— কই রে ঝুমা, তোর হলো? আর কতক্ষন? চা-নাস্তা দে। আমায় আবার গরুগুলোকে খাওয়াতে যেতে হবে। বড় জা’র হাঁকডাকে ঝুমা হকচকিয়ে গেল। বলল, — এই তো বড়দি, দিচ্ছি। মেজজা রুটি বেলছে। আর ঝুমা ভাজি তৈরি করে বড় জা’কে রুটি দিয়ে খেতে দিল। দুইমুখী চুলার আগুনে ঝুমা একেবারে ঘেমে গেল। শাশুড়ি এসে বলল, — কই গো সেজ বৌমা, তোমার শ্বশুরের গরম জল হয়েছে? উনি স্নান করে খেয়ে দেয়ে বের হবে তো। ঝুমা বলল, — হ্যাঁ মা চা টা নামিয়ে দিচ্ছি, গরম জল।
এর মধ্যে ঝুমার স্বামী, দুই ভাসুর গরম গরম ভাত আর তরকারি খেয়ে যার যার কাজে চলে গেছে। বড় জা মুখে পান দিতে দিতে বলল, — এতদিন হয়ে গেল সংসার করছিস তারপরও তোকে প্রতিদিন তাড়া দিতে হয়। এত ধীর হলে চলে? আমি গেলাম মা, গরুগুলোকে খাইয়ে আসি।
ঝুমা কিছুই বুঝতে পারে না। এত ভোরে ঘুম থেকে উঠে দৌড়াদৌড়ি করে কাজ করে, তারপরও তার কাজ শেষ হয় না।ননদ আর দেবর এসে বলল, — দেখি সেজ বৌদি আমাদের ভাত দিয়ে দাও। কলেজের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
ঝুমা বলল, — বস দিচ্ছি। বাবাকে একটু গরম জলটা দিয়ে আসি।
শাশুড়ি বলল, — মেজ বৌমা আমাকে একটু চা দিয়ে দাও।আজ ক্ষেতে গিয়ে মরিচ গাছগুলো ঠিকমতো বড় হচ্ছে কিনা দেখে আসতে হবে। তাছাড়া বেগুন গাছেও পোকা আসছে।
মেজ বৌমা বলল, — দিচ্ছি মা। আমার রুটি বানানো শেষ।
ঝুমা এসে ননদ আর দেবরকে ভাত দিল। এর মধ্যে দুই জা’এর দুই মেয়ে এসে বলল, — সেজ মা আমাদের স্কুলের জন্য তৈরি করে দাও। তখনো ঝুমার এক বছরের ছেলেটা ঘুমাচ্ছে। ভাগ্য ভালো যে সে ৯টা/১০টার আগে উঠে না। না হলে ঝুমার আরো কষ্ট বেড়ে যেত।
সবার কাজ সারতে সারতে নয়টা বেজে যায়। এরপর মেজ জা’র সাথে বসে ঝুমা চা খায়। ছেলে ঘুম থেকে উঠলে তাকে কিছু খাইয়ে খেলনা দিয়ে ওর পাশে বসিয়ে রাখে। মাঝে মাঝে শাশুড়ির কোন কাজ না থাকলে নাতির সাথে বসে খেলা করে। এতে ঝুমা কিছুটা নিশ্চিন্ত থাকে।
তারপর শুরু হয় দুপুরে সবার জন্য রান্না বান্না। মেজ জা তরকারি কেটে দেয়। ঝুমা বাটনা বেটে রান্না করতে বসে যায়। দুপুরে সবাই খাবার পর ঝুমা একটু বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পায়। ছেলেকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে ভাবে সেই দিনগুলোর কথা।
তারা তিন বোন মিলে পুতুল খেলছিল। হঠাৎ জ্যাঠা এসে মাকে বলল, — তোমার ঝুমার জন্য একটা ভালো ছেলে পেয়েছি। ব্যবসা করে। ওদের পৈতৃক ব্যবসা। যৌথ পরিবার। কিন্তু মা বলল, — ওর তো এখনো মাত্র পনের বছর। জ্যাঠা বলল, —দেখ ওর বাবা ও নেই। ঝুমা দেখতে ভালো। তিনটা মেয়ে নিয়ে তুমি কষ্টে আছ। তার চেয়ে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়ে দাও। একটার তো গতি হবে। ঝুমার দুই বোন হঠাৎ কেঁদে উঠলো। দিদি তোর বিয়ে হয়ে যাবে? আমরা তাহলে কার সাথে পুতুল খেলব? ঝুমা দুই বোনকে জড়িয়ে ধরল। মুখে কোন শব্দ বের হলো না।
বড় পরিবারের কথা শুনে মা প্রথমে আপত্তি করেছিল। কিন্তু সবাই যখন বলল, — ওদের অনেক টাকা পয়সা। তোমার মেয়ে ভালো থাকবে। মা আর কোন উপায় না দেখে রাজী হলো।
এসব ভাবতে ভাবতে ঝুমা যে কখন ঘুমিয়ে পড়ল জানে না।
মেজ জা’র ডাকে ঘুম ভাঙল।
— কিরে ঝুমা আর কতক্ষণ ঘুমাবি? সন্ধ্যা হয়ে আসছে। সবাইকে চা-নাস্তা দিয়ে দে। ঝুমা ধড়ফড় করে উঠে গেল। আবার কাজে লেগে গেল। সবাইকে খাবার দিয়ে রাতের রান্নার আয়োজন করতে বসল। তখন কাজ করতে করতে তিন জা বসে গল্প করে। সারাদিনের পরিশ্রম শেষে রাতে ঘুমাতে যায়।
ঝুমা যখনই বাপের বাড়িতে যায় কাজের ভয়ে শ্বশুরবাড়িতে আসতে চায় না। মা সেটা বোঝে। কিন্তু কি করবে। মেয়ে হয়ে জন্মেছে। পরের ঘরেই তো সারাজীবন সুখে দুঃখে কাটাতে হবে। মেয়েকে বোঝায়, — দেখিস একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।মা মনে মনে ভাবে, — মেয়েকে কোনদিন চুলার আগুনে যেতে দেয় নি। সেই মেয়ে আজ কতজনের জন্য রান্না করে। আশীর্বাদ করি মা, তোর সংসারে তুই একদিন ঠিক খাপ খাইয়ে যাবি। সবাইকে নিয়ে সুখে থাকবি।
এভাবেই কতো ঝুমা সংসারের যাঁতা কলে গুমরে গুমরে পিষে মরে।