যখন হাই স্কুলে পড়তাম খুব ছোটবেলায় মনোযোগ সহকারে একটি কাজ করতাম। একটি খামভরা চিঠি হাতে নিয়ে আমার কাছে গাঁয়ের অনেকেই আসতো। খামের উপরের ডাকটিকেট খুলে নিয়ে রাখতাম স্বযতনে এবং তা সংগ্রহ করি ডাক টিকেট বইতে। গ্রামের ভাই ভাবীদের আমি অপার স্নেহে চিঠি পড়ে শুনাতাম। চিঠি পড়তে খুব মজা পেতাম এবং মাঝে-মধ্যে চোখের দুপাশ্বে জল গড়িয়ে পড়তো কখনো আনন্দাশ্রু হয়ে আবার কখনো দূঃখের গাল বেয়ে। চিঠির ভাবের সাথে তাল মিলিয়ে হৃদয়কে অনুভাব রসে আস্বাদন করে কন্ঠে তুলে নিতাম প্রিয়জনের দরদভরা কোন বাণী কিংবা কোন আদেশ-উপদেশ। অনেক সুখ-দুঃখের প্রেম-বিরহের মর্ম কথা ছিলো সেই সব পত্রাবলীতে।
আশির দশকের দিকে অনেকেই পড়ালেখা জানতোনা। তখন গ্রামের দূঃখ দূর্দশা দূর করতে জওয়ান ছেলেরা বিদেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে চলে যেতো। মধ্য প্রাচ্য থেকে অনেকেই চিঠির ভিতরে টাকাও পাঠাতো। জরুরী চিঠি হলে ডাকপিয়ন ঘরে এসে হাতেহাতে দিয়ে যেতো। অনেককে চিঠি লিখে দিতেও হতো। বিশেষ করে চিঠি লিখতে লিখতে নিজের হস্তাক্ষরের প্রতিটি বর্ণমালায় এনেছি শৈল্পিক সৌন্দর্য।
এক বড়ভাই একটা নীলখাম নিয়ে একদিন এসে বললো তুই নাকি খুব সুন্দর চিঠি পড়তে পারিস নাকি শুনেছি গাঁয়ের ভাইভাবীদের কাছে। আমার চিঠিটাও পড়ে দিতে হবে। প্রত্যুত্তরে বললাম ভাই আমিতো এমন আজব খামের কোন চিঠি পড়েনি ভাইজান মাফ করবেন। এই যে নীলখামে এসেছে চিঠিটা এটা একটা প্রেমের চিঠি। তুই আগে বড় হও, তারপর এমন নীলখাম ভরা চিঠি তুই ও পাবি।
আমি বহুদিন অপেক্ষা করেছি পাই নি কোন দিন! নীল খামে আসে এক স্বপ্নীল ভালোবাসায় মোড়ানো প্রাণের বার্তা। এমন প্রেম বিলাপ খোনে দুজন প্রয়োজনে একসাথে বাঁচবে ও একসাথে মরবে। প্রেমের জন্য অনেকেই দুজন লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, রাধাকৃষ্ণ প্রেম করে। েএকে অপরকে সারাজীবন ভালোবাসে। পানপাতার মতো কি সব আঁকিবুঁকিও ছিলো ওই সব পত্রে। আমি খুব দরদ দিয়ে পড়তাম আর পত্র দাতা বলতো আমি শ্রুতলিখন লিখতাম। মনে মনে ভাবতাম কবে বড় হবো, কবে পাবো একটু নীলখাম ভরা চিঠি।
মাধ্যমিক শেষ করার পর কলেজে পা দেয়ার সাথেসাথে ভাবতাম এবার পাবো আমি সেই নীলখামভরা মায়াবী চিঠি মধুর কোন প্রেমলীলা মোহমুগ্ধ কন্ঠস্বর ভরা একটি নীলখাম। কয়েকজন বন্ধু বান্ধবীও ছিলো কিন্তু হাতে পাইনি কখনো একটি নীলখাম ভরা ভালোবাসার মহাবাণী। তবুও আমার হাতে পৌঁছেনি একটিও পত্র। তবু একটিও পাইনি নীলখাম। মাঝেমধ্যে কিছু হলুদ বাদামি খাম পেতাম শুধু। । এই দুঃখে নীলখামের আশা ত্যাগ করলাম। গ্রাম থেকে নির্বাসিত হলাম।