“”” আসসালামু আলাইকুম “””
সবাই কেমন আছেন??
আশা করি সকলে ভালো আছেন।
আমি এতদিন আপনাদের অনেক টিপস দিয়েছি। কিন্তু আজ আমি আপনাদের সাথে অন্য একটি জিনিস শেয়ার করবো। সেটি নিজেকে নিয়েই। আজ আমি আপনাদের সাথে কিছু কথা শেয়ার করবো। যা আমার খুশি ও দুঃখ দুটিই প্রকাশ করে।
আশা করি সবাই আমার পুরো ঘটনাটি পড়বেন। এতে আপনাদের অনেক লাভ হবে। অন্তত জানতে ও বুঝতে পারবেন যে কষ্ট কি জিনিস আর কষ্টের ফল সবসময়ই মধুর হয়।
আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের জন্য কতো কাজ করছে। প্রতি বছরই সেনাবাহিনীতে ২ বার করে সেনাবাহিনীর অফিসার পদে ভর্তির সার্কুলার দেওয়া হয়। আমি 82 BMA Long Course এর একজন ক্যন্ডিডেট ছিলাম এবং সৌভাগ্যক্রমে আমি আমার দীর্ঘ সাধনার ফল পেয়েছি। আমার ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিলো যে সেনাবাহিনীর একজন অফিসার হবো।
প্রিলিমিনারী ভাইবা ও রিটেন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আইএসএসবি পরীক্ষায় যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। যেখানে 50,000 পরীক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ১০০০ জনের মতো পরীক্ষার্থী সুযোগ পায়। আাবার এই ১০০০ জন থেকে মোট ১৫০-৩০০ জন ই ট্রেনিং এর জন্য চূড়ান্ত মনোনিত হয়।
তো আমি গ্রীন কার্ড পেয়ে এত খুশি হয়েছিলাম যে বলার মতো না।
কিন্তু সবাই খুশি বিসর্জন দিতে হলো ট্রেনিং দেখে।
বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি। স্বপ্ন পূরন আর স্বপ্ন ভাংগার প্রথম ধাপ। একদিন এক দুপুরে চট্রগ্রাম রেলস্টেশনে অপেক্ষা করে আছি বাসের জন্যে। স্টাফ সবার নাম নোট করে বাসে উঠালেন। আম্মুর চোখটা ছলছল করছিল, দূর থেকে বুঝতে পারছিলাম। আর আব্বু, বরাবরের মত তাকিয়ে আছেন।
বাসটা ছেড়ে দিল। বাসে আমার মতই আঠারো উনিশ বছরের অনেকগুলো ছেলেপেলে। হৈচৈ করছে।
পাশে সুন্দর পাহাড়ের সারি। আমি এর আগে কখনো চিটাগাং আসি নি। সুন্দরই লাগছিল। অজানা রোমান্সে শরীর শিরশির করে উঠছিল। বাসের সামনে একজন স্টাফ দাঁড়িয়ে আছেন। উনি বলে উঠলেন, আর কিছুক্ষনের মধ্যে আমরা মিলিটারি একাডেমীতে প্রবেশ করবো। কে জানি প্রশ্ন করে বসলো স্টাফকে, স্টাফ আমরা ওখানে যাওয়ার পরে আমাদের কাজ কি হবে। স্টাফ বলেছিলেন, যাবেন, দেখবেন, আনন্দ করবেন। তখন কথাগুলোর মানে বুঝিনি। অনেক দিন সময় লেগেছে বুঝতে।
মিলিটারি একাডেমীর মেইন গেইটে আমাদের বাস থামলো। বাস থেকে নামলাম। সবাই দাঁড়িয়ে আছি। কারো বাবা মা চলে এসেছে। তারা মোটামুটি বিদায় নিয়ে যাওয়ার পর আমরা কয়েকজন ক্যাডেট বিসমিল্লাহ বলে গেইট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। আমার গল্প সেখান থেকেই শুরু।
ঢুকামাত্র দেখলাম, কয়েকজন খাকি ড্রেস পরা সিনিওর ক্যাডেট দাঁড়িয়ে আছেন। প্রথমেই আমাদের সিরিয়াল দিয়ে লাইনে দাড়া করালেন। উনারা আমাদের বিএমএ সিনিওর ক্যাডেট। ( এসব তথ্য সেদিন বুঝিনি, আরো পরে বুঝেছি)।
আমি হা করে তাকিয়ে দেখছি, হটাত এক সিনিওর এসে আমাকে মারলেন ঝাড়ি। বললেন, লুক ডাউন। গল্পের খাতিরে স্যারের নাম বললাম না। আমি তো মহা অবাক। আমার জানামতে কয়েক জেনারেশনের মধ্যে আর্মি অফিসার নেই বিধায় আর্মির নিয়ম কানুন কিছুই জানতাম না। প্রথমেই যখন লুক ডাউন বললেন, আমার গেল মেজাজ খারাপ হয়ে। তাও ঝাড়ি খেয়ে মাথা নিচু করলাম। সেই আমার আউলা হওয়ার শুরু। কিছুক্ষনের মধ্যেই আবিষ্কার করলাম, আমার মাথার উপরে আমার ইয়া বড় লাগেজ, আর তার নিচে আমি ছোট্ট একটা মানুষ। স্যার আমাদের সামনে গিয়ে বললেন, ফলো মি। আমরা গোটা কয়েক ক্যাডেট সেই লাগেজ মাথায় নিয়ে ঠেলা গুতায় যেয়ে পোঁছালাম বেলমেন হ্যাংগারে। সে এক আজব জায়গা। আমার আগে যারা পোছাইছে, তারা হুড়মুড় করে দৌড়াদৌড়িসহ বিভিন্ন এক্সারসাইজ করছে। আর লাইনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন ফর্ম পূরন করছে। আমি বুঝলাম, আমি এসেছে, আমি জায়গামত এসেছি। প্রথমেই সিনিওর ক্যাডেট আমাদের গ্রুপকে কাদাওয়ালা এক জায়গায় নিয়ে দাড়া করালেন। বললেন, পুশ আপ( বুক ডন) দিতে। আমি ভাবলাম, সবার থেকে ভালোমত দি। জানপ্রান দিয়ে পুশ আপ দেয়া শুরু করলাম এবং কিছুক্ষনের মধ্যে আবিষ্কার করলাম, এই হাত দিয়ে আমার পক্ষ্যে একটি টিস্যু পেপার ধরাও সম্ভব নয়। কে শুনে কার কথা। হাজামত চলতেই থাকলো।সন্ধ্যা তখন আটটা নটা বাজে। সময় থমকে দাঁড়িয়েছে তখন। এর মাঝে আমাদের বিভিন্ন ফর্ম ফিল আপ করার কাজ ও শেষ। আবার সেই সিনিয়র এসে আজরাইলের মত সামনে হাজির। এসে আবার বললেন, ওকে টেক ইয়োর লাগেজ এন্ড ফলো মি। আমি সুন্দর মত লাগেজ টেনে রওনা দিলাম এবং পুনরায় ঝাড়ি সমেত পানিশমেন্ট খেলাম এবং কিছুক্ষনের মধ্যে আবিষ্কার করলাম, লাগেজ আমার মাথায়, আমি লাগেজের নিচে। কিছুদূর হেটে যাবার পরে লাগেজ রাস্তার উপরে এবং আমি তাহার পাশে আশ্রয় গ্রহন করলাম। সিনিওর স্যার আরো কয়েকবার আমাকে দিয়ে লাগেজ টানানোর চেষ্টা করে উপলব্ধি করলেন, ছাগল দিয়ে হালচাষ সম্ভব না। অতঃপর আমি লাগেজ টেনে নিয়ে যাবার অনুমতি পেলাম। শেষমেশ অনেক কষ্ট করে রুমে পোঁছালাম। বলা হয় নি, আমার কোম্পানি সিলেক্ট হয়েছে। আমি বীরশ্রেষ্ঠ হামিদ কোম্পানীর ক্যাডেট। কিছু না বুঝেই অনেক আনন্দিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে নামটা চেনা। পরে জেনেছিলাম, হামিদ কোম্পানি বিএমএতে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল এর কুখ্যাত ড্রেনটির কারনে। বলা বাহুল্য মিলিটারি একাডেমীর বহু রাত কাটিয়েছি এই ড্রেনে সময় পার করে।
গল্পে ফিরে আসি।
রুমে পৌছানোর আগেই কোম্পানি লাইনের নিচে সিনিওর কর্তৃক লাগেজ চেক হলো। যা খাবার এবং টাকা নিয়ে এসেছিলাম, সব জমা দিয়ে এলাম। রুমে ঢুকে লাগেজ রেখে আবার ফলিন।ডিনার খাওয়ানোর জন্যে ক্যাডেট কর্পোরাল স্যার ডাইনিং হলে নিয়ে গেলেন। বিভিন্ন ছোটখাটো প্রশিক্ষণ শেষে যখন ডাইনিং এ ঢুকলাম, খাবার টেবিলের উপর দেখে মনে হলো, আজ খাবারে এক দিন তো আমার একদিন। সিনিওর স্যার আমাদের প্রথমে কিভাবে ডাইনিং এ ঢুকতে হয় তা শিখালেন। পর্যায়ক্রমে ডাইনিং এ চেয়ারে বসার নিয়ম ও চামুচ ধরা সহ খাবার প্লেটে নেয়ার পদ্ধতিও শিখলাম এবং প্লেটভর্তি খাবারো নিলাম। এরপরে যখন সিনিওর খাওয়ার জন্যে অনুমতি দিলেন এবং খাবারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম তারপরবর্তী মূহুর্তেই আদেশ হলো, খাবার না খেয়ে উঠে পড়ার জন্যে। সেদিন ব্যাপারটাকে অমানুষিক মনে হলেও আজ বুঝি, সেদিনের সেই ছোট ছোট ট্রেনিংগুলো আজ কত উপকারে আসে।
এরপরে গেলাম চুল কাটাতে। বিভিন্ন ছোটখাটো এক্সারসাইজ এর ফাঁকে ফাঁকে চুলও কাটা হয়ে গেলো। তাকিয়ে দেখলাম মাথার মাঝে অল্প দুচারটা চুল বাদে বাকি পুরোটুকি ন্যাড়া।
সেদিন রাতে রুমে ফিরলাম রাত ৩.৩০ এ। পরবর্তী ফলিন সময় ছিল রাত ৪.১৫। রুমে ঢুকেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। কি হলো কিছুই খেয়াল নেই, হটাত আবিষ্কার করলাম আমি শূন্যে ভেসে আছি। আমার কর্পোরাল আমার প্যান্টটা ধরে শূন্যে ঝুলে রেখেছেন আর আমি হাত পা ছুড়ছি। স্যার ছেড়ে দিলেন আর আমি ভূমিসাৎ। উঠে তড়িঘড়ি করে রেডি হলাম। পরবর্তী দিনের কার্যক্রম শুরু। তখনো আমার কোর্সের প্লাটুনমেট দের সাথে পরিচয় হয় নি। পরিচিতদের গল্প আর একদিন শুনাবো। পরের দিন বিভিন্ন কাজ আর ট্রেনিং করতে করতে পার হয়ে গেলো। রাতের বেলায় এলো সেই ভয়াল রাত। এটা বিএমএতে তখন ট্রেডিশন ছিল। ক্যাডেট প্রথম এন্ট্রির পরে সারারাত পিটিগ্রাউন্ডে এক্সারসাইজ করে। সূর্য উঠার পর সিনিওররা জুনিওরদের মিষ্টি খাওয়ায়। এর নাম, সানরাইজ ফলিন। সে এক অদ্ভুত সম্পর্কের শুরু।
সেই রাতে কি যে হয়েছিল, তা মুখে গল্প বলে বুঝানো সম্ভব না, শুধু নিজের শরীরের উপর গেলে বুঝানো যায়।
তাও ছোট্ট একটা ঘটনা বলি। সেই রাতে হটাত একজন ইমিডিয়েট সিনিয়র এসে পাশে দাঁড়িয়ে একটা কথা বলেছিলেন। “কষ্ট হচ্ছে? চোখটা বন্ধ করো, একদিন সুন্দর সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবে একাডেমীর ট্রেনিং শেষ হয়ে গেছে”।
সেদিন সারা রাত কঠিন প্রশিক্ষন শেষে ভোরে যখন আমার কাদামাখা হাতে সিনিওর মিষ্টি তুলে দিচ্ছিলেন, তখন সত্যি ভেবেছিলাম, রাত তো পার হয়েই গেলো, চলো দেখি, সামনে কি আছে।
একদিন সকালে সত্যি আবিষ্কার করেছিলাম দু বছর শেষ। সে এক অদ্ভুত সময়। অদ্ভুত সেই সব স্মৃতি। যেদিন ট্রেনিং শেষ হয়, সেদিন আসলেই অবাক হয়ে টের পেয়েছিলাম, আমার চোখ টলটল করছে। আনন্দে নাকি কষ্টের তা কখনোই বলে বুঝানো সম্ভব না। শুধু জানি, স্মৃতি কখনো হারায় না, যতই দিন যায় না কেন,মনের কোনে ঠিকি জমা হয়ে থাকে একদিন মনে করিয়ে দেয়ার জন্যে যে স্মৃতি আছে। সেই স্মৃতিগুলো এক সময় ভালোবাসায় ভালোলাগায় পরিণত হয়ে যায়…… মানুষ বড়ই অদ্ভুত… কষ্টকেও এক সময় ভালোলাগায় পরিবর্তন করে ফেলে……
তো এই ছিলো আমার সাথে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা। আমি অন্য একদিন আরো কিছু ঘটনা আপনাদের সাথে শেয়ার করবো।
একটা কথা মনে রাখবেন। কষ্টের ফল সবসময় মিষ্টিই হয়। কোনো কিছু অর্জন করতে হলে কষ্ট আর সাধনার কোনো বিকল্প নেই। যা আমাকে আমার লক্ষ্যে পৌছে দিয়েছে।
ধন্যবাদ।