অনেক দিন আগে এই ঠাকুরগাঁও শহরটা এমন আধুনিক, জাক-জমক ছিল না। চারদিকে ছিল কিছু বাড়ি-ঘর আর কিছু জনবসতি। বেশিরভাগ জায়গায় ছিল খোলা মাঠ। মাঝে মাঝে গাছ-পালা দিয়ে আচ্ছাদিত বন-বাদাড়ও ছিল। আজকের টাঙ্গন নদীর দুই ধারে যেমন অনেক বাড়ি ঘর তৈরি হয়েছে। এরকম কিছুই ছিল না।
চারদিক ফাকা ফাকা বাড়ি-ঘর। পশুপাখিদের আনাগোনা সবসময় লেগেই থাকে। পাকা রাস্তা কি জিনিস, তা কেউই জানত না। কাঁচা রাস্তা ছিল চলার জন্য। বাস, ট্রাক, অটো, ভ্যান কিছুই ছিল না। পরিবহন করার জন্য ছিল গরুর গাড়ি, মহিষের গাড়ি ইত্যাদি। চাষবাস করার জন্যও কোনো ট্রাক্টর ছিল না। গরু-মহিষ দিয়ে চাষাবাদ করা হতো। সার, কীটনাশক না থাকায়, গরু-মহিষের গোবর, ছাই দিয়ে ফসল ফলানো হতো।
এরকম সময়ে গগেন নামে এক কিশোর কোনো কাজ না করে সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়াতো। সে ছিল হরেন নাপিতের ১১ তম পুত্র। সবচেয়ে ছোট সে। বাকি ভাইয়েরা বিভিন্ন গ্রামে নাপিতের কাজ করে বেড়াতো। কিন্তু গগেন কোনো কাজই করতো না। গগেনের ভাইয়েরা তার বাবাকে বলে, “গগেনকে কাজ করতে বল। না হলে ওকে বাড়ি থেকে বের করে দাও। ও কোনো কাজ না করে শুধু বসে বসে খাবে, তা হবে না।”
হরেন তার ছোট ছেলেকে কাজ করতে বললেও গগেন কোনো কথাই শুনত না। তাই তার বাবা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। কিন্তু গগেনের কোনো টেনশনই ছিল না। কি খাবে, কোথায় থাকবে, সে বিষয়ে তার কোনো চিন্তা নেই। কারণ, সে বন-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। গাছের ফল খেয়ে সে পেট ভরায়। গাছের মোটা কাণ্ডে বসে আরামসে সে ঘুমিয়ে পড়ে। তাকে যে তার বাবা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, সেটা সে মনেই আনে না।
কারণ, প্রত্যেকদিনই তো তার বাবা কানের কাছে এরকমই ঘেনর ঘেনর করে। বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেয়। তাই সে আজকের ব্যাপারটা মাথায় ততটা ঢুকায় নি। সে ভাবে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে তো কি হয়েছে, মন থেকে তো বের করে দেয় নি। বাড়ি না গেলেও বনে-বাদাড়ে ঘুরে ফিরে বাকি জীবনটা পার করে দিতে পারব। কেউ কানের কাছে আর ঘেনর ঘেনর করবে না। তার যা ইচ্ছা সে তাই করবে। কি মজা স্বাধীন জীবনে!
সে ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠে দেখে চারদিক অন্ধকার। সে বনের ভিতরে। আশেপাশে কুকুর-শিয়ালের ডাক শুনা যাচ্ছে। সে অনেক ভয় পেয়ে গেলো। ভয়ে সে সামনে দৌড় মারল। অন্ধকার জঙ্গলে কিছুই দেখা যায় না।
সে চোখ বন্ধ করে তাই জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। হঠাৎ সে কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। আর হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে বুঝল এটা একটা সিন্দুক।
সে উঠে আবারো দৌড় মারল। কিন্তু সে সিন্দুকটি নিতে ভুলল না। দৌড়াতে দৌড়াতে সে তার বাড়ির কাছে চলে আসলো। এসেই সে তার বাবাকে প্রাণপণে ডাকতে লাগলো।
বাকি ভাইয়েরা বলাবলি করতে লাগলো, “দ্যাখ হারামিটা আবার চলে এসেছে। এবার কিন্তু তারে আমরা মাইরাই ফেলামু।” এই বলে তারা সবাই ঘর থেকে বের হয়।
বের হয়ে দেখে গগেনের হাতে একটা সিন্দুক। তার বাবা সে সিন্দুকটা নিজের কাছে নিল। আর খুলে দেখল তাতে অনেক স্বর্ণমোহর। বাকি ভাইয়েরা এটা দেখে তাদের ক্ষোভ ভুলে গেলো।
তারা গগেনের কাছে মাফ চেয়ে বলল, “আমাদের তুই ক্ষমা করে দিস। তোকে আর ঘর থেকে বের করে দেব না। আট তোকে কাজের কথাও বলব না।”
গগেনের এটা মনেই ছিল না। সে তখন বলল, “আমার তো এটা মনেই ছিল না। আমি কষ্টও পাই নি। আমি তো এসব কিছুর পাত্তাই দিই না।” এরপরে তার বাবা এসব স্বর্ণমোহর বিক্রি করে অনেক জমিজমা কিনে। আর সেই জমি জমা অন্য মানুষকে বর্গা করতে দেয়। অনেকটা জমিদারি প্রথার মতো।
আর গগেন আগের মতোই ঘুরে বেড়ায় টো টো করে। কেউই তাকে খোঁটা দেয় না। কিন্তু বাকি ভাইয়েরা এই সম্পদের উপর খুব লোভ করে। তারা একে অপরকে মেরে ফেলতে চায়। কিন্তু গগেনকে তারা কিছুই করে না। কারণ, গগন যে সাদা-সিদে। সে তো আর সম্পদে দখল নিতে আসবে না। শুধু টো টো করে ঘুরে বেড়াবে।
এই লোভের ফলে এক রাতে এক ভাই বাকি ৯ ভাইয়ের খাবারে বিষ মিশিয়ে দেয়। ওই ৯ ভাইয়ের একজন চালাক ভাই ১ম ভাইকে মারার জন্য তার ঘরের বিছানায় সাপ রেখে আসে। ফলে ১ ভাই সাপের কামড়ে, আর বাকি ৯ ভাই বিষের কারণে মারা যায়। অন্যদিকে গগেন একা সব সম্পদ পেয়ে যায়। তাই বলি, “লোভ করা ভালো নয়!”