অফিসের একঘেয়ে কাজ , সারাদিন টেনশন , গভীর রাতে বাড়ি ফিরে ডিনার সেরে টিভি সেটের সামনে বসে বিদেশ এর কালচার আর খাওয়া দাওয়া দেখছিলাম। স্কাই ডাইভিং দেখাচ্ছিল। নিউজিল্যান্ড এর ঠান্ডার সাথে গরম হৈচৈ দেখতে দেখতে আফসোস , ইশ যদি কুয়াশার মেঘগুলো ছুয়ে দেখতে পারতাম। পরদিন অফিস যেয়ে শুনতে পেলাম সামনে একটি ছুটির সাথে ফাও ছুটি দিচ্ছে অফিস। কিছু মেইন্টেনেন্স এর কাজ হবে অফিসে। মেঘ না চাইতেই জল। কলিগদের সাথে আলোচনা ব্যাস রাজি হয়ে গেল। গত রাতের আফসোস শেয়ার করলাম, একজন বলল, তবে তাই হোক মেঘ ছুয়ে দেখব তাও বাংলাদেশে। ঠিক ধরেছেন সাজেক ভ্যালি।
ছুটির পরদিন সকালবেলা একত্র হয়ে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে লেগে পরলাম। বুধবার রাত ১০:৩০ বেজে গেছে আমরা ধানমন্ডি কলাবাগান স্ট্যান্ড এ উপস্থিত হলাম। আমরা ছিলাম ৮ জন এর গ্রুপ। গাড়ি ছাড়ল রাত ১১:১০ মিঃ এ। যেহেতু শীতের রাত সবাই একটু গুটি সুটি মেরে ছিলাম, আসলে ভেতরে ভেতরে সবাই আগামি দিনের প্লানিং নিয়ে ব্যাস্ত ছিলাম সেই সাথে কানে হ্যবিট এর এইচ ৬১০ ব্লু টুথ হেড ফোন , যা আমার অনেক পছন্দের। গুনগুন করে পাহাড়ি গান কালেকশন চলছে।
হটাৎ গাড়ির ব্রেক। সুপারভাইজার বিরতির বিষয়ে অবগত করল। সবাই নেমে হালকা নাস্তা সাথে গরম গরম কফি। বিরতি শেষে গাড়ি ছাড়ল, নিজের অজান্তে চোখ দুটো যেন বন্ধ হয়ে গেছে। চোঁখ খুলতেই দেখি সবুজ গাছ ঘেরা পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে গাড়ি এগিযে চলেছে। সুর্য চোখ লাল করে চেয়ে আছে, মনে হচ্ছে সেও ঘুম থেকে জেগে উঠছে। কখনও এমন আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পথে চলার অভিজ্ঞতা ছিলনা তাই একটু ভয় লাগছিল। শুনেছি পাহাড়ি পথে গাড়ি খুব বিপদজনক। সব কিছুর উপরে ভ্রমন এর আনন্দের কাছে ভয় কে জয় করে ফেল্লাম।
গাড়ি সকাল ৭ টা নাগাদ আমাদের খাগড়াছড়ি নামিয়ে দিল। আমরা সবাই ফ্রেশ হলাম, হাতের কাছে নাস্তা করার মত ব্যবস্থা রয়েছে দেখে সবাই হালকা নাস্তা সেরে নিলাম। এর ভেতর একজন জানাল গাড়ির ব্যবস্থা হয়েছে (৮০০০ টাকা ভাড়ার বিনিময়ে) তবে ছাড়বে সকাল ৯.০০ টাতে। জানতে পারলাম এই গাড়িগুলো শুধু মাত্র ২ সময়ে এখান থেকে ছাড়ে। সকাল ৯.০০ টা এবং দুপুর ৩.০০ টা। এর কারণ এই পাহাড়ি পথে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। সে জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি এই দুই সময় পাহাড়া দিয়ে গন্তব্য পৌছে দিতে সাহায্যে প্রদান করে থাকে। এটা শোনার পর একটা ভালো লাগা কাজ করল। দেশেও বিদেশের মত জনগনের জান মাল এর নিরাপত্তা নিয়ে সরকারি ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য। ধন্যবাদ এবং সন্মান সেই দুর্বার সেনানীদের জন্য।
গাড়িটি এটি জিপ গাড়ি পেছন দিকে খোলা শুধু লোহার খাঁচার মত আছে উপরে। ১০/১২ জন প্যাসেন্জার হলেই সে রওয়ানা হয়ে যায়। নাম চাঁদের গাড়ি। নামের কারণ জানি না, তবে মনে হল, রাত্রে এই গাড়িতে বসলে চাঁদের আলো বিনা বাধায় সারা দেহে মেখে নেওয়া যায় , বিধায় এমন নাম হয়েছে।
আমাদের সামনে সময়ের অতন্দ্র প্রহরীদের জীপ টি চলেছে আর পেছনে আমরা চাদের গাড়িতে। রাস্তা বড় বিপদ সংকুল বিধায় জোড়ে চালানো দ্বায়। আঁকাবাকা পথ পেড়িয়ে কিছুক্ষণ চলার পর বিরতি দেয়া হল। এটাই চাইছিল মন, অনেক্ষন আতঙ্কে ছিলাম ভ’মিতে পা রেখে সস্তি ফিরে¡ পেলাম। সবাই এক এক জায়গায় জর হয়ে কি যেন পান করছে। আমিও উপস্থিত হলাম , খাব। বাশেঁর চোঙাতে চা। নতুন কিছু আবিস্কারের আনন্দই আলাদা। বাঁশ চা শেষ করে আবার রওয়ানা হয়ে প্রায় ২.৩০ ঘন্টা পর আমরা সাজেক ভ্যালিতে পৌছালাম। হোটেল আগেই বুকিং দেয়া ছিল। সাজেকে পানির কিছুটা সমস্যা ছিল। দ্রুত সবাই ঠান্ডা পানিতে গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। হালকা রেস্ট নিয়ে দুপুরে লাঞ্চ এর জন্য বের হলাম। দুপুরের খাবারের মেনু ছিল কয়েক রকমের ভর্তা (কলার মোচা, শুটকি, বুনো কচু ইত্যাদি), ব্যামবো চিকেন (বন মোরগ কে বড় বাশের ভেতর রান্না করা হয়, কোন প্রকার পাতিল ব্যবহার করা হয় না), ব্যামবো চিকেন এর স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।
নামঃ কংলাগ পাহাড় , উচ্চতাঃ ৩০০০ (তিন হাজার ফিট)। সবাই মিলে বিপুল উৎসাহে লেগে গেলাম পাহাড় জয় করতে (আমরা করব জয় নিশ্চয়)। ৪০-৪২ মিনিটের নাকনি চুবানি শেষে পাহাড়ের চুড়ায় অবতরণ করলাম। পাহাড়ের উপরে সমতলে কিছু সময় পার করার পর সকল কষ্ট পানি হয়ে গেল। অন্য রকম এক ভালোলাগা, দেশের সৌন্দর্য্য দেখে নিজেকে ধ্বিক্কার দিতে লাগলাম। এই দেশে এত সৌন্দর্য্য যা কিনা আমি এতদিনে জানতে পারলাম। অপার্থিব এক অনুভুতি। মনটা শান্ত , নির্মল করে দিয়েছে প্রকৃতি। সূর্য ডোবার সময় হয়ে গেল। সে আর এক মোহনীয় মুহুর্ত, যা এই চামড়ার চোখে হাই রেজ্যুলেশন ক্যামেরার ছবির মত মনের পাতায় অক্ষয় হয়ে অঙ্কিত হয়ে রইল।