সময়টা ১৯৭১.
মার্চের শেষ আর এপ্রিলের শুরু। সবেমাত্র বর্ষা আসতে শুরু করেছে। শ্রাবণের কালো মেঘ খেলা করবে আর কৈশোরের উচ্ছ্বাস মাতিয়ে রাখবে প্রকৃতি – কিন্তু দিনগুলো একাত্তরের ! বুলেটের বিষ আর বিষাদমাখা কালো মেঘের জট এসে ভর করেছে বাংলার গ্রামেগঞ্জে।
আমজাদপুর গ্রাম। লোকে লোকারণ্য, হাজারো পরিবারের স্বপ্নের নীড় এই গ্রামটি সেদিন ছিল অপ্রত্যাশিত শত্রুদের আতঙ্কে বিবর্ণ। করতোয়া নদীর তীরে এককালের সব মানুষের অভয়ারণ্য এই গ্রামের এরকমই এক দিন ছিল সেটি, মেঘের গর্জন আকাশে আর দমকা হাওয়া বইছিলো পাকবাহিনীর সাথে পাল্লা দিয়ে।
দিগ্বিজয়ী যুদ্ধের কামানের মতো অঝোর ধারায় সারাদিন বৃষ্টি ঝরছে। বৃষ্টির পানিতে ধুলায় ধূসরিত শক্ত মাটিও নরম হয়ে দিনদুয়ের মধ্যে নদী-নালা,খাল- বিল,রাস্তা-ঘাট ডুবে গেছে। অজানা আশঙ্কায় শিউরে ওঠে সেদিনও কবিরের মনে হয়েছিল, বিলুদের পুকুর পাড়ের প্রকান্ড কৃষ্ণচূড়া গাছটায় বিষাদময় লালেরা হয়তো মেতেছে সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে।
বিকেলবেলা একদৃষ্টিতে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে কবির ,দূর থেকে ভেসে আসা মানুষের অস্পষ্ট ক্ষীণ আকুল আর্তনাদ শুনে মনে হচ্ছিল তখনি বেরিয়ে যায় সে। কিন্তু সে মুহূর্তে তারা যে নিরূপায়…..
বিছানার সাথে গা এলিয়ে দিল কোনোমতে । সাতপাঁচ ভাবতে গেল বলে, এমনসময় পাশের বাড়ির বিলু দৌড়ে এসে তন্ময় হয়ে খবর দিল- ‘আজ সারাদিন তিনজন রাজাকারের সাথে গ্রামে মিলিটারিদের গাড়ী নিয়ে ঘুরতে দেখেছি।’
বুঝতে পারল কবির আর বসে থাকার সময় নেই। পরেশ ঠাকুরের ছোট নাতনীটাকে সেদিনই হারামির বাচ্চাগুলো গুলি করে মেরেছিল নদীর ধারে। সে কথা মনে হতেই হৃদয়ের রক্তক্ষরণ শুরু হয় সবার।
পরদিনই বাঁশবাগানের ভিতরে একটি অস্থায়ী ক্যাম্প গঠন করা হলো সবাই মিলে। গ্রামের এক হাজী সাহেব তাদেরকে তাঁর কাচারি ঘরে জায়গা দিয়েছিলেন। তারা মোট উনিশ জন এই ক্যাম্পে ছিলো। তন্মধ্যে গ্রামের মাওলানা বায়েজিদ আহমেদও ছিলেন।
মাওলানা বায়েজিদ, নজির বিহীন এক যোদ্ধা ছিলেন। খুবই মুত্তাকি ও পরহেজগার, তার আখলাক ছিল অমায়িক, সাহসও ছিল অদম্য।
অদম্য সত্ত্বার এই বায়েজিদকেই দলের আমীর হিসেবে বেছে নিলো সবাই । সেখানে তাদের ট্রেনিং দিচ্ছিলো বহরপুরের ময়না মাহমুদ ভাই।
বয়সে কবিরের চেয়ে দুই বছরের বড়। যাহোক
তারা সেখানে ট্রেনিং নিতো কখনো বাঁশবাগানে, আবার কখনো বা হাজী সাহেবের কাচারী ঘরে। তারা কয়েক মাস ট্রেনিং নিলো।
অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অতঃপর আসলো এক রোমহর্ষক দিন। যেদিন সেই উনিশ জনের দল সর্বপ্রথম মুখোমুখি যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে তীব্রভাবে আক্রমণ করেছিলো পাকিস্তানী ক্যাম্পে।
প্ল্যান মতো এশার নামাজের পর তারা সবাই যার যার অস্ত্র ঠিকঠাক করে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পের নিকট পজিশনমতো দাঁড়িয়ে গেলো। বায়েজিদ ভাই সবাইকে আয়াতুল কুরসী পড়ে ফুঁ দিলেন। এরপর যখন পাকসেনারা দৃষ্টিগোচর হলো , তার কিছুক্ষণের মধ্যে আমীর সাহেব ফায়ারের নির্দেশ দিলেন। অপ্রস্তুত সেনাদের ঘাঁটিতে বেঁধে গেল হুড়োহুড়ি । শত্রুর সংখ্যা বেশি থাকায় সুবিধা করতে পারছিলো না ঠিকমতো । কবির ছিলো আমীর সাহেবের পেছনে। হঠাৎ আমীর সাহেব ফায়ার করতে করতে মূলদল হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করলেন। আমি তাকে বাধা দিলাম। কারণ সামনেই ছিলো শত্রুবাহিনীর মূল কমান্ডো স্কোয়াডের প্রবেশমুখ । তিনি আমার কথায় কর্ণপাত করলেন না, সহযোদ্ধাদের কথা ভেবেই হয়তো এভাবে সামনে চলে গিয়েছিলেন। হঠাৎ তিনটি বুলেট এসে পরপর তার মাথায় আঘাত করল। সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন মাওলানা ।
গ্রামের মাহমুদ ভাই একহাতে তার মাথাটা উঁচু করে বুকের সাথে মিলিয়ে ধরে রাখলে, আর বাকি সবাই সাঁড়াশি আক্রমণ চালাতে লাগল। আজ হয় শত্রুরা মরবে, নাহয় তারা। জীবনের মায়া ভুলে গেছে সবাই সেই কবেই। আস্তে আস্তে শত্রু সংখ্যা কমছে। কেউবা নাজুক অবস্থায় মনোবল হারিয়ে পালিয়ে গেল । এক পর্যায়ে যুদ্ধ শেষ হলো তারা ক্যাম্প দখল করলো।
কিছুক্ষণ পরে মাওলানা বায়েজীদ আহমেদ শহীদ হলেন। তখন তার শরীর হতে এমন এক সুঘ্রাণ আসতে লাগলো, যা তাদের সবার নিকট অপরিচিত ছিল। শহীদী আত্মার সুঘ্রাণ! ফজরের নামাযের পর তার মাথা হতে বুলেট তিনটি বের করে সেখানেই তার অন্তিম ঠিকানা রচনা করা হয়।
.
আজ ষোলই ডিসেম্বর। অনেক সহযোদ্ধাদের হারানো কবিরকে পেয়ে বসেছে বার্ধক্য। জীবনের স্মরণীয় মুক্তিযুদ্ধের গল্প শেষ হওয়ার পর তার দিকে তাকিয়ে রইল তার দুই নাতি, তারা হতবাক! মাঘ মাসের হাড় কাঁপানো শীতের সকালে শিশিরকণা দূর্বাঘাসের মাথা বেয়ে যেমনি ভাবে ঝরে পড়ে, তদ্রূপ সেদিনের মাওলানা বায়েজিদ আহমেদ ও সেই সহযোদ্ধাদের জন্য তার এক দরদ অশ্রু হয়ে গন্ডদেশ ছড়িয়ে পড়ছে!