১)এটা ছিল একটি শীতকালীন দিন। ভোর থেকেই চারিদিক কুয়াশাছন্ন। স্নেহা সকাল থেকেই খানিকটা অস্থির হয়ে আছে আজ। স্নেহার বয়স ২৯। বয়সের তুলনায় তার দায়িত্ব বেশিই বলতে হবে। ছোট ভাই স্কুলে পড়ে , বা ছোটখাট চাকরি করতো। এখন অন্য পৃথিবীর বাসিন্দা তিনি। মা , আর ছোটভাইকে নিয়ে স্নেহার জীবন যুদ্ধ চলছে। আমাদের এই দেশে স্নেহার মতোই অনেক বড় বোন আছেন যারা জীবনের স্বাদ আল্লাদ বাদ দিয়ে দিয়ে প্রতিনিয়ত ছোট ভাই বা বোন আর পরিবারকে আগলে রাখতে জীবন সংগ্রাম করে চলছে।
স্নেহার জীবনটা ছকে বাঁধা। সকাল শুরু হবে টিউশনি দিয়ে রাতের ঘুমের আগেও মাথায় ঘুরতে থাকবে অংকগুলো। গণিতের উপর অনার্স মাস্টার্স করে আপাতত ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে টেনেটুনে চলছে সংসার। শত চেষ্টা করেও এখনো সুবিধামত কোনো চাকরি জোগাড় করতে পারেনি। ব্যাংকে কয়েকবার ভাইভা পর্যন্ত গিয়ে ভাগ্যের কাছে হেরে আসতে হয়েছে।
তবুও স্নেহা হাল ছাড়ছেনা। টিউশনির তাকে সংসার খরচ চালিয়ে , কিছু টাকা বাঁচিয়ে ,ভালো কোনো জায়গায় ভালো কোনো কাজের জন্য ছুটাছুটি করছে। ভাইটার অনেক শখ একটা সাইকেল কিনবে। কিনে দিবে করে করেও দু বছর চলে গেলো। মায়ের চোখের ছানির অপারেশন আটকে আছে এক বছর হলো। স্নেহার দৃঢ় বিশ্বাস দিন ফিরবেই। এর মধ্যে স্নেহার জন্যে ভালো ঘর এসেছে দু চারখানা। শর্ত ছিল বিয়ের পরে চাকরি করতে পারবেনা স্নেহা। স্নেহা হয়তো অনেকের মতো নিজের স্বার্থে এই সংসার ত্যাগ করে সুখের সাগরে গা ভাসাতে পারতো। স্নেহা পারেনি , আরো কিছু এমন মানুষের মতোই , স্নেহা নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছে এই সংসারের ভার। এখন স্নেহার পৃথিবী জুড়ে আছে এই সংসার।
কত জনের কত কটাক্ষ। বয়স বেড়ে যাচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। তবুও স্নেহা নির্বাক হরিণী আর সুস্থির বাঘিনীর মতোই তার স্বপ্নের পথে অবিচল। হ্যা যা বলছিলাম , আজ এই শীতের সকালে স্নেহা একটু অস্থির। আরেকবার স্বপ্ন পূরণের জন্যে সে আজ ঢাকার পথে রওয়না হবে। বেলা তিনটায় ট্রেন। মহানগর গোধূলি। ১০ টা নাগাদ ট্রেন পৌঁছবে শহরে। স্নেহাকে ট্রেইনে উঠিয়ে দিতে এসেছে তার ছোট ভাই। ক্লাস এইটে পড়ে। তাদের বাসার পাশেই চট্টগ্রাম রেল স্টেশন। বিদায় বেলায় ছোট ভাইয়ের চোখেও উঁকি দিচ্ছিল স্বপ্ন , তার মন বলছিল তার বড় বোন এবার স্বপ্ন নিয়েই বাড়ি ফিরবে।
২)মতিঝিলের ব্যস্ত রাস্তায় স্নেহা দাঁড়িয়ে আছে। পরের দিন সন্ধের কথা বলছি। স্নেহার মাথার উপর আকশ অন্ধকার। কিন্তু স্নেহার হৃদয় আকাশ এখন এতই বিশাল সেখানে এই অন্ধকারও হারিয়ে যাচ্ছে। হ্যা এতো বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে স্নেহা তার আরাদ্ধ চাকরিটা পেয়েছে। নামি দামি কোম্পানি , ভালো বেতন। নিজের জেলাতেই পোস্টিং। সব মিলিয়ে সোনায় সোহাগা যেন।
বাড়িতে কল করে স্নেহা জানিয়ে দিয়েছে ব্যাপারটা। প্রথমবার মা যখন কলটা ধরলো। মা আমার চাকরিটা কনফার্ম বলতে গিয়ে স্নেহার গলাটা কান্নায় বুজে এলো। মার্ চোখের অশ্রু স্নেহা এ পাশ থেকেও ঠিক টের পাচ্ছিলো। ভাইয়ের সেকি চিৎকার ‘এইবার তবে সাইকেল পাচ্ছি ‘ ….. স্বপ্নটা খুব কাছেই। বাসায় গিয়ে সব ডকুমেন্টস গুলো নিয়ে দু দিন পর চাকরিতে জয়েনিং। সেদিন সন্ধ্যার বাসেই একটা টিকিট বুকিং করলো স্নেহা। বাস ছুটছে স্বপ্ন নিয়ে। স্নেহা চিন্তা করছে এই বাসেরই কত জনের কত শত স্বপ্ন আছে।
সিটিগেট পার হতে হতে স্নেহার চোখে ঘুম নেমে এসেছিলো ,
এরপর সে শুধু শুনেছিলো একটা কর্কশ চাকা ঘষার আওয়ায , কিছু আর্তচিৎকারে , এরপর সব নীরব। .. চিরদিনের মতো নীরব। এমনকি সাইড গ্লাসের পাশ দিয়ে অন্য কোনো গাড়ির থেকে বের হয়ে আসা লোহার রড স্নেহার গলা ভেদ করে চলে গিয়ে স্নেহার মৃত্যু হয়েছে , এটাও সে ঘুন্নাক্ষরে টের পায়নি এতই দ্রুত ঘটেছে ব্যাপারটা।
স্নেহার কাপড়ের সাথে দুমড়ে মুচড়ে পড়ে থাকা বেগে পরিচয় পত্র পাওয়া গিয়েছিলো। সেখানে মাতার পরিচয় ও নাম্বার ছিল। অকুস্থলের থেকে লাশ উদ্ধার শেষে জানিয়ে দেওয়া হলো বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে । স্নেহার পাশের বাড়ির কেউ স্নেহার মাকে পৃথিবীর সবচাইতে নিষ্ঠুর সত্য জানালো। মা ভাইয়ের আহাজারিতে সিক্ত হলো প্রতিটি নিকটবর্তী হৃদয়।
আরো কিছুক্ষন পরের কথা ,
মা , আর ভাইয়ের সাথেই স্নেহার লাশ বাড়ি ফিরছে , কাফনের কাপড়ে মুড়ে।
সাথে স্বপ্নগুলোও।সাদা খামে করে এগিয়ে যাচ্ছে স্বপ্নের চিঠি।