বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)
[৫৭০-৬৩২ খ্রিঃ
যে মহামানবের সৃষ্টি না হলে এ ভূ-পৃষ্ঠের কোন কিছুই সৃষ্টি হতাে না, যার পদচারণায়
পৃথিবী ধন্য হয়েছে; আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভালবাসা, অন্তরের পবিত্রতা, আত্মার
মহত্ত্ব, ধৈৰ্য্য, ক্ষমা, সততা, নম্রতা, বদান্যতা, মিত্যাচার, আমানতদারী, সুরুচিপূর্ণ মনােভাব,
ন্যায়পরায়ণতা, উদারতা ও কঠোর কর্তব্যনিষ্ঠা ছিল যার চরিত্রের ভূষণ; যিনি ছিলেন
একাধারে ইয়াতীম হিসাবে সবার স্নেহের পাত্র, স্বামী হিসেবে প্রেমময়, পিতা হিসেবে স্নেহের
আধার, সঙ্গী হিসেবে বিশ্বস্ত; যিনি ছিলেন সফল ব্যবসায়ী, দূরদর্শী সংস্কারক, ন্যায় বিচারক,
মহৎ রাজনীতিবিদ এবং সফল রাষ্ট্র নায়ক; তিনি হলেন সর্বকালের সর্বযুগের এবং সর্বশ্রেষ্ঠ
মহামানব বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। তিনি এমন এক সময় পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত
হয়েছিলেন যখন আরবের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা অধঃপতনের চরম সীমায় নেমে গিয়েছিল।
৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট মােতাবেক ১২ রবিউল আউয়াল রােজ সােমবার প্রত্যুষে
আরবের মক্কা নগরীতে সান্ত কুরাইশ বংশে মাতা আমেনার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
জন্মের ৫ মাস পূর্বে পিতা আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। আরবের তৎকালীন অভিজাত
পরিবারের প্রথানুযায়ী তাঁর লালন-পালন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অর্পিত হয় বনী সা’দ
গােত্রের বিবি হালিমার উপর। এ সময় বিবি হালিমার আরেক পুত্র সন্তান ছিল, যার দুধ পানের
মুদ্দত তখনাে শেষ হয়নি। বিবি হালিমা বর্ণনা করেন, “শিশু মুহাম্মদ কেবলমাত্র আমার ডান
স্তরের দুধ পান করত । আমি তাকে আমার বাম স্তনের দুধ দান করতে চাইলেও, তিনি কখনাে
বাম স্তন হতে দুধ পান করতেন না। আমার বাম স্তনের দুধ তিনি তাঁর অপর দুধ ভাইয়ের
জন্যে রেখে দিতেন । দুধ পানের শেষ দিবস পর্যন্ত তাঁর এ নিয়ম বিদ্যমান ছিল। ইনসাফ
ও সাম্যের মহান আদর্শ তিনি শিশুকালেই দেখিয়েছেন। মাত্র ৫ বছর তিনি ধাত্রী মা হালিমার
তত্ত্বাবধানে ছিলেন। এরপর ফিরে আসেন মাতা আমেনার গৃহে। ৬ বছর বয়সে তিনি মাতা
আমেনার সাথে পিতার কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদীনা যান এবং মদীনা হতে
প্রত্যাবর্তনকালে আবহাওয়া” নামক স্থানে মাতা আমেনা ইন্তেকাল করেন। এরপর ইয়াতীম।
মুহাম্মদ (সাঃ) এর লালন-পালনের দায়িত্ব অর্পিত হয় ক্রমান্বয়ে দাদা আবদুল মােত্তালিব ও
চাচা আবু তালিবের উপর। পৃথিবীর সর্ব শ্রেষ্ঠ যে মহামানৰ আবির্ভূত হয়েছেন সারা জাহানের
রহমত হিসেবে তিনি হলেন আজন্ম ইয়াতীম এবং দুঃখ বেদনার মধ্য দিয়েই তিনি গড়ে
উঠেন সত্যবাদী, পরােপকারী এবং আমানতদারী হিসেবে। তাঁর চরিত্র, আমানতদারী, ও
সত্যবাদিতার জন্যে আরবের কাফেররা ভকে, ‘আল্ আমীন’ অর্থাৎ ‘বিশ্বাসী’ উপাধিতে
ভূষিত করেছিল। তৎকালীন আরবে অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, হত্যা, যুদ্ধহি ইত্যাদি ছিল
নৈমিত্তিক ব্যাপার। হরবে ফুজ্জার’ এর নৃশংসতা বিভীষিকা ও তান্ডবলীলা দেখে বালক
যহমিদ (সাঃ) দারুণভাবে ব্যথিত হন এবং ৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ১৪ বছর বয়সে চাচা হযরত
মীয়ের (রাঃ) ও কয়েকজন যুবককে সাথে নিয়ে অসহায় ও দুর্গত মানুষদের সাহায্যার্থে এবংবিভিন্ন গোত্রের মধ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা ও ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠা দ্বীপ্ত অঙ্গীকার নিয়ে গড়ে
তোলেন হিলফুল ফুজুল’ নামক একটি সমাজ সেবামূলক সংগঠন। বালক মুহাম্মদ (সাঃ)
ভবিষ্যত জীবনে যে শান্তি স্থাপনের অদূত হবেন এখানেই তার প্রমাণ মেলে।
যুবক মুহাম্মদ (সাঃ) এর সততা, বিশ্বস্ততা, চিন্তা চেতনা, কর্ম দক্ষতা ও ন্যায় পরায়ণতায়
মুগ্ধ হয়ে তৎকালীন আরবের ধনাঢ্য ও বিধবা মহিলা বিবি খাদিমা বিনতে খুয়াইলিদ বিবাহের
প্রস্তাব দেন। এ সময় বিবি খাদিজার বয়স ছিল ৪০ বছর এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর
বয়স ছিল ২৫ বছর। তিনি চাচা আবু তালিবের সম্মতিক্রমে বিবি খাদিজার প্রস্তাব গ্রহণ
করেন। বিবাহের পর বিবি খাদিজা তার ধন-সম্পদ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর হাতে তুলে
দেন। কিন্তু তৎকালীন আরবের কাফে, মুশরিক, ইহুদি, নাসারা ও অন্যান্য ধর্ম মতাবলম্বীদের
অন্যায়, অনুম, অবিচার, মিথ্যা, ও পাপাচার দেখে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর হৃদয় দুঃখ
বেদনায় ভরে যেতে এবং পৃথিবীতে কিভাবে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায়, সে
চিন্তায় তিনি প্রায়ই মক্কার অনতিদূরে ‘হেরা’ নামক পর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন। বিবি
খাদিজা স্বামীর মহৎ প্রতিভা ও মহান ব্যক্তিত্ব উপলব্ধি করতে পেরে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)
কে নিশ্চিত মনে অবসর সময় হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকার পূর্ণ সুযােগ দিয়েছিলেন।
ক্রমান্বয়ে তার বয়স যখন ৪০ বছর পূর্ণ হয় তখন তিনি নবুয়্যত লাভ করেন এবং তার উপর
সর্ব প্রথম নাজিল হয় পবিত্র কোরআনের সূরা-আলাকের প্রথম কয়েকটি আয়াত। এরপর
সুদীর্ঘ ২৩ বছরে বিভিন্ন ঘটনা ও প্রয়ােজন অনুসারে তার উপর পূর্ণ ৩০ পারা কোরআন শরীফ
নাজিল হয়।
নবুয়ত প্রাপ্তির পর প্রথম প্রায় ৩ বছর তিনি গোপনে ধীয় পরিবার ও আত্মীয়ের মধ্যে
ইসলামের দাওয়াত প্রচার করেন। সর্ব প্রথম ইসলাম কবুল করেন বিবি খাদিজা (রাঃ) এরপর
যখন তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করেন এবং ঘােষণা করেন, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ তখন মক্কার কুরাইশ কাফেররা তার বিরােধিতা করতে শুরু করে।
এতদিন বিশ্বনবী (সাঃ) কুরাইশদের নিষ্ট ছিলেন ‘আল আমীন’ হিসেবে পরিচিত; কিন্তু এ
ঘােষণা দেয়ার পর তিনি হলেন কুরাইশ কাফেরদের ভাষায় একজন জাদুকর ও পাগল।
যেহেতু কোরআন আরবী ভাষায় নাজিল হয়েছে এবং আরববাসীদের ভাষাও ছিল আরবী, তাই
তারা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর বাণীর মর্মার্থ অনুধাবন করতে পেরেছিল। তারা বুঝতে
পেরেছিল যে, মুহাম্মদ (সাঃ) যা প্রচার করছেন তা কোন সাধারণ কথা নয়। যদি এটা মেনে
নেয়া হয় তাহলে তাদের ক্ষমতার মসনদ টিকে থাকবে না। তাই তারা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)
কে বিভিন্ন ভয়, ভীতি, হমকি; এমনকি ধন-দৌলত ও আরবের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী যুবতী নারীদের
দেবার লােভ দেখাতে শুরু করে। মুহাম্মদ (সাঃ) কাফিরদের শত ষড়যন্ত্র ও ভয়-ভীতির
মধ্যেও ঘােষণা করলেন, “আমার ডান হাতে যদি সূর্য আর বাম হাতে চাঁদ ও দেয়া হল, তবু
আমি সত্য প্রচার থেকে বিরত থাকব না।” কাফিরদের কোন লােভ লালসা বিশ্বনবী (সাঃ)
কে ইসলাম প্রচার থেকে বিন্দুমাত্র বিরত রাখতে পারেনি। মক্কায় যারা পৌত্তলিকতা তথা মূর্তি
পূজা ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপন করেছিল কুরাইশরা তাদের উপর
অবর্ণনীয় নির্যাতন শুরু করে। কিন্তু ইসলামের শাশ্বত বাণী যারা একবার গ্রহণ করেছে
তাদেরকে শত নির্যাতন করেও ইসলাম থেকে পৌত্তলিকতায় ফিরিয়ে নিতে পারেনি।
৬২০ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবন সঙ্গিনী বিবি খাদিজা (রাঃ) এবং পরবর্তী কয়েক
সপ্তাহের মধ্যে চাচা আবু তালিব ইন্তেকাল করেন। জীবনের এ সংকটময় মুহূর্তে তাদেরকে
হারিয়ে বিশ্বনবী (সাঃ) শােকে দুঃখে যুহ্যমান হয়ে পড়েন। বিবি খাদিজা ছিলেন বিশ্বনবীর।
দুৱসময়ের স্ত্রী, উপদেষ্টা এবং বিপদ আপদে সান্ত্বনা স্বরূপ। চাচা আবু তালিব ছিলেন শৈশবের
অবলম্বন, যৌবনের অভিভাবক এবং পরবর্তী নবুয়্যত জীবনের একনিষ্ঠ সমর্থক। ইসলাম
প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি স্বীয় পালিত পুত্র হযরত যায়েদ বিন হারেসকে সংগে নিয়ে তায়েফ
গমন করলে সেখানেও তিনি তায়েফবাসী কর্তৃক নির্যাভিত হন। তায়েফবাসীরা প্রস্তরাঘাতে
বিশ্বনবীকে ব্যার্জরিত করে ফেলে।
৬২৭ খ্রিষ্টাব্দ মােতাবেক ষষ্ঠ হিজরীতে ১৪০০ নিরস্ত্র সাহাবীকে সঙ্গে নিয়ে মুহাম্মদ
(সাঃ) মাতৃভূমি দর্শন ও পবিত্র হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা রওনা দেন। কিন্তু পথিমধ্যে
কুরাইশ বাহিনী কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা।
ইসলামের ইতিহাসে ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’ নামে পরিচিত। সন্ধির শর্তাবলীর মধ্যে এ কথাগুলো
ও উল্লেখ ছিল যে -(১) মুসলমানগণ এ বছর ওমরা আদায় না করে ফিরে যাবে, (২) আগামী।
বছর হজ্জে আগমন করবে, তবে ৩ দিনের বেশি মক্কায় অবস্থান করতে পারবে না, (৩) যদি
নি কাফির স্বীয় অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত মুসলমান হয়ে মদীনায় গমন করে তাহলে
কে মক্কায় ফিরিয়ে দিতে হবে। পক্ষান্তরে মদীনা হতে যদি কোন ব্যক্তি পলায়ন পূর্বক মক্কায়।
ল আসে তাহলে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে না, (৪) প্রথম থেকে যে সকল মুসলমান মক্কায়
সবাস করন্থে তাদের কাউকে সাথে করে মদীনায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। আর
সলমানগণের মধ্যে যারা মক্কায় থাকতে চায় তাদেরকে বিরত রাখা যাবে না । (৫) আরবের
বিভিন্ন গােত্রগুলাের এ স্বাধীনতা থাকবে যে, তারা উভয় পক্ষের (মুসলমনি ও কাফির) মাঝে
যাদের সঙ্গে ইচ্ছে সংযােগ স্থাপন করতে পারবে, (৬) সন্ধিচুক্তির মেয়াদের মধ্যে উভয় পক্ষ
শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে যাতায়াতের সম্পর্ক চালু রাখতে পারবে। এছাড়া কুরাইশ প্রতিনিধি
সুহায়েল বিন আমার সন্ধিপত্র থেকে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম এবং মুহাম্মদুর
রাসূলল্লাহ” বাক্য দু’টি কেটে দেয়ার জন্যে দাবি করেছিল। কিন্তু সন্ধি পত্রের লেখক হযরত
আলী (রাঃ) তা মেনে নিতে রাজি হলেন না। অবশেষে বিশ্বনবী (সাঃ) সুহায়েল বিন আমিরের
আপত্তির প্রেক্ষিতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম’ এবং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ বাক্য দু’টি
নিজ হাতে, কেটে দেন এবং এর পরিবর্তে সুহায়েল বিন আমিরের দাবি অনুযায়ী ‘বিছমিকা
অপমানজনক হলেও তা মুহাম্মদ (সাঃ) কে অনেক সুযােগ সুবিধা ও সাফল্য এনে দিয়েছিল।
এ সন্ধির মাধ্যমে কুরাইশরা মুহাম্মদ (সাঃ) এর রাজনৈতিক সত্তাকে একটি স্বাধীন সত্তা
হিসেবে স্বীকার করে নেয়।