হানিফ সংকেত নামটা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের কাছে পরিচিত।
হ্যা, আমি ইত্যাদির উপস্থাপক হানিফসংকেত স্যার এর কথায় বলছি।
একদিন তিনি পাবনার পাগলাগারদে যান।তিনি পাগলাগারদের গেইট খুলে ঢুকতেই একজন মানসিক রোগী বলে উঠলো,”আমি আপনারে চিনি। ইত্যাদি অনুষ্ঠানে দেখছি”।
আর একজন বলে উঠলো,”আপনি উপস্থাপক।বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ।”
আর একজন অনর্গল গেয়ে গেলেন ইত্যাদির গান,”কেউ কেউ অবিরাম চুপি চুপি চেহারাটা পাল্টে সাজে বহুরুপি”।
আর একজন বলে উঠলো যে সে চিন্তাও করে নাই তাঁর সাথে দেখা হবে।তারা সবাই নিজেরদের কষ্টের কথা তুলে ধরলেন, কেউ খাবার নিয়ে,কেউ থাকার ব্যবস্থা নিয়ে,কেউ ডাক্তারের অপ্রতুলতা নিয়ে অসন্তোষ।সবচেয়ে বড় কথা,যখন থেকে তারা এই মানুষটিকে দেখেছে তখন থেকেই মনের মধ্যে জানা হয়ে গেছে এই মানুষটাই পারে তাদের কথা সবার সামনে তুলে ধরতে।
হ্যা তিনিই হচ্ছেন আমাদের প্রিয় হানিফ সংকেত স্যার।
উনি নিজের সময়টা তাঁর গড়ে তোলা মিরপুরে অবস্থিত অফিসে কাটান। একদিন অফিসে ঢুকে দেখলেন এক বৃদ্ধা আর যুবক দাঁড়িয়ে আছেন অফিসের ভিতরেই। উনি ঢুকতেই তাঁর পায়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে যুবকটা আর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধা যুবকের মাথায় হাত বুলাচ্ছেন। আসল কারণ কি জানেন?
ইত্যাদিতে বাগেরহাট মোড়েলগঞ্জের বীরেন্দ্রনাথ মজুমদারের মা ভক্তির একটা প্রতিবেদন প্রচারিত হয়েছিলো। এই যুবকটা সেই প্রতিবেদন দেখে অনুশোচনায় পড়ে নিজের ভুল বুঝতে পেরে তৎক্ষণাৎ তার বৃদ্ধা মাকে বৃদ্ধাশ্রম থেকে ঘরে নিয়ে আসে।
বলাবাহুল্য, সেদিন হানিফ সংকেতের মনে কতোটা তৃপ্তি এসেছিলো, চোখের কোণায় কত ফোঁটা অশ্রু জমেছিলো হিসেব করার কোন পরিমাপযন্ত্র সৃষ্টি হয় নিই। এইখানেই একজন স্রষ্টার স্বার্থকতা।
হঠাৎ একদিন ফোন আসলো।
কলটি এসেছিলো ফ্রান্সের খ্যাতনামা টিভি শো হতে যারা বিশ্বের প্রখ্যাত মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের নিয়ে নথি তৈরী করেন আর বাংলাদেশের আদি-অন্তের একজন উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব হলেন হানিফ সংকেত স্যার যার জন্যেই সুদুর ফ্রান্স থেকে ফোনটি এসেছিলো!
এমন একজন ব্যক্তি তিনি যে ছিলেন সম্পুর্ন মিডিয়াবিমুখ। কথাটার সত্যতা প্রমাণ করতে কিছু কথা তুলে ধরি। এটিএন বাংলা চ্যানেল হতে প্রস্তাব এসেছিল হানিফ স্যারের সাক্ষাত্কারের জন্য। এক ঘন্টার জন্য গুণেগুণে ৫ কোটি টাকার প্রস্তাব দিয়েছিলেন যা ছিলো তৎকালীন যুগের জন্য রেকর্ড পরিমাণ অর্থ প্রস্তাব কিন্তু সদা হাস্যোজ্জল ব্যক্তিটা নাকচ করে দেন। এমনকি কয়েকবার ফোন অপারেটর কোম্পানীর মোটা অংকের বিনিময়ে মডেল হওয়ার প্রস্তাব তিনি বিনয়ের সহিত ফিরিয়ে দেন।
একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তিই পারেন এমন লোভনীয় অফার ফিরিয়ে দিতে।
ইত্যাদি আর হানিফ সংকেত একজন আরেকজনের পরিপূরক। ১৯৮৯-২০১৭ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৯ বছর ধরে আমেজ ধরে রাখতে পারাটা কোন চাট্টিখানি কথা নয়। নানা-নাতি, নকুল বিশ্বাসের গান দিয়ে বা অন্যান্য হাসিতামাশার মধ্য দিয়ে কেমনে মানুষের দুরাবস্থা, সমাজের অসঙ্গতি, তুলে ধরা যায় তার উজ্জ্বল প্রমাণ “ইত্যাদি”। সেই সাদাকালো টিভির যুগ হতে আজ মোবাইলের প্রজন্মের কাছে সমান প্রিয় এই অনুষ্ঠানটির স্রষ্টা হানিফ সংকেতের জন্মদিন আজ। ভক্তদের অনুরোধ এসে আর দেখে তিনি বিমোহিত কারণ প্রজন্মের এই ধারায় এসেও তাঁর কদর চুল পরিমাণ কমে যায় নিই। আসলে এর পিছে তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম, মেধা আর অধ্যবসায় কাজ করেছে।
আমরা বিটিভি প্রজন্ম শুক্রবার বিকেল ৩ টায় সেই পবিত্র কোরআন আর ত্রিপিটকের বাণীর পর স্মৃতিসৌধের ছবি দেখা পর্যন্ত অবিরাম চেয়ে থাকতাম। পর্দা উন্মোচনের আগে স্ক্রিন জুড় থাকা বিভিন্ন রঙের রিভনটা নজরকাড়া ছিলো। তখনকার জন্য ওইটাও অনিন্দ্য সুন্দর ছিলো। অল্পতেই মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়তো।
ইত্যাদি, আলিফ লায়লা, সিন্দবাদ, আর মিনা ছিলো আমাদের বিনোদনের আখড়া। বর্তমান প্রজন্ম যেইখানে হিংস্র থাবায় ছিন্নভিন্ন, পথহারা সেইখানে আমাদের জন্য অতীতে ছিলো এই অনুষ্ঠানগুলোই নির্মল বিনোদনের খোরাক। ছিলো শিক্ষামুলক উপাদান।
কথা হচ্ছিলো হানিফ স্যারকে নিয়ে যিনি ২০১০ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী একুশে পদক এবং ২০১৪ সালে জাতীয় পরিবেশ পদক পান, তবে এইসবের উর্ধ্বে তাঁর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো দেশের জনগণের মনে ঠাঁই করে নেয়া যা এক কথায় কোন ব্যক্তির পক্ষে অসম্ভব।
১৯৫৭ সালের এই দিনে বরিশাইল্লা মনুরা পেয়েছিলো হানিফ সংকেতকে। বাংলাদেশ গর্বিত এমন এক কিংবদন্তীকে নিজের গর্ভে ধারণ করতে পেরে।
শুভ জন্মদিন হানিফ সংকেত স্যার। বেঁচে থাকুন অনন্তকাল, মানুষের হৃদয়ের মণিকোটায়। শুভ জন্মদিন হানিফ স্যার।
আপনিই সেরা, আপনিই শ্রেষ্ঠ উপস্থাপক।