‘বিপদে বন্ধুর পরিচয় ‘
তীর্থ আর তমাল খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওরা একই কলেজের একই ক্লাসে পড়ে। ওদের দুজনের বাবাই অনেকদিন ধরে ঢাকায় চাকরি করেন। ফলে তমাল আর তীর্থও ছোটবেলা থেকেই ঢাকায় বড় হয়েছে। বেশ কয়েকবছর আগের কথা, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর তমাল ওর গ্রামের দাদা বাড়িতে কিছু দিনের জন্য বেড়াতে যেতে চাইল। সে তীর্থকেও সাথে নিতে চাইল। কিন্তু তীর্থ যখন ওর বাবা-মায়ের কাছে তমালের দাদা বাড়িতে যাওয়ার কথা বলল তখন তারা কোনমতে রাজি হচ্ছিলেন না। কারণ তীর্থ খুব কমই তার মা-বাবা ছাড়া থেকেছে। তবু হাল ছাড়লো না তমাল। সে একদিন সোজা তীর্থ দের বাড়ি গিয়ে হাজির। তীর্থর মাকে বলল,’ আন্টি তীর্থর কোন ক্ষতি হবে না -আমি আপনাকে কথা দিলাম। প্লিজ আন্টি, ওকে আমার সঙ্গে যেতে দিন।’ অবশেষে তমালের সাথে ওর দাদা বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি মিলল তীর্থর।
দুই বন্ধু গ্রামীণ পরিবেশ খুব উপভোগ করল। তমাল প্রতিবছরই গ্রামে আসে আগে আসতো ওর মা বাবার সাথে। এই প্রথম সে কোন বন্ধুকে নিয়ে এসেছে সে কারণে তার আনন্দটা এবার একটু বেশি। আর তীর্থ সেই কবে শেষবার গ্রামে গিয়েছিল সে কথা তার মনেই নেই। সে কারণে তার কাছে এক গ্রাম অন্য এক পৃথিবী।টেলিভিশনে সে যে গ্রাম দেখেছে বাস্তবের এই গ্রাম তার চেয়ে অনেক সুন্দর মনে হল তীর্থর কাছে। রাতে নদীর উপর চাঁদের জ্যোৎস্নায় দোলা আর ঝোপের ভেতর জোনাকি পোকার আলো দিনে বিস্তীর্ণ হলুদ সরষে ফুলের মাঠ, আম- জাম কাঁঠাল এর বন সবকিছু তাকে মুগ্ধ করছে, বিমোহিত করছে।
একদিন বিকেলে ওরা দুই বন্ধু নদীর কূলে বেড়াতে গেল। কুলের ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ এক নৌকা দেখে তমাল তীর্থকে বলল, ‘চল, আমরা নৌকায় ঘুরি।’ তীর্থ বলে, ‘না, না, আমি নৌকা উঠবো না। আমি সাঁতার জানি না। মা আমাকে পানির কাছে যেতে নিষেধ করে দিয়েছেন। কিন্তু তমাল নাছোড়বান্দা। সে বলে, ‘আরে কিচ্ছু হবে না। সাঁতার জানিস না তো কি হয়েছে, আমি তো জানি। তেমন কিছু হলে আমি তোকে টেনে তুলবো।’ তীর্থ তবুও ইতস্তত করতে থাকে। তমাল এবার খুব অভিমান করে বলে, ‘আমি না তোর বেস্ট ফ্রেন্ড! ঠিক আছে এই যে আমি প্রতিজ্ঞা করলাম তোকে বাঁচাতে আমি প্রাণ দেব।’ তীর্থ আবেগী হয়ে গেল। বলল, ‘ঠিক আছে বন্ধু, আমি তো আর সাঁতার জানিনা। তবুও তোর জীবন বাঁচাতে আমিও মরতে প্রস্তুত।’
মাঝি নৌকাতেই বসা ছিল। তমাল মাঝি কে বলল, তাদের দুই বন্ধুকে যেন মাঝি তার নৌকায় করে নদীতে ঘুরিয়া আনে। কিন্তু মাঝি রাজি হলো না। কারণ তার নৌকা টা ভালো নয়। এই নৌকা দিয়ে নদীতে গেলে যে কোন সময় বিপদ হতে পারে বলে জানায় মাঝি। তমালের বারবার অনুরোধে শেষপর্যন্ত মাঝি বেশ কিছু টাকার বিনিময়ে ওদের নদীতে ঘোরাতে রাজি হয়।
নৌকা কূল ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেল। তমাল দারুণ উচ্ছ্বসিত হলো। বিকেলের বাতাস নদীর জলে একাকার হয়ে যেন আদর করছে ওদের। তীর্থ প্রথমে সামান্য ভয় পেলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বাভাবিক হয়ে গেল। হঠাৎ নৌকার পাটাতনের একটা কাঠ ভেঙে গেল। নৌকায় পানি উঠতে শুরু করলো। তীর্থ আর তমাল ভয় পেয়ে গেল। মাঝি নৌকা কুলের দিকে নেওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করল কিন্তু যতটা না এগোচ্ছে তারচেয়ে পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে বেশি। তমাল পানিতে ঝাঁপ দিয়ে কুলের দিকে সাঁতরাতে শুরু করলো। তমালের দেখাদেখি তীর্থও পানিতে লাফ দিল কিন্তু সে সাঁতরাতে পারল না। সে তমালের নাম ধরে চিৎকার করে তার কাছে সাহায্য চাইতে লাগলো। তীর্থ প্রায় ডুবে যাচ্ছিল- ঠিক সেই সময় নৌকা থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়ে মাঝি। তীর্থকে কাঁধে নিয়ে সাঁতরে কুলে আসে। ধুক-ধুক বুকে নিরাপদ কূলের দিকে এগোতে এগোতে তীর্থ ভাবতে থাকে, কে তার প্রকৃত বন্ধু -তমাল না মাঝি!