- আপনাকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে হবে,মিস্টার প্রেসিডেন্ট!”
- “কেন?”
- “আপনার বাসভবন আক্রান্ত হয়েছে।শত্রুরা সংখ্যায় অনেক বেশী ।আমরা এখনও বিশজনের মতো বেঁচে রয়েছি বটে-কিন্তু বেশীক্ষণ আটকে রাখতে পারব না ওদেরকে!”
- “শুনে অত্যেন্ত খুশি হলাম!”
“মজা করছেন,স্যার?করুন,তাতে আমার কোন অসুবিধে নেই।কিন্তু আপনাকে বাঁচানোটা এখন আমার কতর্ব্য তাই যেটা বলছি…” কথা শেষ করতে পারলেন না মেজর।তার আগেই কাছে কোথাও প্রচন্ড বিস্ফোরণের শব্দ হলো একটা।আর কথা বাড়ালেন না বৃদ্ধ, কাঁপা কাঁপা পায়ে অনুসরণ করলেন মেজরকে।
********
মাটির হাত দশেক নিচের একটি অত্যাধুনিক, বিলাসবহুল বাঙ্কার।একনজর দেখলেই বোঝা যায় ভি আই পি কারোর জন্য বিশেষ তত্ত্বাবধানে তৈরি করা হয়েছে বাঙ্কারটি।আপাতত সেখানেই অবস্থান করছেন প্রেসিডেন্ট।রাতটা এখানেই কাটাতে হবে তাকে।সকাল হলে সেনাবাহিনীর হেড কোয়ার্টারে যোগাযোগ করে দমন করতে হবে এই বিদ্রোহ!যারা যারাই এই অভুত্থানের সাথে যুক্ত রয়েছে কঠিন শাস্তি দিতে হবে তাঁদের- সবাইকে একদম ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে ব্রাশ-ফায়ার করার নির্দেশ দিবেন তিনি!বিপ্লব করার সাধ চিরদনের জন্যে মিটিয়ে দিবেন শালাদের!
বেশ কয়েকটাই রুম রয়েছে বাঙ্কারটাই।সেই রুমগুলোরই সবচেয়ে বড় রুমটার একটা নরম কুশনে বসে আছেন প্রেসিডেন্ট।তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সশস্ত্র সৈনিকটার বয়স খুবই কম।মনে হয় নতুন জয়েন করেছে চাকরিতে!ছেলেটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন তিনি,
- “তোমাদের মেজরের খবর কি?আমাকে এখানে রেখে কোথায় হারিয়ে গেলেন তিনি?”
- “মেজর? ওনি তো মারা গেছেন,স্যার!”নিরুত্তাপ কন্ঠে জবাব দিল ছেলেটা।
- “ও আচ্ছা!” একদম চুপসে গেল প্রেসিডেন্টের চেহারা।দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ ভয় পেয়েছেন তিনি।নিজেকে সামলে নিয়ে ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করলেন আবার,
- “ওরা কারা সে সম্পর্কে কিছু জানো তুমি?কেন মারতে চাইছে আমাকে?”
“জানি,কিন্তু আপনাকে বলব না কারণ আপনিও খুব ভালো করেই জানেন ওরা কারা!”নিজের বডিগার্ডের এমন উদ্ধত উত্তর শুনে মুখ হা হয়ে গেল বৃদ্ধের! প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কেউ এমনভাবে কথা বলতে পারে!নিজের মনেই বিড়বিড় করে উঠলেন তিনি, ‘কাঁদায় পড়লে হাতি,খায় চামচিকার লাথি!’ বিভিন্ন নীতিবাক্য নিয়ে ছড়া রচনা করতে পারার প্রতিভাটা যে তাঁর মধ্যে আছে সেটা কিছুদিন আগেই প্রথম জানতে পেরেছেন তিনি।ইদানিং তাঁর মনে হয় প্রেসিডেন্ট না হয়ে যদি ছড়াকার হতেন তাহলেও নির্বিঘ্নেই কাটিয়ে দিতে পারতেন একটা গোটা মানবজনম!তাহলে অন্তত এভাবে দুর্বৃত্তের হাতে বেঘোরে প্রাণ হারানোর মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।
“এই যে ছেলে, তোমার কাছে কি সিগারেট হবে একটা?সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়েছে ভীষণ!এদিকে আমার প্যাকেটটা ভুলে উপরে রেখে এসেছি।এসবই হলো গিয়ে বয়স হওয়ার লক্ষণ!মেঘে মেঘে বেলা তো আর কম হলো না!”নিজের রসিকতায় নিজের হো হো করে হেসে উঠলেন প্রেসিডেন্ট।ছেলেটা কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না।পকেটের ভেতর হাত চালিয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে দিল শুধু।নিজের অভিব্যক্তি যথাসম্ভব গোপন করে জানতে চাইলেন তিনি,
- “বাইরে গিয়ে পরিস্থিতিটা দেখে আসতে পারবে একবার?”
- “সেটা তো উচিত হবে না, স্যার।মারা যাবার আগে বারবার মেজর বলে গেছেন আমাকে আপনাকে একা ফেলে যেন কোথাও না যায়।আর তাছাড়াও এতক্ষণে হয়তো পুরো বাড়িটা দখলে নিয়ে নিয়েছে ওরা,আমি যদি ওদের হাতে ধরা পড়ি আপনার অবস্থানও তাহলে প্রকাশ হয়ে পড়বে ওদের সামনে!”
- “হু বুঝলাম,বাড়িতে কে কে আছে তোমার?”
- “মা আর বছর দুয়েকের ছেলে আছে একটা।”
- “আই এম এ ডঙ্কি!”
- “এ্যা…কি বললেন,স্যার?”একটু আগে বুড়োর মুখ থেকে শোনা কথাটা যেন বিশ্বাস করতে পারে না আরাফ।অতিরিক্ত ভয়ে ব্যাটার মাথা খারাপ হয়ে গেল না কি?
- “আরে পাগল, এটা একটা কোড।এই বাঙ্কার থেকে বেরনোর সিক্রেট কোড।”
- “না মানে…স্যার,এই কোড নিয়ে আমি কি করব?”
- “কি করবে মানে?বেরিয়ে যাবে এখান থেকে! আমর মতো একটা বছর পঞ্চাশের বুড়োর জন্য কি তোমার দু বছরের ছেলের জীবন নষ্ট করবে নাকি তুমি?”
“কিন্তু স্যার আপনি?”
“আরে ভাই আমার কথা চিন্তা করতে হবে না তোমাকে।জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে গেছে আমার। এই এক জীবনে এতবার পাবলিকের পকেট মেরেছি যে…”মাঝপথে কথা থামিয়ে দিয়ে কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করেন প্রেসিডেন্ট।তারপর আরাফকে তাগাদা দেন আবার,
“আমার ব্যাকগ্রাউন্ড জেনে লাভ নেই তোমার,যাও…তাড়াতাড়ি যাও এখান থেকে।” একটু দ্বিধাণ্বিত দেখালো আরাফকে। তাঁর এখন কি করা উচিত?প্রেসিডেন্টের বডির্গাড সে।প্রেসিডেন্টকে রক্ষা করা তাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।কিন্তু একজন বাবা হিসেবে সন্তানকে নিরাপদ ভবিষৎ দেওয়টাও একপ্রকার অনির্বায দায়িত্ব,তাই না?
কিছুক্ষণ প্রেসিডেন্টের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে এক্সিট ডোরের দিকে পা বাড়ালো আরাফ।
**********
আধ ঘন্টা পর…
পুরো ব্যাঙ্কারময় পায়চারী করছেন প্রেসিডেন্ট।সকালের আগে তাঁর হাতে করার মতো কোন কাজ নেই! শুধু অপেক্ষা করা ছাড়া।মধ্যরাতের ভূতুড়ে নি:স্তব্ধতা আগাগোড়া জড়িয়ে ধরছে তাকে।ফ্রিজ থেকে একটা সোডার বোতল বের করে তাতে চুমুক দিলেন তিনি।তখনই খেয়াল করলেন শব্দটা।বুট জুতোর আওয়াজ?এই ব্যাঙ্কারের অবস্থান তাহলে কি…
আর ভাবতে পারলেন না বৃদ্ধ।তাঁর সমস্ত চিন্তা ভাবনা জট পাঁকিয়ে গেল।
“কেমন আছেন মিস্টার প্রেসিডেন্ট?অবশ্য কিছুক্ষণ পর আর প্রেসিডেন্ট থাকবেন না আপনি!” একটা সুরেলা কন্ঠস্বর ভেসে এলো দরজার ওপাশ থেকে।
“দেখুন জেনারেল এফেন্দি, এখনও সময় আছে, বন্ধ করুন এসব।আমি কথা দিচ্ছি, কোট মার্শাল এর মুখোমুখি হতে হবে না আপনাকে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে সুপারিশ করব- আপনাকে স্বপদে বহাল রাখার জন্য!”
“তাই নাকি?শুনে অত্যেন্ত প্রীত হলাম,স্যার। কিন্তু অত্যেন্ত দু:খের সাথে জানাচ্ছি আপাতত আপনার দয়ার কোন প্রয়োজন দেখছি না আমি।বাই দ্য ওয়ে, এই বাঙ্কারটার লোকেশন কিভাবে ট্র্যাক করলাম জিজ্ঞেস করলেন নাতো?” একটু থেমে দরজার দিকে মুখ করে বলে উঠলেন, “আরাফ,মাই বয়,এদিকে এসো একটু।”জেনারেল এফেন্দির কথা শুনে রুমটার ভেতরে ঢুকল আরাফ।তাঁর পেছনে আরো দুজন উর্দিধারী।
“দেখলেন তো স্যার-আপনাকে কেউ পছন্দ করে না। এমন কি আপনার বডির্গাডও না…”
“এই ছেলে,তুমি থামো তো! দু কিলোমিটার দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে তোমরা আরাফের কোমরে পিস্তল তাক করে আছো।চুলগুলো আমার বাতাসে পাকে নি,বয়সেই পেকেছে,বুঝেছ?কারা বিশ্বাসঘাতক আর কারা বিশ্বাসী সেটা আমি চোখ দেখেই বুঝতে পারি।”
“আপনার এসব জ্ঞান বাক্য জান্নাতে গিয়ে সেখানকার অধিবাসীদের শোনাবেন,ঠিক আছে?জীবনে এতো পাপ করেছেন এরপরেও জান্নাতে যাবেন কি না তা নিয়ে আমার প্রচন্ড ডাউট আছে অবশ্য।সে যাক গে,শুভ কাজে আর দেরী করে লাভ কি?কাজটা করে ফেলা যাক না হয়?কি বলো তোমরা?”কৌতুকি কন্ঠে কথাটা বলে আরাফের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন সৈনিকের দিকে তাকিয়ে কি যেন ইঙ্গিত করল এফেন্দি।সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রমানবের মতো পিস্তল দুটোর একটা প্রেসিডেন্টের দিকে আরেকটা আরাফের দিকে তাক করল ওরা।সেফটি ক্যাচ খোলায় আছে এখন শুধু ট্রিগার টেপার অপেক্ষা…
থুতু ফেলার মতো শব্দ হলো হঠাৎ।পরপর তিনটে।ধপ করে একটা শব্দ করে বাঙ্কারের ফ্লোরে পড়ে গেল এফেন্দি আর তাঁর দুই সঙ্গীর মৃতদেহ।দরজার ওপাশ থেকে ভেসে এলো আরেকটা কন্ঠস্বর,
“আর ভয় নেই প্রেসিডেন্ট আমি চলে এসেছি।”কন্ঠস্বরটা চিনতে পেরেছে ওরা দুজনেই।চমকে দরজার দিকে ফিরে তাকাল আরাফ।প্রশ্ন করল,
“মেজর আপনি?আপনি তো…”
“না আরাফ মরিনি।মরার অভিনয় করেছি শুধু।এছাড়া শয়তানটাকে শায়েস্তা করার আর কোন রাস্তা ছিল না আমার হাতে।হেড কোয়ার্টারে খবর দেওয়া হয়ে গেছে,সেনা সাহায্য এসে পৌঁছাল বলে।বাই দ্য ওয়ে আপনারা ঠিক আছেন তো?”
“হ্যা আমরা দুজনেই ঠিক আছি…”
“তবে বেশীক্ষণ ঠিক থাকবি না বুড়ো!”আমূল বদলে গেল মেজরের কন্ঠ ।থুতু ফেলার মতো শব্দ হলো আবার।পরপর দুটো।
*********
পরের দিন সকাল।
একটা ভগ্নপ্রায় বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসছে একটা যান্ত্রিক শব্দ।রেডিও শুনছে কেউ।সেখানে কান্না জড়িত কন্ঠে বিবৃতি দিচ্ছেন একজন,
“প্রিয় দেশবাসী,আমি মেজর আব্রাহাম ডি কস্টা।অত্যেন্ত দু:খের সাথে জানাচ্ছি কালরাতে আমাদের প্রেসিডেন্টকে হত্যা করা হয়েছে।অনেক চেষ্টা করেও আমি…”মাঝপথে থেমে কান্নায় ভেঙে পড়ল কন্ঠস্বরটা।তারপর আবার বলল, “তবে হ্যা, একটা আততায়ীকেও ছাড়িনি আমরা।সব কটাকে কুত্তার মতো গুলি করে মেরেছি।দেশে যেন কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয় সে জন্য এই মূর্হুত থেকে সেনা শাসন জারি করা হলো।প্রিয় দেশবাসিকে আশ্বস্ত করতে চাই কয়েকদিন ধৈর্য্য ধারণ করুন ।খুব দ্রুতই এদিকটা গুছিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে আমার সরকার।ব্যস এই কয়েকটা দিন সবুর করার আহ্বান জানাচ্ছি আপনাদের।আমাদের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জান্নাতবাসী হোক!”
——————