প্রাচীন স্থাপনাটিকে ১৯৮৫ সালে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে ঘোষনা করে ইউনেস্কো।
৯২২ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৯১৯ ফুট প্রস্থের এই স্থাপনাটী আপনাকে পিরামিডের কথা মনে করিয়ে দিবে। এখানে আসতে হলে আপনাকে বাসে করে নওগা জেলায় আসতে হবে। এখান থেকে পাহারপুরে আসার লোকাল বাস পাওয়া যায়। এই ধ্বংসাবশেষ ঘুরে দেখলে আপনি সত্যি বিস্মিত হবেন। বিহারের কেন্দ্রে রয়েছে একটি বিশাল মন্দির, চারিপাশে অনেকগুলো স্নানাগার ও শৌচাগার, সন্ধ্যাবতীর ঘাট, সত্যপীরের ভিটা সহ অনেক স্থান রয়েছে ঘুরে দেখার মত।
কুয়াকাটাঃ পটুয়াখালী জেলায় অবস্থিত কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮ কি.মি। এটি বাংলাদেশের একমাত্র স্থান যেখান থেকে একইসাথে সূর্যদয় ও সূর্যাস্ত উপভোগ করা যায়। সৈকতের এক পাশে বিশাল সমুদ্র আর অন্যপাশে সারি সারি নারিকেল গাছ আপনাকে আকৃষ্ট করবে। তাছারা বাইক ভাড়া করে সৈকতে চালানো, বা নৌকা ভাড়া করে কাছের চর গুলো ঘুরে আসতে পারবেন।
ঢাকা থেকে কুয়ায়াটা যাওয়ার জন্য সবচেয়ে ভাল মাধ্যম লঞ্চ। পটুয়াখালীর আমতলীর লঞ্চ পাবেন সদরঘাট থেকে। আমতলী থেকে কুয়াকাটার বাস রয়েছে। বাসে যেতে চাইলেও কুয়াকাটার বাসে করে সরাসরি যেতে পারবেন। কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকত ছাড়াও শুটকী পল্লী, কুয়াকাটার কুয়া, সীমা বৌদ্ধ মন্দির, ক্রাব আইল্যান্ড, ফাতরার বন সহ নানান আকর্ষনীয় স্থান রয়েছে।
উপরিউক্ত দর্শনীয় স্থানসমুহ আমাদের দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধারন করে। তাই বাঙ্গলাদেশের নাগরিক হিসেবে জীবনে একবার হলেও এই স্থানগুলো ঘুরে দেখা উচিৎ, নাহলে জীবনটাই বৃথা। আজ এ পর্যন্তই। সবাই ভালো থাকবেন।